সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৭। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

তিব্বতি বৌদ্ধপন্থা, নেপালি থেরাবাদ ও মহাপ্রজ্ঞাকথা

মূল হিমালয়ের বেষ্টনীর মধ্যে বাস করতেন যে সব পাহাড়ি মানুষ, হিমালয়ের ওপারের তিব্বতে যে নতুন বৌদ্ধপন্থা তৈরি হয়ে উঠলো, তাঁরাও তাতে বিশ্বাসী হয়ে উঠলেন দ্রুত। তিব্বতি বৌদ্ধধর্মকে লামাবাদ বলেও ডাকা হতো। যদিও ধর্ম হিসেবে লামাবাদ বিষয়টা খুব সমসত্ব ছিলো না, তিব্বত, তিব্বত লাগোয়া ভুটান সিকিম নেপাল, পশ্চিমে লাদাখ স্পিতি লাহুল, এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অধিবাসীরা হুবহু একই ধর্ম পালনও করতেন না, বাইরের থেকে আসা সাহেবদের চোখে সম্ভবত গোটা ব্যাপারটা এক রকমই ঠেকতো: বিশাল বিশাল গুম্ফা, নানান চেহারার বিপুলাকার বৌদ্ধ মূর্তি, গুম্ফার ভিতরের দেয়ালে, ছাদে জমকালো রঙদার ছবি, চিনা রেশমে সুতো বুনে কি মোটা তুলোট কাগজে রং ফেলে তৈরি করা থাংকা, মঠের মধ্যের আলো আবছায়ায় জ্বলতেই থাকা সার সার মাখনের প্রদীপ, শ্রেণীবদ্ধ, পা মুড়ে বসা ছোট বড় লামাদের সামনে খুলে রাখা প্রাচীন তিব্বতি পুঁথি, তাঁদের যৌথ মন্ত্রপাঠ, গম্ভীর গংয়ের আওয়াজ, ঘণ্টাধ্বনি, বহু রকমের বাঁশি, ঢাক ইত্যাদির মন্দ্র কলরব, পালা পার্বণে ঝলমলে রঙিন মুখোশনাচ। বাইরে থেকে দেখা ছবিগুলো একরকম, সুতরাং ধর্মটারও একটা নাম হয়ে গেলো: তিব্বতি বৌদ্ধপন্থা, ওরফে লামাবাদ।

ছবির জগত পেরিয়ে ও রহস্যময়(বা এক্সটিক) গূঢ় ধর্মাচারের জটিল আবর্তে প্রবেশ করে, লামাবাদ এবং তার ভিতরকার বিভিন্ন বৌদ্ধমতের বিষয়ে মনোজ্ঞ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন মেজর এল এ ওয়াডেল, যার কথা সময়ভ্রমণে ইতিপূর্বে এসেছে। আরো লেখা ও লেখকের কথাও আসবে, তবে এক্ষুনি নয়। এখন যেটুকু বলার, লামাবাদের মধ্যে আদি বৌদ্ধবাদ যতটা, তন্ত্র ও আদি বং ধর্ম ততটাই, কোথাও হয়তো আরো বেশি। তিব্বতের পুরো এলাকা ও তৎসংলগ্ন হিমালয়ের সবর্ত্র এই যে নতুন মিশ্র ধর্মমতের প্রচলন হলো, তার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা দিলো, দ্রুত গেঁড়ে বসলো, ধর্ম(অর্থে লামা)প্রধান শাসনতন্ত্র, অর্থে নদীপাহাড়, পশুপাখি, জমিজমা, মানুষের শ্রম ও জীবনের ওপর লামা অর্থাৎ ধর্মগুরুদের একচ্ছত্র নিরঙ্কুশ আধিপত্য। কালক্রমে ধর্মপন্থা বদলালো, পুরোনোপন্থী ‘লালটুপি’ নিংমাপাদের সরিয়ে তিব্বতের শাসন চলে গেলো সংস্কারবাদী ‘হলুদটুপি’ গেলুকপাদের কাছে। এই সমস্তটাই অনেক অনেক দিন আগেকার কথা, তিব্বত ও হিমালয় জুড়ে গত একশো-দুশো বছরে যে সব নতুন জাতিরাষ্ট্র মাথা তুলেছে, তাদের দাপটে লামাশাসনের সে পরাক্রম নেই। না থাকলেও, লামাবাদ বিষয়টা নিশ্চিহ্ন হয়নি, লামারাও একেবারে হীনবল হয়ে পড়েননি। হিমালয় অঞ্চলের গত ষাট-সত্তর বছরের ইতিহাসে তিব্বতের বড় লামাদের—যথা দলাই লামা ও পাঞ্চেন লামা—এঁদের ভূমিকা ও গুরুত্বের কথা স্মরণ রাখলেই তা দিব্য বোঝা যায়। হলুদ ও লাল ছাড়াও লামাবাদীদের আরো দু তিন টুকরো আছে, কিন্তু সে গল্প এখানে নয়।

গেলনার ও লেভিনের গবেষণাকাজ থেকে জানা যাচ্ছে, জন্মসূত্রে হিন্দু পরিবারের সন্তান প্রেম বাহাদুর ওরফে মহাপ্রজ্ঞার বৌদ্ধ ধর্মে হাতেখড়ি লামাবাদ দিয়ে। বিশ শতকের গোড়ায় প্রেমের পরিবার ভক্তপুর থেকে কাঠমান্ডু এসে ডেরা বাঁধছেন, কিশোর প্রেম বাহাদুরের মন কিছুতেই বসছে না, না অর্থকরী কাজকর্মে, না অন্য কিছুতে। সেসময় তাঁকে ডাকা হতো নানি কাজি বলে(নানি মানে ছোট, এবং স্থানকালভেদে, ‘কাজি’ শব্দের বহুবিধ অর্থ হতে পারে, সম্ভবত এখানে ‘হোমরাচোমরা’ গোছের কেউ বোঝানো হয়েছে)। সে যা হোক, নানি কাজির হাবভাব তাঁর বাবামা বিপন্ন বোধ করলেন, খুব অল্প বয়সেই তাঁর বিয়ে দেওয়া হলো। যার সঙ্গে বিয়েটা হলো, যে কোন কারণেই হোক, তাঁকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হলো। নানি কাজি ইতিমধ্যে দ্বিতীয় একটি মেয়ের সঙ্গে থাকতে শুরু করেছেন (নেপালের অধিবাসীদের মধ্যে বহুবিবাহের ব্যাপক প্রচলন ছিলো)। যেহেতু সে জাতে ছোটো, তার হাতের রান্না খাওয়া যায় না, সুতরাং নানি কাজিকে আর একটা বিয়ে করে ফেলতে হলো। লেভিন ও গেলনার বলছেন, এর ফলে সংসারে বিস্তর অশান্তি শুরু হলো, যেমন হয়। ওদিকে, নানি কাজির মন সংসারে কিছুতেই বসে না, দর্জির কাজ শিখেছেন বটে, কিন্তু এসব কাজটাজ করতে ইচ্ছে করে না। বরং তাঁর আগ্রহ গানবাজনায়, বিশেষ ধর্মসংগীতে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply