অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ২২। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

পাঁচ : সিনেমার পোস্টারের পশ্চিমী পরিসর      

বাংলা তথা ভারতীয় পোস্টার-শিল্পের একটা বড়ো পরিসর―সিনেমার পোস্টার। চলচ্চিত্র যেহেতু নিজেই অর্বাচীন সেহেতু তার প্রচারণার জন্য প্রস্তুত পোস্টারের বয়সও বেশি নয়। সম্ভবত ১৮৯০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শর্ট ফিল্ম ‘প্রোজেকশন আর্টিস্টিক্যুইস’-এর জন্য জুল চেরেটের তৈরি পোস্টারটিই প্রথম মুভি পোস্টার। (পোস্টার কালেক্টর : ২০১৫) লিথোগ্রাফিক এই পোস্টারে একটি অল্পবয়স্ক, বালিকাই বলা যায়, একটি পোস্টার ধরে দাঁড়িয়ে আছে, যেখানে মুভিশো-এর সময় নির্দেশ আছে। ১৮৯০-এর সময়ে লিথোগ্রাফিক পোস্টার সহজলভ্য হওয়ায়  প্যারিসের দেয়ালগুলি পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল। সাইকেল থেকে শুরু করে মদ ও অন্যান্য পানীয়র বিজ্ঞাপন, কনিয়াক থেকে শুরু করে সার্কাস প্রদর্শনী―সবকিছু ছিল।

খ্যাতনামা চলচ্চিত্র পরিচালকেরা তাঁদের সিনেমার পোস্টার নিয়ে চিরকালই সংবেদনশীল-সতর্কতা অবলম্বন করে এসেছেন। ইউরোপ ও আমেরিকায় এমন উদাহরণ কম নয় যেখানে পোস্টারই সংশ্লিষ্ট মুভিটির আইকনিক মার্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু মডার্ন টাইমস-এর পোস্টার ছিল সর্বার্থেই স্বতন্ত্র। পোস্টারে ছবির ‘দি ট্রাম্প’( লিটল ট্রাম্প নামেও পরিচিত) চরিত্রের সাজে চ্যাপলিনের উপস্থিতি তাঁর সিনেম্যাটিক মুক্তিই শুধু নয় একেবারে আইকনোগ্রাফিক আবির্ভাব। মডার্ন টাইমস সিনেমার আইকনিক পোস্টারগুলির ডিজাইন করেছিল ওকলাহোমা সিটির লিডার প্রেস নামক প্রতিষ্ঠান। লিডার প্রেস তখন পোস্টার ডিজাইন, মুদ্রণ ও বিতরণের কাজ করত। মডার্ন টাইমস সিনেমার পোস্টারগুলোর ডিজাইন কে করেছিলেন তা আমরা জানতে না-পারলেও ছবির খ্যাতির সঙ্গেই গ্রাফিক দক্ষতার নজির হিসেবে পোস্টারগুলিও বিখ্যাত হয়ে আছে। চার্লি চ্যাপলিনের প্রায় সব ছবির পোস্টারেই সংশ্লিষ্ট চরিত্রের সাজে চ্যাপলিনের ছবি দেখা যায়, এটাই হয়তো সেকালের মুভি দর্শকদের কাছে ব্র্যান্ড-সাইন ছিল। লক্ষ্য করতে হবে মডার্ন টাইমস-এর ১৯৩৬ সালের এই পোস্টারে চার্লির সিগনেচার চরিত্র সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে। হরফসজ্জায় সিনেমাটির নামের তুলনায় তাঁর নামের ফন্ট-সাইজ প্রায় চারগুণ বড়ো! চ্যাপলিনের এমন অনেক ছবিরই পোস্টার ডিজাইনারের নাম সহজে জানা যায় না। মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের নামে এমন সফল ডিজাইনের আরও উদাহরণ আছে চলচ্চিত্র-সংসারে। কিন্তু ফরাসি গ্রাফিক ডিজাইনার ও শিল্পী লিও কাউপার (?কুপার ১৯২৬-২০২১) ১৯৫০-এর দশকে ফরাসি ভাষায় চ্যাপলিনের ছবিগুলির পোস্টার রচনা করে অকল্পনীয় খ্যাতি অর্জন করেন।

ফরাসি চলচ্চিত্রকার জাঁ-লুক-গোদার (১৯৩০-২০২২)-এর সিনেমার জন্য প্রস্তুত পোস্টারগুলিও সর্বকালের সেরাদের মধ্যে গণ্য হয়ে থাকে। যেমন : কেমেন্ট হুরেল (১৯-২৭-২০০৮)-এর করা গোদারের ‘ব্রিদ্্লেস’ সিনেমার পোস্টার, জ্যাক (জ্যাকুইস) ভাইসারের তৈরি ‘ভিয়ের সা ভিয়ে’ (লিভিং  হিজ লাইফ / তার জীবনযাপন),  জর্জেস কারফাইসার-এর ডিজাইনে ‘ব্যান্ড অ্যা পার্ট’ এবং ‘উনে ফেমে মেরি’ (এ ম্যারেড উম্যান), রেনে ফেরাচ্চি (১৯২৭-১৯৮২)-এর করা গোদারের ‘মেড ইন ইউএসএ’ ছবির পোস্টার ইত্যাদি। ১৯৭০-এর দশকে এসে গোদার প্রচলিত চলচ্চিত্র পরিবেশনের ধারা প্রায় পরিত্যাগ করেছিলেন। ফলে এসময় গোদারের ছবির প্রচারমূলক পোস্টারের সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়।

পাশ্চাত্য দেশগুলিতে সিনেমার পোস্টারের নকশা তৈরি করার কাজে অগণন লিখিয়ে, শিল্পী ও গ্রাফিক আর্টিস্টের যোগদান আছে। সাধারণভাবে সিনেমার পোস্টার থেকে তার ডিজাইনারের নাম জানা যায় না। শিল্পীর নাম গোপনেই থেকে যায়। পুনরুৎপাদিত হাজার হাজার পোস্টারে শিল্পী বা নকশাকারকের নামের স্বাক্ষর থাকলে সেটাকে ব্যতিক্রম বলেই মনে করা হয়। কিন্তু এই সব পোস্টারের অনেকগুলিতেই উচ্চাঙ্গের শিল্পক্ষমতার প্রকাশ ঘটে―সিনেমার বিষয় ও প্রকাশভঙ্গি অনুসারে ডিসকোর্সের নির্মাণ, হরফ নির্বাচনে বিষয় ও বয়ানের প্রতি বিশ্বস্ততা, সম্ভাব্য দর্শকের কাছে সিনেমাটির কোন অভ্যন্তরবস্তু আকর্ষণীয় হলে তাঁরা প্রেক্ষাগৃহে ভিড় জমাতে পারেন―সে-বিষয়টি নির্ধারণ ও পোস্টারের মধ্যে তার সার্থক প্রকাশ ঘটেছে। রেখায়, লেখায়, বয়ানে, ভাষ্যে, রঙের বন্টনে, সামগ্রিক নকশায় মহান চলচ্চিত্রের সঙ্গে তার সুপরিকল্পিত পোস্টারের বিলক্ষণ সম্বন্ধ আছে। এই বিন্যাসে কোন অংশটা বেশি গুরুত্ব পাবে মুখ্যত তা কেন্দ্রিত হয় কী কী পোস্টারে উল্লেখ করলে লক্ষিত-দর্শকেরা বেশি আকৃষ্ট হবেন― সেই অনুমানের নিরিখটিতে।

পাশ্চাত্যে সিনেমার পোস্টার বিষয়েও চর্চার একটি প্রসারিত ব্যাপ্তি আছে। সেখানে হিস্ট্রি অব মুভি পোস্টার বা সিনেমার পোস্টারের ইতিহাস-বিষয়ে অজস্র রচনা ও ভাষ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। সেখানে অনুসন্ধান করলে মুভি পোস্টারের নকশাকারক, নির্মাতা তথা শিল্পীদের সম্বন্ধেও কিছু তথ্য জানা যেতে পারে। সেখানে চলচ্চিত্রের ইতিহাসের সন্ধানী অনেকেই নিজেদের মতো করে সর্বকালের সেরা পোস্টারের নির্বাচন করেছেন। সেই সব অগণিত তালিকার মধ্যে স্থান পেয়েছে― ভিক্টর ফ্লেমিং, জর্জ কুকর ও স্যাম উড পরিচালিত বিতর্কিত ছবি ‘গন উইথ দি উইন্ড’-এর রজার সাউবির আঁকা পোস্টার (১৯৩৯); নাথান হার্টজ় নির্দেশিত ১৯৫৮ সালের ছবি ‘অ্যাটাক অব দি ৫০ফিট উম্যান’-এর  রেনল্ড ব্রাউনকৃত পোস্টার ; সল ব্যাসকৃত অটো প্রিমিংগার নির্দেশিত ছবি ‘অ্যানাটমি অব এ মার্ডার’ (১৯৫৯) ছবির পোস্টার ; নাসা স্পেস আর্টিস্ট হিসেবে খ্যাত রবার্ট থিয়োডর ম্যাককল (১৯১৯-২০১০)-এর ‘২০০১ : এ স্পেস ওডিসি’ ; টেরি গিলিয়ামের ‘ব্রাজ়িল (১৯৮৫)’ সিনেমার জন্য বিল গারল্যান্ডের আঁকা পোস্টার ; রিচার্ড আমসেলের তৈরি স্টিভেন স্পিলবার্গ নির্দেশিত ‘রেইডার্স অব দি লস্ট আর্ক (১৮৮১)’ ; উডি অ্যালেন পরিচালিত ‘ম্যানহাট্টান (১৯৭৯)’ চলচ্চিত্রের জন্য বার্ট ক্লীগারের আঁকা পোস্টার ; ১৯২৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ফ্রিট্্জ় ল্যাং পরিচালিত ছবি ‘মেট্রোপলিস’-এর জার্মান গ্রাফিক আর্টিস্ট হাইঞ্জ শুল্‌জ-নিউডাম দ্বারা ডিজাইনকৃত পোস্টার ; ২০০১ সালে  মুুক্তিপ্রাপ্ত ‘হ্যারি পটার অ্যান্ড দ্য সর্সারার্স স্টোন’ ছবির ড্রু স্ট্রুজ়ান-এর ডিজাইনে করা পোস্টার ; বিল গারল্যান্ড-এর করা টিম বার্টন নির্দেশিত সুপার হিট ছবি ‘ব্যাটম্যান’ (১৯৮৯)-এর পোস্টার ; রিডলে স্কট পরিচালিত ছবি  ‘ব্লেড রানার’ (১৯৮২)-এর জন আলভিনের ডিজাইন করা পোস্টার ; টম জুং-এর করা ‘স্টার ওয়ারস্’ ছবির পোস্টার ; স্টিভেন স্পিলবার্গের বিখ্যাত ছবি ‘জুরাসিক পার্ক’-এর জন আলভিনকৃত পোস্টার ; রোমান পোলনস্কির ‘চায়না টাউন’ (১৯৭৪) ছবির জিম পিয়ারসল-এর আঁকা পোস্টার ; স্টিভেন স্পিলবার্গের কিংবদন্তি ছবি ‘জ়স’-এর রজার কাস্টেলকৃত পোস্টার ইত্যাদি। এই তালিকাটি জ়াচারি মোজার প্রণীত।  এমন বহু তালিকা পাওয়া যাবে, কোনো তালিকার সঙ্গে অন্য তালিকার বিস্তর অমিল। কোলনের ল্যাঙ্কাশায়ারের কমিউনিটি সিনেমা ও ফিল্ম ক্লাব লিট্্ল স্যাভয় কমিউনিটি সিনেমা খ্যাতনামা ও সফল পোস্টার শিল্পীদের যে তালিকা তৈরি করেছে (ড্রু স্ট্রুজ়ান, রিচার্ড আমসেল, জন আলভিন, টম চ্যানট্রেল, বিল গোল্ড, সল ব্যাস, রেনল্ড ব্রাউন, রেনাটো কাসারো, জ্যাক ডেভিস, ফ্র্যাঙ্র ফ্রাজ়েত্তা, বরিস গ্রিনসসন, দি হিলডেব্র্যান্ড ব্রাদার্স, আল হির্শফেল্ড, মিচেল হুকস্্, বার্ট ক্লীগার, মর্ট কুনস্টলার, ফ্র্যাঙ্ক ম্যাকার্থি, রবার্ট ম্যাকগিনিস, বব পিক, এনজ়ো সিওত্তি, জন সোলিক, হাওয়ার্ড টার্পনিং, বরিস ভ্যালেজো প্রমুখ) সেটি নির্ভরয়োগ্য হলেও সম্পূর্ণ নয়। এমন বহু পছন্দের হেরফের হতে শুধু আকর্ষণীয় নয়―সবগুলি শিল্পকুশল, শিল্পশোভন ও শিল্পসফল মুভি-পোস্টারের নামোল্লেখও সম্ভব নয়।

সিনেমা-পোস্টারের দীর্ঘ-বিস্ময়কর ইতিহাসকে ছুঁয়ে দেখলেই প্রাচ্য-পাশ্চাত্য নির্বিশেষে বিশ্বের আত্মবেদন-স্পন্দিত চলচ্চিত্রের পোস্টারগুলির দিকে তাকালেই মোটের ওপর বিশ্বদর্শন ঘটে বলে সুমন বিশ্বাস করেন। ১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ যখন তাঁর ‘এ জন্মের তীর্থদর্শন’-এ মাত্র তেরো দিনের সফরে (১৯৩০-এর ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তিনি রাশিয়ায় ছিলেন) রাশিয়ায় গিয়ে ঠাসা কর্মসূটির মধ্যেও মস্কোর একটি প্রেক্ষাগৃহে দেখলেন দুটি চলচ্চিত্র : সের্গেই মিখাইলোউিচ আইজেনস্টাইন (১৮৯৮-১৯৪৮) পরিচালিত ‘ব্যাটেলশিপ পটেমকিন’ (১৯২৫) ও ‘দি জেনারেল লাইন’ (সহ-পরিচালক গ্রেগরি আলেকজান্দ্রভ : ১৯২৯)।’ দুটিই ছিল নির্বাক চিত্র। পরবর্তীকালে বিশ্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে নির্বাচিত আইজেনস্টাইনের ব্যাটলশিপ পটেমকিন-এর পোস্টার ডিজাইন করেছিলেন গ্রাফিক ডিজাইনার আলেকজ়ান্ডার রডচেঙ্কো (১৮৯১-১৯৫৬)। ১৯২৫ সালে প্রস্তুত রডচেঙ্কোর এই পোস্টার ছিল ‘সোভিয়েত কনস্ট্রাকটিভিস্ট’ আর্টের একটি জাজ্জ্বল্য উদাহরণ। কনস্ট্রাকটিভিস্ট–হিসেবে প্রখ্যাত সোভিয়েত কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি (১৮৯৩-১৯৩০)-র সঙ্গে কাজ করেছেন। ১৯২৬ সালে রডচেঙ্কো ব্যাটেলশিপ-এর আর-একটি পোস্টার রচনা করেছিলেন।

এ-ব্যাপারে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই যে, মহান চলচ্চিত্রকারেরা প্রায় সকলেই ছবির পোস্টারকে ছবির চিত্রনাট্যের থেকে কম গুরুত্ব দেননি। আইজেনস্টাইন নিজে চিত্রশিল্পী ছিলেন। ১৯১৮ সালে তিনি লালফৌজের হয়ে পূর্বপ্রান্তের রণাঙ্গণে রেলগাড়িতে প্রচারণামূলক ছবি আঁকতেন। লালফৌজ থেকে ফিরে আইজেনস্টাইন সোভিয়েত প্রলেতকাল্ট থিয়েটারে যোগ দেন. সেখানে তিনি ডিজাইন ও সেট নির্মাণের কাজ করতেন। এখানেই নাট্যনির্মাতা ভেসেভোলদ এমিলিভিচ্ মেয়ারহোল্ড (১৮৭৪-১৯৪০)-এর সঙ্গে আইজেনস্টাইনের পরিচয় হয়। মেয়ারহোল্ড নাটকে ছবির ব্যবহার করতেন। মেয়ারহোল্ডের মাধ্যমেই ক্যামেরার সঙ্গে পরিচয় হয় তাঁর। সুতরাং একথা মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, ভ্লাডিমির রডচেঙ্কোর ডিজাইন-করা ব্যাটেলশিপ পটেমকিনের পোস্টারের সঙ্গে আইজেনস্টাইনের রুচি-বুদ্ধি-পরামর্শের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ ছিল। ১৯২৯ সাল নাগাদ মুক্তিপ্রাপ্ত দি জেনারেল ছবিটিতে আইজেনস্টাইন মন্তাজ ও চিত্রকলাবিদ্যার প্রয়োগ করেছিলেন! ছবিদুটি দেখে রবীন্দ্রনাথ মুগ্ধ হয়েছিলেন, চলচ্চিত্র নামক এই শিল্পমাধ্যমটির বিপুল ক্ষমতাময় সম্ভাবনা তাঁর দূরদৃষ্টিতে ধরা দিল। তিনি আরও আশ্চর্য হলেন এই কথা শুনে যে, ছবিটি নির্মাণের সময় ব্যাটেলশিপ…এর পরিচালকের বয়স ছিল মাত্র সাতাশ। আইজেনস্টাইনের চলচ্চিত্রকে প্রোপাগান্ডিস্ট বা প্রচারণামূলক বলে দেগে দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন আইজেনস্টাইনের সঙ্গে পরিচিত হতে, কিন্তু আইজেনস্টাইন আমেরিকায় থাকায় সাক্ষাৎ হলো না।

শুধু আইজেনস্টাইন নয়, সিনেমা বা প্রদর্শনশিল্পের যে-কোনো অনুষ্ঠানের পোস্টারের ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্টজনেদের আগ্রহ, সতর্কতা ও সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। পূর্বোল্লেখিত অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড কিংবা নৃত্যপটীয়সী জেন এভ্রিলই তার প্রমাণ। জেন এভ্রিলের আগ্রহেই তাঁর মৌলিন রুজের নৃত্য প্রদর্শনীর পোস্টার তৈরি করা শুরু করেন হেনরি ডি টুলুস লোত্রেক। পোস্টার সিরিজ আঁকার অবকাশেই শারীরিক প্রতিবন্ধ্যার ফলে স্বাভাবিক নারীসঙ্গবঞ্চিত তুলুস-লোত্রেক এবং সুন্দরী, ব্যক্তিত্ববতী, বিষাদময়ী অথচ মঞ্চে শরীরী লাস্যবিকীর্ণানী, সুনিপুণ নৃত্যভঙ্গির পরিবেশক এই নৃত্যশিল্পীর অসামান্য বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। জেন এভ্রিল স্বীকার করেছিলেন যে, লোত্রেকের জন্যই তিনি এতটা খ্যাতি অর্জন করতে পেরেছিলেন [‘ইট ইজ টু লোত্রেক,’ সেইড জেন এভ্রিল, ‘দ্যাট আই ও মাই ফেম।’ (লাইফ : ১৯৬৪)] লোত্রেক অঙ্কিত ফ্যাকাশে গাত্রবর্ণের, লাল চুলের জেন এভ্রিলের অপূর্ব নৃত্যভঙ্গির প্রথম পোস্টারটি প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি রাতারাতি খ্যাতি অর্জন করেন। পরবর্তী ছবিগুলিতে জেনের চিত্তাকর্ষক ও দুর্জ্ঞেয় সৌন্দর্যকে চিত্রিত করেন তুলুস-লোত্রেক। ক্রমেই এই দুই শিল্পীর মধ্যে গড়ে ওঠে এক অজ্ঞেয় বন্ধুত্ব। বিভিন্ন পুরুষের সঙ্গে এভ্রিলের প্রেমের জীবন তাদের বন্ধুত্বকে ক্ষুণ্ণ করতে পারেনি। রাতের পর রাতে এভ্রিল লোত্রেকের হাত ধরে জনসমক্ষে দেখা দিয়েছেন বা হাসিমুখে লোত্রেকের স্টুডিওতে অনুষ্ঠিত পার্টিগুলিকে নিজের আকীর্ণ সৌন্দর্যের প্রভায় আলোকিত করেছেন, আতিথেয়তা দিয়েছেন প্রায় গৃহকর্ত্রীর প্রযত্নে!

যেমন একইভাবে প্রখ্যাততম, মঞ্চপ্রদর্শনের প্রথম সুপারস্টার  অভিনেত্রী সারা বার্নহার্ড এবং শিল্পী আলফোনেস মুচার বন্ধুতার ক্ষেত্রেও ঘটেছিল। একই সঙ্গে পুরুষ ও মহিলা চরিত্রে অভিনয় করে সারা প্রায়-সমস্ত নাট্যবিশ্বকে চমকে দিয়েছিলেন। শিল্পসচেতন, সৌন্দর্যময়ী, রুচিশীলা ও ব্যক্তিত্বপ্রখরা সারা তার গিসমোন্ডা নাটকের পোস্টার আঁকার জন্য নিজেই আলফোনেস মুচাকে নির্বাচন করেছিলেন। গিসমোন্ডার সেই আলোড়ন সৃষ্টিকারী পোস্টার প্রকাশের পর সারা কী করেছিলেন তা আমরা আগেই জেনেছি। মুচা পরবর্তী সময়ে সারা বার্নহার্ডের ইচ্ছায় আরও ছয়টি নাটকের পোস্টার তৈরি করেছিলেন এবং পোস্টারগুলি সারার ‘ঐশ্বরিক ভাবমূর্তি’ এবং ‘আইকনিক মর্যাদা’ নির্মাণ করেছিল। সারা বার্নহার্ড ও মুচার বন্ধুত্ব প্রায় কিংবদন্তিসুলভ জনশ্রুতি অর্জন করেছিল। গিসমোন্ডা অন্যান্য পোস্টারের সূত্রে মুচার ‘আর্ট ন্যুভো’ আন্দোলনের সঙ্গে সারা বার্নহার্ডের নামও উচ্চারিত হয়।

আমাদের দেশেও মুভি পোস্টারের সঙ্গে এইভাবেই চিত্রশিল্পের বিভিন্ন ধারা বা জঁরের বৃহত্তর প্রেক্ষিতের সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায় কঠিন কিছু নয়। ভারতীয় সিনেমার পোস্টারের যাঁরা সুলুকসন্ধান করেছেন (যেমন : রাজেশ দেবরাজ, ভাস্বত সরকার, বেনজির বেগ, এডো ব্যোমান, পল ডানকান, এস এম এম আউসাজা, রঞ্জনী মজুমদার প্রমুখ) তাঁদের উল্লেখ ও তাঁর সন্ধানাতিরিক্ত বিন্যাসের একটি রূপরেখা নির্মাণ করলেও আর আয়তন খুব একটা কম হবে না।

ভারতীয় সিনেযুগের শুরুতে রাজা দাদাসাহেব ফলকে পরিচালিত প্রথম পূর্ণ দৈর্ঘের চলচ্চিত্র হরিশচন্দ্র (১৯১৭), সত্যবাদী হরিশচন্দ্র (১৯১৭), বা আরদেশির ইরানি (১৮৮৬-১৯৬৯) পরিচালিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম সবাক চলচ্চিত্র আলম আরা (১৯৩১)-র মতো ছবিগুলিকে সংবাদপত্রে দেয় বিজ্ঞাপন বা হ্যান্ডবিল অথবা ঘোষকের প্রকাশ্য ঘোষণার ওপর নির্ভর করে দর্শক আকর্ষণ করতে হতো। সে-সময় প্রদর্শনীর মতো স্থান, প্রেক্ষাগৃহ ও দর্শক―সবেরই সংখ্যা ছিল সীমিত। হাতে ডিজাইন করা ও আঁকা প্রথম পোস্টারটি পাবার জন্য ১৯২০-র দশক পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল। ১৯২৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত বাবুরাও পেইন্টার (১৮৯০-১৯৫৪)-এর মারাঠি ছবি কল্যাণ খাজিনা-র হাতে আঁকা পোস্টারই সম্ভবত এখন পর্যন্ত টিকে থাকা প্রথম ভারতীয় সিনেমার পোস্টার। পোস্টারটি পরিচালক বাবুরাও নিজেই ডিজাইন করেছিলেন। গবেষক, জহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের রঞ্জনী মজুমদার জানিয়েছেন যে, সাধারণভাবে পোস্টারগুলি ক্যানভাসে হাতে তৈরি করে পরে সেটিকে নকশার উৎস হিসেবে ব্যবহার করে সস্তার কাগজে মুদ্রণ করা হতো। ( বোম্বাই ফিল্ম পোস্টার) যেহেতু মুদ্রিত প্রচারণা ছিল প্রচারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম সেহেতু ছবির গানের লিরিক্স, ফিল্মে বলা গল্পের সারসংক্ষেপসূচক পুস্তিকা এবং পোস্টারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রথম যুগে গানের পুস্তিকার কেমন চাহিদা ছিল তার সাক্ষ্য দিয়েছেন কর্নাটকের গদাগের প্রখ্যাত মুদ্রণ-ব্যক্তিত্ব ফকিরসা শিবনাসা ভান্দাগে তাঁর আত্মজীবনী ‘ইয়ারু নানু? জীবন কথানা’ (‘হু অ্যাম আই? এ লাইফ স্টোরি’) গ্রন্থে। তিনি তাঁর নিজস্ব মুদ্রণালয়ের সূচনার দিকে এমন পুস্তিকা ছাপার বরাত পেয়েছিলেন। (অনন্ত জানা : ২০২৪)

বাবুরাও পেইন্টার তাঁর সম্পর্কিত ভাই আনন্দরাও-এর সঙ্গে প্রথমে থিয়েটারের স্টেজ ডিজাইন ও পশ্চাদপট  অঙ্কনের কাজ করেন। পিতা কৃষ্ণরাও মিস্ত্রি-এর কাছেই শৈল্পিক-চেতনার প্রাথমিক ভিত্তিটি তৈরি হয়। এবং আনন্দরাও-এর সান্নিধ্য তাঁকে নাট্যশিল্প, অকাদেমিক ধরনের চিত্রাঙ্কন, ফটোগ্রাফি ও চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্পর্কে আগ্রহী করে তোলে। থিয়েটারের পশ্চাদপট অঙ্কন করতে গিয়েই তাঁরা দুই ভাই―বাবুরাও এবং আনন্দরাও পেইন্টার নামে পরিচিত হন।

বাবুরাওই প্রথম সিনেমার প্রচারের ও বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব উপলব্ধি করেন। এবং সেই উপলব্ধ অনুযায়ী নিজের তৈরি সিনেমার পোস্টার ডিজাইন করতে শুরু করেন। ভারতীয় ছায়াছবির পোস্টার অঙ্কনের পথপ্রদর্শকতার কৃতিত্ব বাবুরাও-এরই। সৈরন্ধ্রী (১৯২০) ছবির জন্য তিনি একটি ব্যানার তৈরি করেছিলেন। ‘সিংহগড়’ (১৯২৩) ছবির প্রচারের জন্য ১০/২০ মাপের একটা বিরাট পোস্টার বানিয়েছিলেন (এর থেকেও বড়ো পোস্টার তৈরির কৃতিত্বও বাবুরাও-এর ঝুলিতে ছিল)। এই সব অতিকায় পোস্টার দর্শকদের দারুণভাবে অভিভূত করেছিল।

প্রথম যুগে মুভি ‘সন্ত সখু’-র (১৯৪১) পোস্টারে শিল্পী রবি বর্মার আঁকা ছবি ব্যবহৃত হয়েছিল।

 

সিনেমার পোস্টারের ভারতীয় প্রেক্ষিতটির অনুসন্ধানীদের কেউ কেউ (যেমন : ভাস্বত সরকার, বেনজির বেগ) ১৯৫৭ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত মেহবুব খান (১৯০৭-১৯৬৪) পরিচালিত আইকনিক হিন্দি সিনেমা ‘মাদার ইন্ডিয়া’-র বি এম গুপ্তাকৃত পোস্টারটিকে সর্বকালের অন্যতম সেরা চলচ্চিত্র জ্ঞাপনী হিসেবে দেখতে চেয়েছেন। বাবুরাও পেন্টার ছাড়া ভারতীয় মুভি-পোস্টার ডিজাইনার হিসেবে খ্যাতি পেয়েছিলেন এই বি এম গুপ্ত, পুরো নাম ব্রিজমোহন গুপ্ত (১৯৩৫-২০০১)। তিনি তাঁর ওয়ালড সিটির স্টুডিওতে বসে বলিউড সিনেমার শতাধিক পোস্টারের ডিজাইন করেছিলেন। তাঁর করা মাদার ইন্ডিয়া ছবির পোস্টারটিকে ভারতীয় নারীর প্রতি, ভারতীয় নারীর মাতৃসত্তার প্রতি অনাক্রান্ত ও ঋজু শিল্পাঞ্জলি বলে গণ্য করা হয়। ম্যাক্সিম গোর্কির মাদার উপন্যাসের মাদারের চিত্রকাল্পিক অনুষঙ্গে গড়ে তোলা মাদার ইণ্ডিয়ার এই পোস্টারটিকে বলিউড সিনেমার এক কালজয়ী দিকচিহ্ন হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। এমনই শংসাবাক্য উচ্চারিত হতে পারে কামাল আমরোহী পরিচালিত ‘পাকিজা’ (১৯৭২)  ছবির পোস্টার (৫৪ / ৩৪ ইঞ্চি) সম্পর্কেও।

২০০১ সালে বি এম গুপ্তের প্রয়াণের পর তাঁর পুত্রের কাছে পোস্টারগুলি কেনার জন্য জনৈক আমেরিকান ব্যবসায়ী প্রস্তাব করেন। মুম্বাইয়ের এর ব্যবসায়ী তো গুপ্ত-চিত্রিত ‘দিওয়ার’ সিনেমার পোস্টারটি এক লক্ষ টাকার বিনিময়ে কিনে নেন। পরে শিল্পীপুত্র মাদার ইণ্ডিয়া ও পাকিজা ছবির পোস্টার দুটিকে মুম্বাই ফিল্ম মিউজিয়াম কর্তৃপক্ষের কাছে প্রদর্শনের জন্য দান করেন। একটা সময় ছিল যখন এমন রঙিন শত শত পোস্টার ছাপানো হতো না। হাতে আঁকা পোস্টারগুলি সিনেমা হলের লবিতে প্রদর্শিত হতো। এগুলি ছিল ‘প্রাণবন্ত’ এবং ‘ছবির আত্মাকে প্রকাশ করত।’ (টাইমস অব ইণ্ডিয়া : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৭)

ভারতের মুভি পোস্টারের ইতিহাসে আর-এক প্রভাবশালী ডিজাইনার আখতার শেখ ‘কিনারে কিনারে’, ‘হাতি মেরে সাথী’ কিংবা ‘জুগনু’র মতো ছবির স্বচিহ্নিত পোস্টার এঁকেছিলেন। সর্বকালের অন্যতম সফল চলচ্চিত্র ‘মুঘল-এ-আজ়ম’-এর পোস্টার বিভিন্ন সময়ে একাধিক ডিজাইনার করেছিলেন। এঁদের মধ্যে আছেন শেখ আবদুল রেহমান (এস রেহমান নামে সমধিক পরিচিত) এবং আখতার শেখ।

বলিউডে একটির পর একটি অসামান্য এবং সংখ্যায় সবচেয়ে বেশি পোস্টার ডিজাইন করে প্রায় জীবন্ত কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছিলেন দিবাকর কারকারে (১৯৩০-২০২১)। জানা য়ায় যে, মুম্বাই (সাবেক বোম্বাই)-এর নামকরা শিল্পশিক্ষালয় স্যার জে জে স্কুল অব আর্ট থেকে শিক্ষালাভের পর তিনি সফলভাবে ফিল্মী পোস্টারের ডিজাইন করেন। বিমল রায় পরিচালিত ‘বন্দিনী’ ছবির পোস্টার তৈরি করে ১৯৬৩ সালে বোম্বে চলচ্চিত্র জগতে কারকারের যাত্রা শুরু হয়। শোলে, অমর আকবর এন্টনি, জানে ভি দো ইয়ারো, কালাপাত্থর, সুহাগ, নসিব, দি বার্নিং ট্রেন, সত্যম শিবম সুন্দরম, বিমল রায়ের বেনজির, ডন, ওয়াক্ত, জনি মেরা নাম, মর্দ, স্বামী, মশাল, কভি কভি, চন্দানি, সিলসিলা ঈশ্বর ইত্যাদি অজস্র সুপার হিট ছবির পোস্টার এঁকেছিলেন দিবাকর। শক্তিশালী ও সুরচিত পোস্টার কী করতে পারে দিবাকরের পোস্টারই তার প্রমাণ। সেলিম জাভেদের ‘জঞ্জির’ সিনেমার পর থেকে অমিতাভ বচ্চন সম্পর্কে যে বাক্যটি প্রায় প্রবাদের মতো ব্যবহৃত হতে থাকে (অ্যাংরি ইয়ং ম্যান’) তা দিবাকরের ক্যানভাসেই প্রথম বাস্তবায়িত হয়েছিল। গুরনাজ় কৌর জানাচ্ছেন যে, তখন দিবাকর ছুরি দিয়ে রঙ কেটে ও লাগিয়ে অমিতাভর রুক্ষ ও রাগীদর্শন চেহারা আঁকেন। (২০২১) দিবাকরের করা ডিজাইন সম্পর্কে কৌর সে-সময়ের ধারণাকে মান্যতা দিয়েছেন। ক্যানভাসে তেল রঙে আঁকা দিবাকরের ডিজাইনগুলিতে শৈল্পিক ঋততার প্রকাশ ঘটেছিল―‘হিজ পোস্টার ডিজাইনস মেড ইন অয়েল পেন্ট হ্যাড দি এফেক্টস অব ফটোগ্রাফিক স্টিল। হিজ সিগনেচার টেকনিক অব ইউজিং প্যালেট নাইফ দ্যাট টার্নড দেম ইনটু কোয়াসি-পেইন্টেড পোস্টারস, বিকেম এ হিট ইন দি ইন্ডাস্ট্রি সিনস্্ ওয়াক্ত, দিওয়ার, অমর আকবর এন্টনি অয়্যার অল মেড উইথ সেম টেকনিক।’ (গুরনাজ : ২০২১) দিবাকর কারকারে মুখ্যত পোস্টার শিল্পী হলেও এবং তাঁর কাজ রাস্তায় শিল্পরসিক বা শিল্পবোধহীন, অভিজাত-অনভিজাত নির্বশেষে সব ধরনের মানুষের কাছে উন্মুক্ত থাকলেও তিনি প্রকৃত শৈল্পিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়ে খ্যাতি ও অর্থের স্বাচ্ছল্য থাকাকালীন ১৯৮৯ সালে কে বিশ্বনাথনের ‘ঈশ্বর’ ছবির পোস্টার তৈরির পর স্বেচ্ছায় নিজের স্টুডিওতে পোস্টারের ডিজাইনের কাজ বন্ধ করে দেন।

ভাস্বত এবং বেনজির আলোচনা সূত্রে দেখিয়েছেন যে, ভারতীয় সিনেমা-পোস্টার কীভাবে ব্যাপকার্থে সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে বিমিশ্রণের অনুঘটক হিসেবে কাজ করে এসেছে। ভারতের মতো বহু-বৈচিত্র্যের দেশে ভাষা- ধর্ম-অঞ্চলভেদের বৈষম্য-প্রাদেশিক অভিমানের প্ররোচনা এড়িয়ে একদা মানুষের বিনোদনের এবং রুচির স্বাতন্ত্র্যমণ্ডিত এককতা সৃজনের স্বপক্ষে কাজ করেছিল। আমরাও দেখেছি যে, পৌরাণিক-ঐতিহাসিক-সামাজিক, ধর্মপ্লাবিত ও সংস্কারমূলক প্রাতিষ্ঠানিক বিশ্বাসলালিত সবপেয়েছির কাল্পনিক জগৎপোষিত―‘অথবা শ্রমনিষিক্ত, বিপর্যস্ত, বঞ্চনাদীর্ণ বিপন্নতার রাষ্ট্রিক প্রহরগুলির কথা, কিংবা তারই মাঝে গৌরবময় পরাজয় উজ্জ্বল আর উজ্জ্বল উদ্ধারের স্বপ্নে মানুষকে, মানুষের শক্তিকে একত্রিত করার কথা, সংহত করার কথা বলেছে আমাদের সিনেমার জগৎ। কখনও শোচনীয় বেরুচিকর বাণিজ্যিক বজ্জাতি সত্ত্বেও, প্রায়শই মানুষের বেঁচে-থাকার মূল প্রেরণার ‘ক্ষেত্রে একটি প্রধান শক্তি হিসেবে কাজ করেছে।’ তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করেছে দক্ষ শিল্পীদের ডিজাইন-করা আমাদের সিনেমার হাতে আঁকা বা হ্যান্ড-প্রিন্টেড পোস্টারগুলি। যেখানে যেমন প্রয়োজন বা প্রেক্ষিত সেখানে তেমন অভ্যন্তর-নকশা (সরল বা বিশেষ ইঙ্গিতবাহী―যেখানে যেমন দরকার। বা সিনেমাটির বিষয়বস্তু যেমন, অথবা টার্গেট দর্শকের প্রত্যাশিত মানের বিচারানুযায়ী) অথবা নকশার রেখার ব্যবহার, রঙের বন্টন। আবার আমাদের দর্শকের সামাজিক ও আর্থিক অবস্থান বিচার করে টেক্সট এবং ভাষার ‘কৌশলগত ব্যবহার’ এবং ‘বৃহত্তর দর্শকদের কাছে আবেদন করার জন্য নিম্ন সাক্ষরতার স্তর পূরণ করার জন্য টেক্সটের পরিমাণ হ্রাস’ (ভাস্বত ও বেনজির : প্রাগুক্ত নিবন্ধ) ভারতীয় সিনেমা পোস্টারকে একদা ফিল্মের প্রচারের এক শক্তিশালী উপাদানে পরিণত করেছিল।

ইউরোপীয় ছবির পোস্টারে যেমন ছবির প্রচারের স্বার্থে পাশাপাশি দেশের ভাষা-লিপি ও শব্দবন্ধ ব্যবহৃত হয় বা অনূদিত শব্দাবলীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়, তেমনই ভাস্বত ও বেনজির ভারতীয় সিনেমার পোস্টারে ভাষা ও লিপির বিভিন্নতা ও বৈচিত্র্য দেখতে পেয়েছেন। আমেদাবাদের সাইনবোর্ড-শিল্পী জামালুদ্দিন কামারুদ্দিনকে যেমন গুজরাতি, ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু ও আরবি এই পাঁচটি ভাষায় সাইনবোর্ড লিখতে হয় সেরকম বিভিন্ন সিনেমা যখন বিভিন্ন প্রদেশে বিপণন করতে চায় তখন স্থানীয় দর্শকদের আনুপাতিক উপস্থিতির কথা ভেবে একাধিক ভাষায়  শিরোনামটি দিতে হয়। বিশেষ করে মুম্বাই, দিল্লি, কলকাতার মতো কসমোপলিটান শহরগুলিতে। পাকিজা বা মাদার ইণ্ডিয়া-র পোস্টারে লক্ষণীয়ভাবে মূল নামলিপিটি ইংরেজিতে এবং ক্ষুদ্রাক্ষরে হিন্দি ও উর্দুভাষাতেও নামটি দেওয়া হয়েছে। কেননা হিন্দি-উর্দু-ইংরেজি ভাযার মিশ্রণ বিভিন্ন ভাষার দর্শকের কাছে বোধগম্য হবে ও তাঁদের আকর্ষণ করবে! পূর্বোক্ত আলোচকদের অনুমান―এই নমনীয়তার কারণেই বলিউডের ছবি ‘বিভিন্ন ব্রিটিশ এশীয় দর্শকদের কাছে এত জনপ্রিয়, তাদের ভারতীয়, পাকিস্তানি, বা বাংলাদেশী পটভূমি নির্বিশেষে এবং তাদের মাতৃভাষা নির্বিশেষে।’ (প্রাগুক্ত প্রতিবেদন)বলিউডের জয়যাত্রার পাশেই সকলের কিছুটা অলক্ষেই যেন ভারতীয় সিনেমা জগৎটির দক্ষিণ-ভারতীয় জাগরণ ঘটে। চলচ্চিত্রিক ব্যবস্থাপনার সমস্ত বিভাগে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে পরিবর্তনের অনুশীলন করে ভারতীয় সিনেমার জগৎটিকে একেবারে বদলে দেয় দক্ষিণী সিনেমা। দক্ষিণ-ভারতীয় ভাষার এই ছবিগুলির অন্যান্য প্রধান প্রধান ভারতীয় ভাষায় অতিদ্রুত ডাবিং ও বহুক্ষেত্রে পুনর্নির্মিত হতে থাকে। ছবির প্রযুক্তিমাধ্যমে মুক্তির ব্যাপারেও দক্ষিণী সিনেমা পেছিয়ে থাকেনি। তার সঙ্গেই তাল মিলিয়ে দক্ষিণ-ভারতীয় সিনেমার পোস্টার নির্মাণের দৃষ্টিভঙ্গিতেও পরিবর্তন আসে। তামিল, তেলেগু. মালয়ালাম ও কানাড়া ভাষার ছবিগুলির প্রচারমূলক পোস্টার সীমাহীন ভাষাগত নমনীয়তার পরিচয় দিয়েছে। দক্ষিণী সিনেমার পোস্টারগুলির নামাঙ্কনে সংশ্লিষ্ট দক্ষিণ-ভারতীয় ভাষার হরফ ব্যবহার করা হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মূলনামের ইংরেজি হরফে উচ্চারণও থাকে। তারচেয়েও বড়ো কথা ভারতীয় মুভি পোস্টারগুলিতে পরিচায়ক বাক্য ও নামধামগুলি প্রায়শই ইংরেজি হরফেই দেওয়া হয়। কিংবা নানান ভাষার জন্য স্বতন্ত্র কয়েক প্রস্থ পোস্টার প্রস্তুত করা হয়। ডাবিং-এর যুগে তো কোনো কোনো মুভি পোস্টারে সরাসরি কয়েকটি ভাষার উল্লেখ থাকে (যেমন : কেজিএফ চ্যাপ্টার-২ সিনেমার পোস্টারে কানাড়া, তামিল, তেলেগু, মালয়ালাম, হিন্দি-র উল্লেখ করা হয়েছে)। তামিল সিনেমা-পোস্টারের অন্যতম প্রধান শিল্পী প্রথুল এনটি (?প্রথুলন্ট) তাঁর ডিজাইন করা পোস্টারে দক্ষিণী হরফের ঢঙে ইংরেজি হরফে  নামাঙ্কন করেছেন। প্রথুল এনটি তামিল ছাড়াও মালয়ালাম, তেলেগু ছাড়াও সফলভাবে বলিউডের হিন্দি ছবিরও পোস্টার ডিজাইন করেছেন। একা প্রথুল নন মুম্বাই (বলিউড), কলকাতা (টলিউড), কেরালা (মলিউড), কর্নাটক (স্যাণ্ডাল উড), ভোজপুরি সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ( ভোজিউড), ছত্তিশগড় (ছলিউড), ওড়িয়া ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি (ওলিউড) ―সর্বত্র পোস্টার ডিজাইনাররা, শিল্পীরা এগুলি একটি বিস্তৃত ভৌগোলিক অঞ্চল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা মুভি দর্শকদের সুবিধার জন্য ‘দেশের ভাষাগত বহুত্বকে ধারণ’ করেছেন, রূপায়িত করেছেন। প্রয়োজনানুযায়ী ‘পোস্টারগুলিতে ইংরেজি, হিন্দি (দেবনাগরী লিপি), উর্দু, বাংলা, তেলেগু’, উড়িয়া ইত্যাদি নানা ভাষার হরফ ব্যবহার’ করেছেন। (তানিয়া জর্জের প্রতিবেদন : ২০২২) স্থানীয় প্রয়োজন অনুসারে একই নকশা বজায় রেখে ভাষা বদল করা হয়েছে।  কিছু পোস্টারে ‘শিরোনামটি একাধিক লিপিতে লেখা হয়েছে, যাতে অন্য ভাষাভাষী বৃহত্তর দর্শকদেরা এটি বুঝতে পারেন। এবং যারা সংশ্লিষ্ট ভাষাটি বুঝতে পারেন কিন্তু পড়তে পারেন না, তাদের জন্য। অনেক ক্ষেত্রে এক প্রস্থ পোস্টারে শিরোনামে ইংরেজি হরফ ব্যবহারের কারণও এটাই। হরফের বৈচিত্র্যময় ধরন, বিষয় ও ভাষাভেদে হরফ নির্বাচনের ভিন্নতা এবং ভাষাভেদ সত্ত্বেও হরফ সজ্জার ঐক্য ―ইত্যাকার বিষয় নিয়ে বিশ্লেষণ, আলোচনা ও তার নষ্টকোষ্ঠী উদ্ধারের জন্য ‘লেটারফর্ম আর্কাইভ’ নামে একটি আস্ত গবেষণা-সংগ্রহশালার জন্ম হয়েছে।

(ক্রমশ)

…………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply