অকূলের কাল। পর্ব ২০। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
নারীর হৃদয়
রাজগির থেকে ফিরেই অশোকের একটা খবর পাওয়া গেল। খবরটা ভালো কি খারাপ বুঝতে পারছে না ক্ষিতি। অমিয় ফোন করেছিল। বলল, – আলিপুর পুলিশ কোর্টে গতকাল সারেন্ডার করেছে অশোকরা সবাই। সেদিনই জেল কাস্টডিতে প্রেসিডেন্সি জেলে সবাইকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কোর্টের নির্দেশে।
–এবার কী হবে?
–আদালতে বিচার চলবে। বিচারে যা রায় হবে সেইমতো যা হবার হবে।
খুব বিমর্ষ হয়ে পড়েছে ক্ষিতি। হত্যার অভিযোগ – প্রমাণ হয়ে গেলে যাবজ্জীবন বা ফাঁসিও হতে পারে। সে বলল, – সারেন্ডার করল কেন অশোক!
অমিয় বলল, – সব কোম্পানির পরামর্শেই হয়েছে। তোকে বলেছিলাম তো – কোম্পানি লালবাজারের পুলিশ অফিসারদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল। ওরাই বলেছে সারেন্ডার করতে। লুকিয়ে থাকলে পুলিশ একদিন না একদিন ঠিক ধরবেই। তখন কেস হাতের বাইরে চলে যাবে।
–কোথায় ছিল অ্যাদ্দিন?
–ফোনে এতকিছু বলা যাবে না। রোববারে খিদিরপুরে আয়। আরও অনেক কিছু জানা গেছে। সব বলব।
শনিবারের বিকেলে নোটপত্তর নিয়ে পড়তে বসেছে ক্ষিতি। পার্ট ওয়ান পরীক্ষা সামনেই। এমনিতেই নোট মুখস্থ করায় তার তীব্র অনীহা। বড্ড সাজানো, আলংকারিক মনে হয়। চেষ্টা করেও মুখস্থ রাখতে পারে না। অথচ অন্য অনেককে দেখেছে হুবহু নামিয়ে দেয় পরীক্ষার খাতায়। খুবই আশ্চর্যজনক মনে হয় তার। ক্ষিতি যতই মুখস্থ করুক, লেখার সময় তার ভাষা হয়ে যায় সাদামাটা, নোটের বেশ কিছু পয়েন্ট ভুলে যায়। ফলে তার উত্তর সদাই সংক্ষিপ্ত। চল্লিশ বিয়াল্লিশে মার্কস গিয়ে ঠেকে। চল্লিশের নীচেও থেকে যায় কখনও কখনও। পড়তে বসলেই তাই সে দুশ্চিন্তায় কাতর হয়ে পড়ে। আজও তাই হচ্ছিল। দিনু ছাদে ছিল, এই সময় ঘরে ঢুকে এসে বলল, – কাকু দেখ তো, দুটো মেয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে, তোর আকাশবাণীরা নয় তো?
কাকু বারান্দায় বেরিয়ে দেখে দুটি মেয়ে পাশাপাশি সিঁড়ির শেষ ধাপে পা রেখে বারান্দায় উঠে আসছে। একটি মেয়ে রোগা, লম্বা, কালো, কাটা কাটা নাক চোখ মুখ, মাথায় একরাশ কালো কোঁকড়ানো চুল – এক ঝলক দেখেই মনে হয় বেশ ব্যক্তিত্ব আছে। অন্য মেয়েটি গোলগাল, ভীষণ ফরসা, নাকের আগায়, টোল পড়া গালে রক্তাভা, বেশ আহ্লাদি চেহারা। কালো মেয়েটি কাকুকে দেখতে পেয়েই জিজ্ঞেস করল, – উনিশ নম্বর রুম?
কাকু তার পিছনে হাত বাড়িয়ে দেখাল। মেয়েটি বলল, – অভীক চ্যাটার্জি –
ততক্ষণে শচি আর অনুপমও এসে কাকুর পাশে দাঁড়িয়েছে। এবার ফরসা মেয়েটি বলল, – অভিদা নেই?
ততক্ষণে সবাই খানিক আন্দাজ করতে পারে অন্তত একটি মেয়ের পরিচয়। শচি মিষ্টি করে বলল, – অভীক বোধহয় বেরিয়েছে কোথাও। এসো না তোমরা – ঘরে এসে বসো। আমি শচি –
কাকু আন্দাজ করল এই ফরসা মেয়েটিই খুব সম্ভবত সুবু। অভীকের মুখে ওর বর্ণনা যেটুকু শোনা আছে তাতে তাই মনে হয়। সে একটু ইতস্তত করছিল কিন্তু কালো মেয়েটি এগিয়ে এসে ঘরে ঢুকতে সে-ও তার পিছু পিছু ঘরে ঢুকল। শচি দুটো চেয়ার ঝেড়েঝুড়ে তাদের দিকে এগিয়ে এল। কালো মেয়েটি নিজেদের পরিচয় দিল, – এ সুবর্ণা আর আমি ওর বন্ধু, একই কলেজে একই ক্লাসে পড়ি। এবার এইচ এস দেব। আমার নাম কৃত্তিকা।
সুবর্ণা সকলের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, – আমি বোধহয় আপনাদের সবাইকেই চিনতে পারছি। আপনাদের গল্প এত শুনেছি অভিদার কাছে যে ভুল হবে বলে মনে হয় না। আপনি ক্ষিতিদা মানে কাকু, উনি সচ্চিদানন্দদা, উনি … ।
সকলের নামই ঠিকঠাক বলে গেল সুবু। এমনকি প্রদীপদাকে কেন দেখতে পাচ্ছে না তাও বলল। তারপর জিজ্ঞাসা করল, – অভিদা কোথায় গেছে, কখন ফিরবে কিছু বলে গেছে?
কেউ জানে না। কাউকে কিচ্ছু জানিয়ে যায়নি অভীক। সবাইকে নিরুত্তর দেখে সুবুর চোখমুখ ক্রমশ ভারী হয়ে উঠল, গাল টকটকে লাল। তাই দেখে কৃত্তিকা তার কাঁধে হাত রাখল। সুবু ধরা গলায় বলল, – আমি জানতাম যে থাকবে না। গত দু’মাস ধরে আমাদের বাড়ি যাওয়া বন্ধ করেছে। যতবারই ফোন করি শুনতে হয় সে নেই।
কাকুর মনে পড়ল – ঠিকই তো অভীকের ফোন এলে সামনে যাকে পায় তাকেই অভীক বলে, বলে দে নেই। সুবু বলছে, জানেন – সেই কোন ছেলেবেলা থেকেই অভিদাকে ভালো লাগত, ওর ভক্তই ছিলাম। কিন্তু একটু বড় হয়ে বুঝলাম, তাকে আমার যতই ভালো লাগুক তার বিন্দুমাত্র ফিলিংস নেই আমার জন্যে। আর একটা জিনিস বুঝলাম, অভিদা ভীষণ নিষ্ঠুরও। তখন থেকে নিজেকে শাসন করে আমি অভিদার উপর থেকে মন সরিয়ে নিয়ে আসি। কষ্ট হয়েছে খুব। তাও পেরেছিলাম।
সুবুর গলায় বোধহয় বাস্প জমছিল। একটু থেমে কয়েকবার ঢোঁক গিলল। কৃত্তিকা হাত বাড়িয়ে সুবুর একটা হাত চেপে ধরল। কাকুরা সবাই ভীষণ অস্বস্তিতে, কিছু কি বলা উচিত? অভীকের অপরাধে, কাকুর মনে হচ্ছে, তাদেরও কিছু দায় আছে।
সুবু বলছে, তারপর বালিগঞ্জে আমরা চলে আসার পর থেকেই অভিদা প্রায়ই আমাদের বাড়ি যাওয়া শুরু করল। আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, আমার খুবই ঘনিষ্ঠ হওয়ার চেষ্টা করছে। আমার পড়াশুনা নিয়ে খুবই আগ্রহ দেখাচ্ছে। অভিদা যে ভীষণ মেধাবী তা তো তোমরাও জানো। বোটানি ওর বিষয়ই নয়, তাও দেখলাম ও যেন আমার জন্যই বিষয়টার ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছে। নিজের পড়াশুনার ক্ষতি করে আমার প্র্যাক্টিক্যাল খাতায় দারুণ দারুণ ড্রয়িং করে দিচ্ছে।
এই ড্রয়িঙয়ের গোপন কথা সুবু এখনও জানে না নিশ্চয়ই। কাকুদের মনে সামান্য কৌতুক জাগলেও কেউ মুখ খুলল না। কিছু কথা গোপনে থাকাই ভালো।
–ভেতরে ভেতরে আমার যতই ভালো লাগুক আমি মন শক্ত করে থাকলাম। অনেকদিন নিজের সঙ্গে লড়াই করেছিলাম, জানেন।
ভেঙ্গে পড়ল সুবু। কৃত্তিকাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল। তার কাঁধে মাথা হেলিয়ে দিয়েছে সে। চোখ থেকে অবিরল ধারায় অশ্রু গড়াতে গড়াতে কৃত্তিকার ব্লাউজ ভিজিয়ে দিচ্ছে। মাথা নিচু করে বোকার মতো দাঁড়িয়ে আছে অভীকহীন কাকুর ব্র্যাকেট।
(ক্রমশ)
