অকূলের কাল। পর্ব ২১। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
নরজিতের ‘টেট সিগ্রেট’
খিদিরপুর এক বাসে যাওয়া যায় না। একবার বাস বদল করতে হয়। হাতিবাগান থেকে এসপ্ল্যানেড, আবার এসপ্ল্যানেড থেকে খিদিরপুর। রবিবার সকালেই হস্টেলে লুচি-আলুভাজা খেয়ে বেরিয়ে পড়ল ক্ষিতি।
রাজগির থেকে ফিরে একদিনই দেখা হয়েছে দোলনের সঙ্গে। যেমন চলে তারই পুনরাবৃত্তি। সেই হেদো থেকে ট্যাক্সি ধরে চিড়িয়াখানা, ক্ষিতির বকবকম, দোলনের মুখে তালা। ফোনের ওপ্রান্তে থাকা অবিরল কথা-হাসির দোলন আর এই চিড়িয়াখানায় দোলন যেন অন্য জীব। তার গা ঘেঁসে বসে ক্ষিতি তার শরীরের উত্তাপ নিতে নিতে মাঝে মাঝে নিজের ঠোঁট দিয়ে তার ঠোঁট খোলার ব্যর্থ চেষ্টা করে, তারপর হাল ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়।
নতুন বলতে রাজগির থেকে আনা কাচের চুড়ি দোলনের হাতে পরিয়ে দিয়েছে ক্ষিতি। পরাতে গিয়ে ভেঙ্গেওছে দু-একটা। তা যাক, দোলনের পছন্দ হয়েছে চুড়ি। ক্ষিতি জিজ্ঞেস করেছে, কোথায় চুড়ি পেলি –বাড়িতে যদি জিজ্ঞেস করে?
দোলনের জবাব – বাড়ি যাচ্ছেটা কে! তুমি জানো না, যেদিন ঘুরতে বেরোই সেদিন মামাবাড়ি যাচ্ছি বলে বেরোই? কদিন মামাবাড়ি থেকে যখন বাড়ি ফিরব তখন বলে দেব মাসিরা দিয়েছে।
নতুন আরও একটা খবর দিল দোলন। বলল, কেবল শান্ত আর নেটকি নয়, ভেলিও প্রেম করছে তোমাদের কিষাণের সঙ্গে।
শুনে ক্ষিতি তো তাজ্জব! কিষাণ থাকে একতলায়। মালয়েশিয়া থেকে এসেছে, ভেটেরিনারি কলেজে পড়ে, ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা বলে। সে কেমন করে জুটে গেল ভেলির সঙ্গে! দোলন বলল, কেমন করে আবার – শান্তদার কাজ! ভেলি যে ওর আদরের শালি। নিজে তার দিদির সঙ্গে প্রেম করছে আর বোন কি শুধু আঙুল চুষবে!
কিষাণ ছেলেটা অবশ্য খারাপ নয়। খুব সরল, কথায় কথায় হাসে। ওর ভাঙা বাংলা শুনতে খুবই মিষ্টি লাগে ক্ষিতির। চেহারাটাও বেশ। লম্বা, শ্যামবর্ণ, একমাথা কোঁকড়ানো চুল। ওর পূর্বপুরুষ ভারত থেকেই মালয়েশিয়া গিয়ে সেখানকার স্থায়ী অধিবাসী বনে গেছে।
খিদিরপুরে পৌঁছে ক্ষিতি দেখল নরজিতও সেখানে মজুত। আজ তার অফ ডে। কোম্পানির সঙ্গে দেখা করে প্রণাম-ট্রনাম সেরে বাইরের ঘরে দরজা ভেজিয়ে তিনজনে বসল। অমিয় বলল, – রঞ্জিত, তুমিই সব বল মামাকে। তুমি তো সব ঘটেই গেঁড়ে বসে থাকো। তুমাকেও বাঞ্চোত পুলিশ তুলে নিলে ভাল হতো।
শেষ বাক্যটা বলতে বলতে অমিয় রেগে গেল। অমিয়র রেগে যেতে, আবার শান্ত হয়ে যেতেও এক সেকেন্ডের বেশি সময় লাগে না। তবে গালাগালিটা সে নরজিতকে দিল, নাকি পুলিশকে – সেটা বোঝা গেল না।
নরজিত হা হা করে হেসে নিল খানিক। তারপরে বলল, – শুন গুসাঁই – সে ক্ষিতিকে কখনও ‘মামা’ বলে, আবার কখনও ‘গুসাঁই’ – আমি যদি অশোককে বরাবর নজরে না রাখতাম তাহলে সে আরও বিপদে পড়ে যেত।
ক্ষিতি বলল, – বিপদের বাকি আর কী রইল! বিচারে যদি তারা দোষী প্রমাণিত হয়, তাহলে তো যাবজ্জীবন হয়েই যাবে।
নরজিত বলল, – কোম্পানিকে যদি অতটা কাঁচা খেলোয়াড় ভেবে থাক তাহলে খুব ভুল করছ গুসাঁই। লালবাজারে ঘুঁটি সাজানো থেকে পাটোয়ারি উকিল দাঁড় করানো সবই হিসাব করে করেছে কোম্পানি। তারপরেও যদি সাজা হয় তাহলে জানবে কপালের দোষ।
অমিয় বলল, – তুমাকে আর পণ্ডিতের মতো দার্শনিকগিরি মারাতে হবেক নাই। ভিতরের কথা যেগলা জেনেছ, মামাকে বল।
নরজিত বলল, – শুধু তুমরা কেন, পাড়ার লোকও সবটা জানে না। কাজটা মোটেও তিন জনে করেনি, সঙ্গে আরও দুজন ছিল। তারাই নকশাল পার্টির ভেতরের লোক। ওরাই অনেকদিন ধরে অশোকদের মাথা চিবোচ্ছে। নিউ আলিপুর কলেজে ভর্তি হওয়ার পর থেকেই ওরা তিনজন ওদের টার্গেট। কলেজে একবার গণ্ডগোল পাকিয়ে ল্যাবরেটরি ভাঙচুর করেছিল নকশালরা। সেই ঘটনার মূল পাণ্ডা ছিল দিলীপ। নেহাত ভয়ে পুলিশ ডাকেনি প্রিন্সিপাল, নইলে তখনই হাজতবাস করতে হতো। এ পাড়াতেও কয়েকজন নকশাল নেতা আছে, তাদের সঙ্গে আবার এদের কোনো যোগ নেই। এই দুজনের একজনের বাড়ি ভবানীপুরে, আর একজনের শাঁখারিপাড়ায়। ভবানিপুরের মদন নামকরা ফুটবল প্লেয়ার, নিজের একটা ছোটখাটো ব্যাবসা আছে। ও পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য। আর শাঁখারিপাড়ার জলধি একটা চাকরি করত কোথায় যেন। এদের তিনজনকে ওরা ওই কনস্টেবলকে রেকি করার ভার দিয়েছিল। মানে ওর কখন ডিউটি, কখন আসে, কোথায় কোথায় যায় এইসবের দিকে লক্ষ রাখা যাতে সময় বুঝে ওর উপর হামলা করা যায়। ওদেরকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করার পরিকল্পনা প্রথমে ওদের ছিল না। ওরা দুজন কেবলমাত্র দিলীপকে সঙ্গে নিয়ে কাজটা করবে সেটাই ঠিক ছিল। অশোকের, মামা তুমি তো জানোই, সকলের জন্যই মন কাঁদে; আর বুলির তো সিপিএমের দিকে ঝোঁক। এজন্যেই বোধহয় ওরা এই দুজনকে এই কাজের উপযুক্ত বলে মনে করেনি। কিন্তু দিলীপ বেঁকে বসে। ওদের সঙ্গে না রাখলে সেও থাকবে না বলে জেদ ধরে। ওরা তখন উভয়সংকটে পড়ে যায়।
পার্টির সিদ্ধান্ত – মদন, জলধি আর দিলীপ এই তিনজনে অ্যাকশনটা করবে। কিন্তু দিলীপ পার্টির অনুশাসন থোড়াই কেয়ার করে। তাছাড়া যেখানে এই কাজটা হবে সেখানে এই তিনজন, বিশেষ করে অশোক খুবই জনপ্রিয়। যদিও এইসব গণ্ডগোলে সাধারণ মানুষ একেবারেই মাথা গলায় না। তবু প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকলে অ্যাকশনের পরে তাড়াতাড়ি গা ঢাকা দেওয়ার সুবিধা হয়। এইসব ভেবে মদন আর জলধি পার্টিকে না জানিয়েই অ্যাকশন স্কোয়াডে এই তিনজনকে নিয়ে নেয়।
ডেন্ট মিশন রোডের ওই রেস্টুরেন্টের মালিক একজন মালায়ালি মুসলমান। এখানে বসে ওরা প্রায়ই আড্ডা দিত। নিয়মিত খদ্দেররা প্রায় সকলেই এদেরকে ভালমতোই চেনে। তা সত্ত্বেও এখানেই এই কাজটা করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল, কারণ এর চাইতে সুবিধেজনক জায়গা ওদের সন্ধানে ছিল না। ওদের হিট লিস্টে এই কনস্টেবল ছাড়াও খিদিরপুর ডকের একজন ট্রেড ইউনিয়ন লিডার ছিল। শেষ পর্যন্ত এইটাই ওদের সহজ টার্গেট হয়ে যায়। লোকটা প্রতিদিনই দশটায় ডিউটিতে যোগ দেওয়ার আগে এই রেস্টুরেন্টে বসে চা-টোস্ট খেত। ওদের পাঁচ জনের হাতেই একটা করে ছ ইঞ্চি ফলার ছুরি ছিল। প্রথম আঘাতটা মদনই করেছিল, তারপর সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ক্ষিতি অবাক। বলে, – এতসব ভেতরের কথা তুমি কোত্থেকে জানলে, রঞ্জিত?
নরজিত চওড়া করে হাসল। বলল, – সেটা বলা যাবে না – টেট সিগ্রেট।
অমিয় বলল, – কথাটা কতবার বলেছি – ট্রেড সিক্রেট। বাঞ্চোত ইচ্ছে করেই বারবার বলবে – টেট সিগ্রেট। নরজিত এবার শব্দ করে হাসল। বলল, – বুজলে গুসাঁই – সব মানুষের সঙ্গে মিশতে জানতে হয় কিন্তু নিজের মুখে তালা দিয়ে রাখা দরকার। সময় বুঝে, জায়গা বুঝে মুখ খুলতে হয়। আমি কেবল কোম্পানির কাছেই মুখ খুলি। কোম্পানি অল ক্লিয়ার সিগন্যাল দিলে অবশ্য তালা খুলে দিই সব জায়গাতেই।
সন্ধেবেলায় হস্টেলে ফিরতে ফিরতে ক্ষিতি কেবলই ভেবে চলেছিল জেলের ভিতরে অশোকের কী কী কষ্ট ভোগ করতে হচ্ছে।
(ক্রমশ)
