অকূলের কাল। পর্ব ২৪। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
এবঙ্গে ওবঙ্গে
অশোকের খবর কিছু কিছু পাওয়া যাচ্ছিল অমিয়র কাছ থেকে। প্রথম প্রথম কোম্পানি প্রেসিডেন্সি জেলে গেলে তার সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকারই করত অশোক। তার বাবা সেসবে মাথা গরম না করে তাদের মামলার জন্য ভাল উকিল ঠিক করা, তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি সময়মতো করে চলেছিলেন। ওদের মধ্যে একমাত্র বুলিই তার বাড়ির লোকের সঙ্গে দেখা করে। জানা গেছে তারা নাকি খুব ভালোই আছে জেলে। ওখানে সব নকশালরা একসাথে জোট করে আছে। তাদের পাড়ারও দু-তিন জন সিনিয়ার নকশাল নেতাকে পেয়েছে সেখানে। তারা সবাই মিলে দু- বেলা কোরাসে বিপ্লবের গান গায়। অন্য কয়েদিরা তাদের পিছনে লাগা দূরের কথা, উলটে বেশ সমীহ করে। কোম্পানির চেষ্টার কথা শুনে দিলীপ নাকি বলেছে, তারা কারোর দয়ায় জেল থেকে বেরোবে না। ডেবরায় শিগগিরই বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে। তখনই তারা জেল ভেঙ্গে বেরোবে। জেলে থাকা-খাওয়া খানিক অসুবিধের হলেও তাদের তেমন কষ্ট হচ্ছে না। রক্ষীদের সৌজন্যে তাদের বিড়ির জোগান নিয়মিত। আর কী চাই!
কাল অমিয় একটা নতুন খবর দিল। আজকাল অশোক কোম্পানির সঙ্গে দেখা করায় আপত্তি করছে না। তিন মাস পরে তাদের টি আই প্যারেডের দিন ঠিক হয়েছে। তারা অন্যান্য কয়েকজন কয়েদির সঙ্গে তাদের কেসের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীদের সামনে সার বেঁধে দাঁড়াবে। সেখানে সরকারি উকিল এবং আসামীদের উকিলের সঙ্গে উপস্থিত থাকবেন ইনভেস্টিগেটিং অফিসারও। সাক্ষীদেরকে চিনে নিতে হবে সেদিন অকুস্থলে কে বা কারা সেই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। টি আই প্যারেডের জন্য তাদেরকে তিনমাসের জন্য আলিপুরের স্পেশাল জেলে বদলি করা হয়েছে। আদালতে মামলার নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত এখানেই তাদের রাখা হবে। এই জেলে খাওয়াদাওয়া নাকি অনেকটা ভালো। তা হোক, তবুও সকলের বাড়ির লোকের যেমন, তেমনই ক্ষিতিও প্যারেডের ফলাফলের জন্য দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করছে।
পাশের বাংলায় মুক্তিযুদ্ধের উন্মাদনায় এদিকের মানুষরা যখন আন্দোলিত হচ্ছেন, রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মিলেমিশে আন্দোলনের সমর্থনে মিটিং-মিছিল করছেন, কবিরা কবিতা লিখছেন, আকাশবাণী কলকাতা থেকে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠের মর্মস্পর্শী সংবাদ পরিক্রমায় মানুষ শিহরিত হচ্ছেন, তখন লোকসভার সাধারণ নির্বাচন হয়ে গেল। ইন্দিরা গান্ধি তো আগেই পুরো কংগ্রেস দলটাকেই কব্জা করে নিয়েছিলেন, তার উপরে সিপিআই তাঁর দোসর হয়েছে। ফল বেরোলে দেখা গেল তাঁর দলের জয়জয়কার। লোকসভা নির্বাচনের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার অন্তর্বর্তী নির্বাচনও হয়ে গেল কিন্তু এখানে কংগ্রেস তেমন সুবিধে করতে পারল না। তাও তো বামফ্রন্ট আগেই দু-টুকরো হয়ে গেছে। একটা ফ্রন্ট সিপিএমের নেতৃত্বে এলডিএফ, অন্যটা অজয় মুখারজির বাংলা কংগ্রেসের নেতৃত্বে ইউডিএফ। ফল বেরোলে দেখা গেল দুটো ফ্রন্ট আর কংগ্রেসের মধ্যে কেউই নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। একক গরিষ্ঠতা পেয়েছে এলডিএফ, সিপিএমই যথারীতি সর্বাধিক আসন জিতেছে। ফলে কংগ্রেস আর বাংলা কংগ্রেসের মধ্যে নেপথ্য বোঝাপড়া হলো। অজয় মুখার্জি রাজ্যপালের কাছে তাঁর সমর্থক সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কের নাম দাখিল করলেন। রাজ্যপালকে তো কেন্দ্রীয় সরকারের পুতুল হয়েই থাকতে হয়, তাছাড়া এলডিএফের নেতা জ্যোতি বসু মন্ত্রিসভা গড়ার দাবি জানাননি। অতএব কংগ্রেসের সমর্থনে অজয় মুখার্জি তৃতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন। কংগ্রেস কিন্তু মন্ত্রিসভায় যোগ দিল না।
ক্ষিতি এখন পিএসসির ক্লার্কশিপ পরীক্ষার জন্য তৈরি হচ্ছে। তৈরি আর কি – অঙ্ক ইংরাজি বাংলাতে নতুন কিছু করার নেই, ইস্কুলের বিদ্যাই যথেষ্ট। প্রস্তুতি কেবল জিকে আর কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স-এর জন্য। মনোজিৎদাও ক্ষিতির সঙ্গে যোগ দিয়েছে। কস্টিং নিয়ে তাঁর খুব একটা আগ্রহ নেই। কবি হিসাবে স্বীকৃতি পাবার জন্যই তার কলকাতায় আসা। কিছু একটা নিয়ে পড়াশুনা চালিয়ে যাওয়ার জন্যেই কস্টিং নিয়ে ভর্তি হওয়া। এদিকে তার বাড়ির আর্থিক অবস্থা সুবিধের নয়। তার মা বোধহয় গয়নাটয়না বিক্রি করে মনোজিৎদার খরচ চালাচ্ছেন। সে আর কদ্দিন চলবে। তাছাড়া আলো, তার প্রেমিকা বিয়েটা সারতে চাইছে। অতএব ক্লার্কশিপ দিয়ে সে চাকরির চেষ্টা শুরু করবে। তাছাড়া মনোজিৎদা পদার্থবিজ্ঞানে সাম্মানিকসহ গ্র্যাজুয়েট। চাকরির আরও অনেক পথ খোলা আছে। তার লক্ষ্য শেষ পর্যন্ত ডব্লিউবিসিএস। ক্ষিতিরও সেরকম ইচ্ছে কিন্তু তার জন্য তাকে আগে গ্র্যাজুয়েট হতে হবে।
মনোজিৎদা বাংলা তো বটেই, ইংরাজিটাও দুর্দান্ত লেখে। তার কাছে ক্ষিতির নিজের ইংরাজি শিশুসুলভ। তার ইংরাজিসাহিত্যের পাঠ অতি অল্প। ইস্কুলে কেবল গ্রামারটাই ভালো শিখেছে। তাদের এইচ এস সিলেবাসে ইংরাজি ভাষার লেখকদের লেখা নিয়ে কোনো সংকলনই পাঠ্যসূচিতে ছিল না। ভাবা যায়! নতুন হেডমাস্টার গোলকবাবু রানাঘাট কলেজের ইংরাজি বিভাগের প্রধান ছিলেন। সেখান থেকে গড়বেতা স্কুলের হেডমাস্টার হয়ে ক্লাস নিতে এসে প্রায়ই আপসোস করতেন এই নিয়ে। পড়িয়ে আনন্দ পেতেন না। এখানে অনার্স ক্লাসে দু-এক জন অধ্যাপকের, বিশেষ করে কেজির নোটস পড়ে তার গঠন-বিন্যাস বুঝতেই পারে না ক্ষিতি।
মনোজিৎদার কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স ঠোঁটস্থ। সেটাও তার জোরের জায়গা। তার একটাই দুর্বলতা – পাটিগণিত। ক্লার্কশিপ পরীক্ষায় অঙ্ক মানেই পাটিগণিত, জ্যামিতি বা বীজগণিত নেই। ক্ষিতির আবার ওইটাই সবচেয়ে জোরের জায়গা। ফুল মার্কস বা কাছাকাছি পাওয়ার ব্যাপারে খুবই আত্মবিশ্বাসী সে। তারা যখন একসঙ্গে প্রস্তুতিতে বসে তখন মনোজিৎদা তাকে কারেন্ট অ্যাফেয়ার্সের জ্ঞান দেয় আর ক্ষিতি তাকে পাটিগণিতের নিয়ম শেখায়। ক্ষিতির আর একটা ভরসা যে ক্লার্কশিপ পরীক্ষার ইংরাজি পেপারে লেখালেখির ব্যাপারটা খুবই কম। কম্প্রিহেনসেন, গ্রামার, প্রিসি ইত্যাদিতেই বেশি মার্কস।
এর মধ্যেই ক্ষিতি একদিন কলেজে গিয়ে দেখে ছাত্রইউনিয়নের নোটিশ বোর্ডে কলেজ ম্যাগাজিন প্রকাশিত হবে এবং তার জন্য ছাত্রদেরকে কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ ইত্যাদি চেয়ে নোটিশ দেওয়া হয়েছে। হাতে চাঁদ পেল সে। যদিও ইদানীং সে লিখছে না বিশেষ কিন্তু অনেক গল্প কবিতা জমে আছে। বুঝতেই পারছিল না কোথায় পাঠাবে। মনোজিদা অবশ্য বলেছিল একবার, তার কাছে অনেক ছোট পত্রিকা আছে, সেখান থেকে ঠিকানা নিয়ে পাঠাতে। কিন্তু সে তেমন কিছু উৎসাহ দেয়নি বলে পাঠাব পাঠাব ভেবেও পাঠানো হয়নি। আর গত দু-বছর কলেজে নকশাল আর এস এফ-এর ছাত্রদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি চলতে থাকায় না এস এফের ছাত্র ইউনিয়ন, না কলেজ কর্তৃপক্ষ, খেলাধুলা বা সাংস্কৃতিক কার্যকলাপ নিয়ে মাথা ঘামানোর অবসর পেয়েছে। সেদিন হঠাৎ চোখের সামনে সুযোগকে ঝুলতে দেখে বিগলিত ক্ষিতি পরের দিনই ছাত্র সংসদের ঘরে গিয়ে একটা গল্প আর একটা কবিতা নিষ্ঠুর মুখের ইউনিয়ন-দখলদার ছেলেটির কাছে জমা দিয়ে এল।
(ক্রমশ)
