অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২৩। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

ছয় : সুমনের ছায়াছবি আর পোস্টারীয় ছবি

এতসব গল্পে আধাখেঁচড়া পোস্টারে সুমনের বাগানঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রঙের খুরি, বিচিত্র তুলির সম্ভার। রাত বাড়তে থাকে শিবেন আর যতীশ বিভূতিভূষণের হাঁ-করা বালকটির মতো দেশ-বিদেশের গল্প শোনে। সিনেমার পোস্টার নিয়ে এতটা সম্পৃক্ততার অন্য কারণ এবং প্রেক্ষিত আছে।

বাংলা সিনেমার পোস্টার খুঁটিয়ে দেখতে শিখেছিলেন তিনি শুধুমাত্র শিল্পী বলে নয়―সিনেমার পোকা ছিলেন বলে। সুমনের জীবনে চিত্রকলা আর চলচ্চিত্রের, ছবির সঙ্গে ছায়াছবির গতায়াতও তেমনি ক্রমসারণি মেনে হয়নি। তেমনই সিনেমার সঙ্গে সখ্যের সূচনার একটি একটি পার্বিক পূর্বাপর আছে।

গঞ্জ থেকে নির্বাসনের বেদনান্তে সুমনের জীবনের সবচেয়ে ভালো সময় কেটেছিল তাঁর স্কুল পেরোবার পর-পরই বাবার কলকাতা থেকে শেষবারের মতো বদলির পর।

সাধারণভাবে মেডিক্যাল সার্ভিসে চাকরিতে প্রাচীনত্ব অর্জন করলে আর কোনো ডাক্তারকে কলকাতা ছেড়ে মফস্বলে যেতে হতো না। কিন্তু তাঁর বাবার ব্যাপারটা ছিল আলাদা। ডিপার্টমেন্টের কাছে তিনি ছিলেন ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো। তাই কোথাও কোনো গোলমালের আভাস পেলেই সেখানে পিঠ চাপড়ে ডেপুটেশনে পাঠিয়ে দেওয়া হতো তাঁকে। সরকারি নিয়ম মেনে যিনি প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন না, দশটা নার্সিংহামে দুবেলা খেপ খাটেন না, যিনি সপ্তাহে একদিন যে আসে তাকেই নিখরচায় পরামর্শ দেন, ডাক্তার হয়েও যিনি নিজের ছেলেমেয়েদের সরকার-পোষিত পাড়ার কাছাকাছির বাংলা ইস্কুলে পড়িয়েও তাদের লেখাপড়া বা প্রতিপালন করতে গিয়ে হিমশিম খান, নিজের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেন―তাঁকে তো ডাক্তার বলে মান্যতা দেওয়াই কঠিন। সুতরাং তিনি ছিলেন প্রশংসিত ও বোকা বলে সাধারণ্যে পরিজ্ঞাত সর্বজনীন অবজ্ঞাত একজন মানুষ। ফলে মধ্যবয়স পেরোবার পরও কলকাতার কাছের এক হেল্থ সেন্টারে বদলি করা হলো। অনেকেই সন্দেহ করলেন―এটা বদলি নয়, পদাবনতি। বন্ধুস্থানীয় বলে পরিচিত অনেকেই মামলা করবার পরামর্শ দিয়েছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন যে, একবার মামলা করে দিলে মামলার নিষ্পত্তি না-হওয়া পর্যন্ত একেবারে বাড়িতে বসে বেতন পাওয়া যাবে। এটা একটা মহান দেশ ন্যায়বিচারের স্বার্থে কত বছর মামলা চলবে কেউ জানে না। এইভাবেই পাওনাগণ্ডাসহ রিটায়ারমেন্টও হয়ে যেতে পারে!

বাবা সে-সব কিছুই করলেন না।

সোজা নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে কাজে যোগ দিলেন।

বড়দা আর মেজদা―দুই কৃতীপুত্রের অসন্তুষ্টিকেও তিনি গ্রাহ্য করলেন না। গ্রাহ্য করার কারণও ছিল না। কেননা, দাদারা বাংলা স্কুলে পড়ার, পাড়ার দর্জির সেলাই-করা জামা-প্যান্ট পরার প্রহসন এখনও ভোলেনি। দামি জামা-প্যান্ট না-পরালেও বাবা ওদের ছোটোবেলা থেকেই দামি দামি দেশি-বিদেশি বই কিনে, আনিয়ে দাদাদের দিয়ে গেছেন―সে-সব না-পাওয়ার বেদনাকে দূর করতে পারেনি।

বিরল ধরনের বাবা পেয়ে দাদারা ভারি দুঃখিত ছিল।

অন্য যে-কেউ হলে কলকাতা থেকে সপ্তাহে এক-দুদিন গিয়ে ঠেকনো দিয়ে চাকরি করে করে চালিয়ে দিতেন। কিন্তু তাঁর ডিএনএ-তে গোলমাল ছিল। তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল―যাতায়াত করে, অন্যমনস্ক উপেক্ষা নিয়ে কোনো কাজই করা যায় না, চিকিৎসা তো নয়ই। ফলে তিনি সেখানে কাজে যোগ দিয়ে ডাক্তারদের জন্য নির্দিষ্ট কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করলেন। অগত্যা মা আর কী করেন। ততদিনে বড়দা আর মেজদার বিয়ে হয়ে গেছে। দুই বউয়ের হাতে সংসার তুলে দিয়ে তিনিও কোয়ার্টারে থাকতে শুরু করলেন। ঝাল-মশলার বাইরের খাবার বাবা খাবেন কীভাবে! কৃতী পুত্রদ্বয় এবং পুত্রবধূদের ভাবভঙ্গি জরিপ করে তিনি আলুম-ঝালুম সুমনকে কলকাতায় বধূদের জিম্মায় রেখে যেতে ভরসা পাননি।

বস্তুত এই সময় থেকেই মায়ের নিজের সংসারের কর্তৃত্ব হারানোর শুরু। বাবার অবসরের শেষলগ্ন কলকাতায় ফিরে এলেও সেই মর্যাদা আর ফিরে পাননি মা, পেতে চানওনি। গুঁতোগুঁতি ঠেলাঠেলি করে নিজেকে জাহির করাটা ছিল তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ ব্যাপার।

তখন সুমন দাদাদের অমত ও বউদিদের নাসিকার কুঞ্চন সত্ত্বেও সদ্য আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছেন।

সুমন তো আর পড়াশোনা করেন না, আঁকার আবার কলেজ!

তাই তিনি অনায়াসে কলকাতা যাতায়াত করে আর্ট কলেজ চালাতে পেরেছিলেন।

কলকাতার কাছে এই শহরে আর কলকাতার কলেজের স্বাধীনতায় তিনি অবাধ এক জীবন পেয়েছিলেন। কলেজে ফ্রিস্টাইল ক্লাস, সারাদিন কলেজের বাইরে বাছাই করা চায়ের দোকানে চারটে-ছটা চায়ের কাপে আড্ডা, কলেজ স্ট্রীটের বইপাড়ায় চক্কর আর ধূম্রজালাচ্ছন্ন কফি হাউজের উচ্চকিত প্রতার্কিক আবহ। এসময়েই সুমন জীবনকে পেয়েছিলেন, জীবনকে চিনেছিলেন, ভালোবেসেছিলেন, ইচ্ছেডানার ঝাপটানিতে রোগা মানিব্যাগের অস্বস্তিকে কী করে উড়িয়ে দিয়ে শহরের নাট্যালয়, প্রেক্ষাগৃহ ও প্রদর্শশালাগুলিতে এঁকে দিতে হয় জীবনজয়ের পদচিহ্ন―তা শিখেছিলেন।

সারাদিন পর মধ্য-সন্ধ্যায় ড্রইং শিটের নলাকার বাণ্ডিল, মোটা স্কেচখাতার  গুরুভারসমেত ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে যখন শিয়ালদা থেকে যখন অনতি রাত্রে তাঁদের অদূর মফস্বল নগরটিতে এসে নামতেন তখন তাঁর ধমনীতে শান্তির সুবাতাস বইত। আলোকজ্জ্বল স্টেশন চত্বরের কোলাহল পেরিয়ে যখন পাতলা হয়ে আসা ছোটো ছোটো বিপণিগুলোর ঈষৎ মনমরা আলোর বিপরীতে নিজের প্রলম্বিত ছায়াকে টেনে নিয়ে ক্রমশ ইস্পাততরল অন্ধকারে প্রবেশ করতেন তখন কেন জানা নেই ছিরিছাঁদহীন সেই জনপদে রূপকথা ঘনিয়ে আসতো। স্টেশন চত্বরের থেকে নিরাপদ দূরত্বে আত্মরক্ষা করা বকুল গাছের পাশ দিয়ে ডানদিকে গড়িয়ে যাওয়া রাস্তায় পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে ‘আপনার-আপনার’ ভাবের এক সুখবোধের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে তিনি হাঁটতে থাকতেন হেল্থ সেন্টারের পেছন দিকে তাঁদের একটেরে কোয়ার্টারের দিকে।

খস্্টা-ওঠা পাঁচিলের সঙ্গে কোনোরকমে লেগে-থাকা মরচে-পড়া ডুমনির আকর্ষণে ঈষৎ ঝুলে-পড়া রেলের রেলিং-মার্কা লোহার পাতি দিয়ে তৈরি দুই পাল্লার গেটের নিচের সামনের কোণাটা মাটিতে লেগে থাকায় খুলবার সময় ঘষা খেয়ে খেয়ে অনতি গভীর বৃত্তাংশ তারি করেছে, ভালো করে সম্পূর্ণ বন্ধ করাও কষ্টকর। পাল্লাসুদ্ধু একটু ওপরে তুলে গেট বন্ধ করতে হয়। গেটের উল্টোদিকে একটা রাধাচূড়া, তার নিচে কৃষ্ণচন্দ্র ভুঁইয়া ওরফে কেষ্টদার চায়ের ঝুপড়ি। রাধাচূড়ার নিচে কেষ্ট এমন চমৎকার কম্বিনেশন সত্ত্বেও না রাধাচূড়া না দোকান, না দোকানদার ―কিছুরই কোনো আভিজাত্য ছিল না। সুমন যখন ফিরতেন, তখন কেষ্টদার দোকানের ঝাঁপ পড়ে যেত। দরমার ঝাঁপের গা ফুঁড়ে ম্লান আলোর তারকা আর তাঁদের কোয়ার্টার বাড়ির বারান্দার ডগায় লাগানো বাল্বের টিমটিমে কুহেলিকা। সামনের সংকীর্ণ রাস্তাটা ভাঙাচোরা, রাস্তার পাশে রাস্তার মতোই চওড়া ঘাসের পাড়টুকু আগলে দাঁড়িয়ে আছে পাওয়ার স্টেশনের পেল্লায় পাঁচিল। তার গায়েই রাধাচূড়া আর কেষ্টদার চায়ের দোকানের অবস্থান! কেষ্টাদারও। এই দোকানই তােদর স্বামী-স্ত্রীর আস্তানা। দোকানের ঝাঁপ পড়ে গেলেও তাই ‘দিবারাত্র খোলা থাকে’ মার্কা সার্ভিস পাওয়া যায়। এই রাস্তায় হাঁটেটা কে!

এই রাস্তার শেষে যে বড়ো রাস্তা, তার অপর পারে বাসস্ট্যান্ড। লেট লতিফরা গাড়ি-ধরার অথবা ‘বিরহী যক্ষগণ’ সপ্তাহান্তে বাস থেকে নেমে বাড়ি যাওয়ার তাড়ায় এই রাস্তায় শর্টকাট করেন। এই রাস্তার আর-একটি মুড়োয় থাকা সাব-রেজিস্ট্রার অফিসে শহরের চারপাশের হিন্টারল্যাণ্ড থেকে আসা ‘মক্কেলরূপী লক্ষ্মীগণ’ হয়রানিমূলক দীর্ঘ প্রতীক্ষার প্রহরগুলোয় এই নিজন রাস্তায় পদচারণা করার জন্যও এই রাস্তাটা এবং দু-দণ্ড বসার জন্য কেষ্টদার দোকানটাকে বেছে নেন।

সন্ধ্যের পর বাসস্ট্যান্ড ঝিমিয়ে পড়ে, নৈঃশব্দ্য গ্রাস করে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসকে―তখনও সারা দিনের মতোই পাওয়ার স্টেশনের ঠিকা মজদুরেরা কেউ কেউ ‘চা প্যাঁদাতে’ আসে কেষ্টদার কাছে। আর আসে বিজনতাপিয়াসী তরুণ-তরুণীর দল। এই একান্ত-আত্মকেন্দ্রিকতাই তাদের প্রেমের প্রধানতম বিধ্বংসী অভিজ্ঞান।

রাতে ফিরে কেষ্টদার দোকানের বাঁশের মাচা-বেঞ্চিতে বসে এক-কাপ লাল চা খেতে খেতে, বউদির ক্ষয়াটে চেহারার প্রোফাইলে প্রশান্তি লক্ষ্য করতে করতে সুমন কতবার ভেবেছেন ছবির সঙ্গে ছায়াছবি   এই ‘সুঅতীত মঘবনী উজ্জয়িনী বালা’র একটা ছবি রঙের ওপর রঙ চাপিয়ে, লাল, নীল, হলুদ এবং উজ্জ্বল মাংসল রঙে আঁকতে পারলে তা ভারতীয় মোনালিসা হতে কতক্ষণ!

কলকাতার জনারণ্যে তখন অনিন্দিতা সবে দেখা দিয়েছে।

এই রাস্তাতেই পাঁচটি-ছয়টি ডাক্তার-কোয়ার্টারের সারি। সুমনদেরটা ছাড়া বাকি সবগুলোই খালি, কেউ তাকেন না সেখানে। কলকাতা হাতের কাছে থাকতে ডাক্তারবাবুদের এখানকার এইসব ভুতুড়ে কোয়ার্টারে এসে থাকতে ভারি বয়ে গেছে। তাঁরা বেশিরভাগই দোনলা বন্দুক। স্ত্রীরাও বেশিরভাগই ডাক্তার নতুবা অন্য কোনো চাকরিতে নিযুক্ত। তাঁদের ছেলেমেয়েরা কলকাতার সব নামি স্কুলে পড়ে। সুমনের বাবা যখন কোয়ার্টারে থাকার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন, তখন তাঁর হাসপাতালের সহকর্মীরা আর সিএমওএইচ অফিসের বড়োবাবু ঝাড়া পাঁচ মিনিট তাঁর দিকে অবাক চোখে চেয়েছিলেন!

এই কোয়ার্টারটা একটু-আধটু সারিয়ে, দায়সারা করে হলেও রঙ করে দিয়েছিল কর্তৃপক্ষ। প্রথম প্রথম নতুন রঙের গন্ধ ছাপিয়ে সোঁদা, ভ্যাপসা একটা গন্ধ পাক খেয়ে বেড়াতো ঘরগুলোর আনাচে-কানাচে।

তবু এই জনপদ, এই কোয়ার্টার, কোয়ার্টারের হাতার মধ্যে পোড়ো জমিটুকু, পেছনদিকের একটা করে আম আর কাঁঠালের গাছ। প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা করে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, বসবাস ও যত্নের অভাবে কিছুটা জরাগ্রস্ত কোয়ার্টারগুলো, মায়ের হাতে বোনা লাউ ডাঁটা, লাল শাক, কাটোয়ার ডাঁটার সজীবতা, রাধাচূড়ার অকৃপণ বৈভব ভালো লেগেছিল সুমনের।

এমনিতে সারা সপ্তাহের দিন আর সন্ধ্যেগুলো কলকাতায় কাটালেও অন্তত সেই অদ্ভুত পাঁচটা বছর আকাট ছুটির দিনে সুমন এই জনপদেই ঘুরে বেড়াতেন। দু-মাইল তফাতে গঙ্গাতীরের জীবিকাজমাট বসতি, ভুটভুটি, হাতে চালানো মাছ-ধরা ডিঙি, মাঝারি সাইজের লঞ্চের চাকার জলকাকলি আর গঙ্গার দুই-পাড়ের নির্লজ্জ ইটভাটার চিমনিগুলোকে দুয়ো দিয়ে চলা পালতোলা নৌকোগুলো রেখায় রেখায় ভরিয়ে তুলতো তাঁর স্কেচের হাত-খাতাটা। শহরের পূর্বপ্রান্তের বড়ো বড়ো গাছওয়ালা প্রাচীন বড়ো রাস্তাটার ছায়ানিবিড় রূপ আঁকতে গিয়ে গাছের এত জীবন্ত ভঙ্গি, এত দেহরূপক খুঁজে পেয়েছিলেন যে তিনি আশ্চর্য হয়ে গেলেন। শতাব্দী-প্রাচীন গাছের কাণ্ডে, শাখা-প্রশাখায় ছোপ-লাগা পথপার্শ্বের দেয়ালের নিরঙ্কিত ছবির প্রতিরূপ দেখে সুমন পেয়েছিলেন অন্যতর সংবেদনের সন্ধান।

আধা-মফস্বলটিকে তাঁর ভালো লেগেছিল।

এই কৌলীন্যহীন শহরে ছিল না অনেক কিছুই কিন্তু আশ্চর্য এই যে, এখানে ছিল অজস্র নাটকের দল আর অযাচিত উপহারের মতো একটি ফিল্ম ক্লাব। আর ছিল থিয়েটার করার অযোগ্য একটি প্রদর্শন কক্ষ, শহরের  দুই-প্রান্তে দুটি এবং মধ্যস্থলে মোট তিনটি  সিনেমা হল। এই আয়োজন সুমনকে দারুণ আকর্ষণ করেছিল।

কলকাতা আর এই জনপদটির মধ্যে নিত্য গতায়াতের ফলে সুমন সে-সময় খেলাচ্ছলে বাংলা-হিন্দি-ইংরেজি নির্বিশেষে প্রায় সব সিনেমা দেখতেন। পয়সার অভাবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরাসরি লাইন দিয়ে ছ-আনা বা বড়োজোর পঁচাত্তর পয়সার টিকিটে। বািণজ্যিক ছবি কিংবা নতুন যুগের ভারতীয় সিনেমা―সবকিছু। পর পর চারদিনে তিনি কলকাতা আর তাঁর শহর মিলিয়ে এই ক্রমে খান পাঁচেক সিনেমা দেখেছিলেন হিন্দি মেরে জীবন সাথী, কলকাতা ৭১, সীতা আউর গীতা, মর্নিং শো-তে একটি টেক্সাস ছবি, নাম সম্ভবত―দি ম্যান কলড আমেন, ছিন্নপত্র! এই নির্বিচার সিনেমাখোরির জন্য সঙ্গী জুটে গিয়েছিল এই ঝাঁ ঝাঁ মফস্বলেই। ফিল্ম ক্লাবের মেম্বার হবার পর প্রদীপ্তর দেখা পাওয়াটা ছিল বন্ধুত্বের বিরাট অর্জন। কলকাতাহীন ছুটির দিনের সকালে শহরের তিনটি প্রেক্ষাগৃহের যে-কোনো একটিতে ফিল্ম ক্লাবের শো-তে একটি বা দুটি বিদেশী ছবি দেখবার পর ম্যটিনিতে ও নাইটে আরও দুটি ছবি ছবি―সে এক চূড়ান্ত পাগলামি! সপ্তাহে দিন-দুই প্রদীপ্ত কলকাতায় গিয়ে আর্ট কলেজে থেকে তাঁকে ছিনতাই করে সিনেমা হলে ঢুকে পড়েছে। বাছবিচার তো ছিল না, সুতরাং একটা সিনেমা পেলেই হলো। দেখতে গেলেন জনি মেরা নাম, টিকিটের মারামারি, অদূরে অার-একটি হলে চলছে হীরাপান্না বা রাজা জানি। এই হল থেকে প্রায় দৌড়ে সেই হলে। এমন-কী বৈশাখের দারুণ দহন দিনে গরম থেকে বাঁচতে তিনবারের দেখা কিংবা চূড়ান্ত বাসি সিনেমা চললেও হাতের সামনে যে হল পেয়েছেন সেখানেই ঢুকে পড়েছেন দুই বন্ধু! প্রদীপ্ত পয়সাওয়ালা ঘরের ছেলে―লেখাপড়ায় তুখোড়, রসবোধে পরিণত। পকেটে পয়সা আর চওড়া হৃদয় প্রদীপ্তকে বিরল প্রজাতির প্রাণীতে পরিণত করেছিল। বিশ্বের যত বিখ্যাত ছবি ঐ ফিল্ম ক্লাবের মর্নিং শো-তে দেখেছেন সুমন প্রদীপ্তর পাশে বসে। মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, তপন সিংহ বা তরুণ মজুমদার প্রমুখের ছবি না-দেখাকে প্রদীপ্ত অবরাধ বলে মনে করত। শ্যাম বেনেগাল, গোবিন্দ নিহালনি প্রমুখ তো বটেই হৃষিকেশ মুখার্জী বা বাসু চ্যাটার্জীদের মতো পরিচালকদের সিনেমা না-দেখাকে প্রদীপ্ত অশিক্ষার লক্ষণ বলে চিহ্নিত করেছিল। সব সময়েই তাঁরা দুই বন্ধু ছবি শুরুর আগে বা ইন্টারভ্যালের সময় হলের লবিতে টাঙানো ছবি, পোস্টার ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করতেন। মুখ্যত প্রদীপ্তর সান্নিধ্যই সুমনকে অবাণিজ্যিক বা ভারতীয় নিউ ওয়েভ সিনেমা দেখার চোখ দিয়েছিল। জীবনের সীমাহীন আবেগ ও অভীপ্সাকে চিনতে শিখিয়েছিল।

ফিল্ম ক্লাবে প্রত্যেক রবিবার শো-র আগে সিনেমা হলের সংকীর্ণ লবিতে সেদিনের সিনেমার স্থিরচিত্র ও পোস্টার প্রদর্শন করা হতো। সত্যি কথা বলতে গেলে আর্ট কলেজে গ্রাফিক আর্টের পাঠক্রম থেকে নয়, ―এই এই সমস্ত পোস্টার দেখেই পোস্টারের উদ্দেশ্যমূলকতা ও উপযোগিতার অন্তরালে ক্রিয়াশীল শিল্পসফলতার সম্ভাবনাকে দেখতে পেয়েছিলেন সুমন।

চার্লি চ্যাপলিনের রেট্রোস্পেকটিভ অথবা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত ইটালির পটভূমিতে আলবার্তো মোরাভিয়ার লেখা কাহিনী অবলম্বনে ভিত্তোরিও ডি সিকা পরিচালিত ও সোফিয়া লরেন এবং এলিওনোরা ব্রাউন অভিনীত ইতালীয় ছবি ‘টু উইমেন’-এর মতো সিনেমা সুমন দেখতে পেয়েছিলেন। আরও কত কত বিখ্যাত ছায়াছবি আর তার পোস্টার তাঁকে বিস্ময়বিমূঢ় করেছিল―আজ শিবেন-যতীশকে সেই গল্প বলার সময় দেখলেন সেসবের পরম্পরার সবটা আজ আর পুনঃসংগ্রহ করাও কঠিন। যতদূর মনে আছে―এক রবিবার সকালে ফিল্ম ক্লাবে দেখেছিলেন একটি ছবি― ‘কঙ্কয়ার্স অব দি গোল্ডেন সিটি’ বা এই জাতীয় কিছু একটা নাম। ছবিটি সম্ভবত ছিল টার্কিশ। ভাই-বোন সমন্বিত একটি গ্রামীণ পরিবার সুখ, সমৃদ্ধির স্বপ্ন নিয়ে রাজধানীর মতো কসমোপলিটন শহরে চলে আসে। কিন্তু নগরজীবন, তার নাগর-সংস্কৃতি, প্রাচুর্যের আড়লে লোভের বীজ, কীটজ কুসুমের মতো জীবনের বিনষ্টি―এসবের ঘাতকতায় পরিবারটি বিপন্ন হয়। এই ছবিটির আর কিছুই খেয়াল নেই সুমনের। কিন্তু হলের লবিতে এই ছবিটির যে পোস্টার প্রদর্শিত হয়েছিল তাতে ঐ পরিবারের একটি মেয়ের প্রায় অচৈতন্য ও মুহ্যমান শরীরের একটি ছবি ছিল। সেই ছবিতে মেয়েটির বিস্ফারিত মুখাবয়বে ফুটে-ওঠা প্রতারিত-বিপন্নতাকে অতি উৎকৃষ্ট চিত্রকলা বলে মনে হয়েছিল সুমনের। মোনালিসার স্মিততার বিপরীতে মেয়েটির মুখের প্রতারিত-বিস্ফারের প্রকাশ―মানুষী পৃথিবীর চিরকালীন অসুখের মতো। ছবিটি যদি ক্যানভাসের ওপর তেল রঙ দিয়ে যত্ন করে আঁকা হতো, যথাযথ মাউন্টিং করা থাকত আর প্রজ্ঞাপনের জন্য ব্যবহৃত টেক্সটগুলিকে বর্জন করা হতো, তাহলে এই পোস্টারটিকেও একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ উৎকৃষ্ট চিত্রকলার উদাহরণ হিসেবে মান্যতা দিতেই হতো। ‘টু উইমেন’ সিনেমার যে পোস্টারটি লবিতে টাঙানো হয়েছিল সেটিকেও গভীর মনোযোগের সঙ্গে লক্ষ্য করছিলেন সুমন। পোস্টারে সিনেমাটির একটি দৃশ্যের ফটোগ্রাফ ব্যবহার করা হয়েছিল। সামনে নির্যাতিতা মায়ের (সোফিয়া লরেন) ক্রন্দনরত বিধ্বস্ততা আর পেছনে একটু দূরে পিছন-ফেরানো শীতল পরিচ্ছন্নতার খোঁজে নির্যাতিতা কন্যা (এলিওনোরা ব্রাউন)। পোস্টারটিতে ফটোগ্রাফ ব্যবহৃত হলেও এবং শিল্পকর্মের সুযোগ কম থাকলেও শুধুমাত্র বিষয়ের ইঙ্গিতপূর্ণ বিন্যাসের কারণে এটা অসামান্য শিল্পবস্তু হয়ে ওঠে। সৈন্যদের হাতে অত্যাচারিত মা ও মেয়ের পরস্পরের পেছন ফেরা মূর্তি অত্যাচার-পরবর্তী সময়ে মা-মেয়ের মানসিক বিচ্ছেেদর প্রতীক হয়ে থাকে। অত্যাচারের ফলে বালিকা কন্যাটির অমল শৈশব সহসা যেন তরুতলে দলিত কদম্বের মতো পুতিগন্ধময় লোভদগ্ধ জীবনের কঠিনতম শিক্ষা হয়ে দেখা দেয়। পোস্টারটিতে শিরোনামের সঙ্গেই সমান গুরুত্ব দিয়ে বড়ো হরফে একেবারে প্রথমেই সোফিয়া লরেনের দেওয়া হয়েছে, আর পোস্টারের নিচে একইভাবে প্রযোজক কার্লো পন্টি এবং পরিচালক ভিত্তোরিও ডি সিকার নাম। সোফিয়া লোরেনের অকাদেমি-জয়ী অসামান্য অভিনয় যে এই ছবির সাফল্যের অন্যতম প্রাথমিক শর্ত ছিল তাতে, কোনো সন্দেহই থাকতে পারে না।

(ক্রমশ)

…………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply