অকূলের কাল। পর্ব ২৩। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

প্রেম যুদ্ধ

সরস্বতী পূজার বিশেষ ভ্রমণের পরে তাদের সম্পর্ক কি আরও একটু গাঢ় হলো? পরের দিন সন্ধেবেলাতেই ফোন করেছে দোলন। হাসির প্রাবল্য কমেছে। কথাও শুনছে বেশি, বলছে কম। একবার বলল, – কাল ফিরে এসে সারা রাত ঘুমোতে পারেনি।

–কেন? সমর কি কিছু বলেছে বাড়িতে?

–দূর! গণেশ ব্যাটা আবার বলবে কী! ও নিজে কি কম বদমাশ নাকি! দুপুর বেলায় বাড়ি যখন ফাঁকা তখন দোতলার ঘরে মেয়ে বন্ধু নিয়ে আসে। পয়সা দিয়ে বাহাদুরকে হাত করেছে। আবার মদও খেতে শিখেছে। খুব বাজে হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।

–গণেশ মানে সমর?

–হ্যাঁ, ওর বাড়ির নাম। তবে আমাকে সব বলে। একদিন তোমার সঙ্গে আলাপ করবে বলেছে। আমাকে বলছিল, বাজে ছেলে নয় তো? তোকে বিয়ে করবে? এই শোনো না – তোমার চাকরি পেতে কতদিন সময় লাগবে? বাড়ি থেকে তো দেবে না। তোমার চাকরি হলেই বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে নেব।

ক্ষিতি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। বলে, – কি জানি! তবে পার্ট ওয়ানটা হয়ে গেলেই পিএসসি-র ক্লার্কশিপ পরীক্ষায় বসব। আমি তো বাংলা ইংরাজি অঙ্ক – তিনটেতেই খারাপ নই। পড়াশুনাও করতে লাগবে না। পেয়ে যাব মনে হয়। আর তোমার পড়াশুনার খবর কী? পরের বছরই তো এইচ এস ফাইনাল। ফাঁকি একটু কম দাও এখন থেকে। ভালোভাবে পাশ করতে না পারলে বিয়ে করব না কিন্তু।

–ঈ-ই শ! ভারী আমার আবদার রে! তোমাকে তো আগেই বলে দিয়েছি আমার পড়াশুনা করতে ভাল লাগে না। তোমার সঙ্গে এইসব হওয়ার পর আরও ভাল লাগছে না। যা হয়েছে অনেক। তুমি চাকরি করবে আর আমি তোমার সেবা করব – স-ব রকম।

–কী-সব বস্তাপচা আইডিয়া! তোমাদের এত টাকাপয়সা – অথচ বাড়িতে পড়াশুনার কোনো চলই নেই দেখছি।

–বাড়িতে নেই তো কী হয়েছে – মামাবাড়িতে তো আছে। মামারা সবাই শিক্ষিত। দুই মামা রেলে বড় চাকরি করত। এখন অবশ্য ছেড়ে দিয়ে রেলের কন্ট্রাক্টরি করে। এক মামাতো দাদা মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ছে।

ক্ষিতি এই নিয়ে আর কথা বাড়ায় না। বলে, – গান প্র্যাকটিস করছ রোজ?

–রোজ নয়, যেদিন গানের মাস্টারমশায় আসে সেদিন করি। এই – তুমি সব ব্যাপারে মাস্টারি করবে না তো!

নাঃ! অসম্ভব একে নিজের জায়গা থেকে নড়ানো। ক্ষিতি হাল ছেড়ে দিল সেদিনকার মতো।

পার্ট ওয়ান পরীক্ষা শেষ হলো। এমন  অস্বাভাবিক পরিস্থিতির মধ্যে কখনও পরীক্ষা দিতে হবে ভাবেনি ক্ষিতি। অবাধে টোকাটুকি চলেছে। ক্ষিতির নোট মুখস্থ করার অভ্যেস নেই, নিজের মতো করে সংক্ষিপ্ত উত্তর লিখতেই অভ্যস্ত। কিন্তু হলের পরিস্থিতিতে লেখায় মনঃসংযোগ করতেই পারছিল না। দুটো পেপার হয়ে যাওয়ার পর সে দোলাচলে পড়ে গেল। সেও কি তাহলে টোকাটুকি করবে? অজয় বলল, – বোকামি করো না ক্ষিতি, সবাই ভালো ভালো নোট নামিয়ে দিচ্ছে খাতায়। সেসব দেখার পর তোমার সাদামাটা উত্তর পড়ে এগ্‌জামিনারের হাত থেকে কি মার্কস গলবে! শেষে হয়তো অনার্স মার্কসটাও হবে না। বাকি দুটো পেপারে জগাখিচুড়ি পাকাল ক্ষিতি। নোট টুকতে গিয়ে এমনই দেরি হচ্ছে যে আধাআধি হয়ে যাওয়ার পর ধৈর্য হারিয়ে নিজের ভাষায় শেষ করতে লাগল। পাসের তিনটা পেপার – বাংলা, ফিলজফি আর অতিরিক্ত ইংরাজি – অন্যের কথায় কর্ণপাত না করে নিজের মতো করে লিখে এল।

খুব অনিয়মিত হলেও ডাইরি লেখে ক্ষিতি, বিশেষ বিশেষ ঘটনা ঘটে যেদিন। পরীক্ষাশেষে এসব কথাই আধ পাতা জুড়ে লিখে রাখল ক্ষিতি।

পরীক্ষার ফল বেরোলে দেখা গেল অজয়ের অনুমান ভুল। পরীক্ষকের চোখ যা দেখার ঠিকই দেখে ফেলেছে। সকলেরই নম্বর কাছাকাছি – শতকরা চল্লিশ থেকে তেতাল্লিশ। ক্ষিতি টায়েটুয়ে চল্লিশ। কে জানে সবটা নিজের মতো লিখলে খানিক বেশি হতো কিনা! সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা – নেশায় ডুবে থাকা সত্ত্বেও মলয় এই বাজারেও রেকর্ড নম্বর পেয়েছে। ক্ষিতি নিশ্চিত, সে টোকাটুকির ধারেকাছেও ছিল না। তাছাড়া বিদ্যাসাগর কলেজের মতো অবাধে টুকলি সব কলেজে হয়নি। তাছাড়া বিষয়টাও বিজ্ঞান – বুনিয়াদি জ্ঞান ছাড়া অধ্যাপকের নোটের ভরসায় খুব বেশিদূর ওঠা যায় না।

 

পাকিস্তানের নির্বাচন নিয়ে দুলাল খুব উত্তেজিত হয়ে থাকে। সে মুজিবের আওয়ামী লিগের ভীষণ ভক্ত। পাশের দেশের নির্বাচন নিয়ে হস্টেলের অন্যদের তেমন আগ্রহ ছিল না। এই হস্টেলে দুলাল ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের কেউ নেই। এমন কি সেখান থেকে চলে এসে এই বাংলায় স্থায়ী হওয়া – যাদেরকে বাঙাল বলা হয় – তাদেরও কেউ নেই। বেশির ভাগই পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চলের আদি বাসিন্দা। পূর্ব বাংলা নিয়ে তারা ভাবিত নয়।

নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের সব আসনেই জয়ী হয়েছে মুজিবের দল। আর পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় সব আসনে ভুট্টোর দল। দুই দিক মিলিয়ে আওয়ামী লিগের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা। মুজিবকেই পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলাই সংবিধানসম্মত হতো কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নানা অজুহাতে টালাবাহানা করে চলেছেন। একাত্তরের সাতই মার্চ এক জনসভায় বাংলার জনগণকে মুজিব সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত থাকার ডাক দিলেন। তাঁর সেই বক্তৃতা কলকাতা বেতার থেকে প্রচারিত হলো। দুলালের সঙ্গে প্রায় সবাই হস্টেলের রেডিওতে সেই ভাষণ শুনল। শুনতে শুনতে সকলের রোম খাড়া হয়ে গেল। বাংলার নামে ধীরে ধীরে এই বঙ্গের বাঙাল-অবাঙ্গাল সবাই ভাষাবন্ধনের আবেগে একাত্ম হয়ে উঠতে লাগল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেষ আলোচনা ছিল। সেদিন দুলাল উত্তেজিত হয়ে এসে জানাল, – হারামিটা মুজিবের দাবি মানেনি। আলোচনা ভেস্তে গেছে। পুব বাংলার জনগণের উপরে মিলিটারি লেলিয়ে দিয়েছে।

এরপর থেকে বিষয়টা কেবল দুলালেরই থাকল না, হস্টেলের প্রায় সকলের মনোযোগ স্থির হলো খবরের কাগজে আর রেডিওতে পুব বাংলার খবরে। মুজিবনগরে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে ‘বাংলাদেশ’ নামে এক নতুন দেশ জন্ম নিল। পাক মিলিটারি মুজিবকে বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোথায় নিয়ে গিয়ে আটকে রেখেছে তার হদিশ নেই। এখানে বাংলাদেশের জনগণের উপরে আরম্ভ হয়েছে অমানুষিক অত্যাচার। খবর শুনে মনে হয় অবাধে লুটপাট, ধর্ষণসহ গণহত্যা চলছে সেখানে। মুক্তিযোদ্ধারা যথাসাধ্য লড়ছে। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে শরণার্থীরা দলে দলে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে এসে আশ্রয় নিচ্ছে। ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত অঞ্চলে শয়ে শয়ে শরণার্থী শিবির খুলেছে। জনগণও স্বতঃস্ফূর্ত সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন বাংলাদেশের জন্য সমর্থন জোগাড় করতে। পাকিস্তানের বন্ধু আমেরিকার রক্তচক্ষু অগ্রাহ্য করে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে বন্ধুত্বের শক্ত বন্ধন গড়ে তুলেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের সক্রিয়ভাবে সাহায্য করছেন। সমস্ত বিরোধী দল তাঁর পাশে দাঁড়িয়েছে। সংবাদ বিশেষজ্ঞরা বলছেন এই অকুতোভয় মহিলা পাকিস্তানের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধে নেমে পড়তে পারেন।

সাধারণ ছাত্রদের মধ্যে নকশাল আন্দোলনের প্রভাব এখন পিছনের সারিতে চলে গেছে। তাদের কাছে মুজিবর রহমান আর ইন্দিরা গান্ধিই এখন স্বাধীনতার ফরিস্তা। কংগ্রেসি ছাত্ররা তো বটেই, সি পি আই-পন্থীরাও ইন্দিরাকে ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ আখ্যা দিয়ে পোস্টার লিখছে। অনেক ছাত্রও নাকি মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে গোপনে সীমান্ত পারাপার করছে। তরুণ সান্যাল বিশাল ছাত্রমিছিল নিয়ে পাকিস্তান দূতাবাসে অভিযান চালিয়ে দাবিসহ স্মারকলিপি জমা দিলেন। সেই ছাত্রমিছিলে স্কটিশের হস্টেলের ছেলেরা সামনের সারিতে। ক্ষিতির ব্র্যাকেটের প্রায় সবাই গলার শিরা ফুলিয়ে স্লোগান দিতে দিতে সেই মিছিলে হেঁটে এল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply