সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১৮। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

প্লেন আবার কাঁপতে শুরু করেছে। জোনাথন এবং এলিন দ্রুত নিজেদের জায়গায় ফিরে গেল। কিছুক্ষণ জানালা দিয়ে দৃষ্টি মেলে চুপচাপ বসে রইলেন প্রৌঢ় ধনকুবের। তারপর মুখ ফেরালেন।

‘ঠিক। এমন কথাও শোনা যায় বই-কি। জেরুজালেম থেকে পালিয়ে ক্যাপাডোসিয়ার কোনো জায়গায় আশ্রয় নেন লংগিনাস। সেখানে খ্রিস্টের প্রচারও শুরু করেন। বিশপও হয়েছিলেন সম্ভবত। তারপর একদিন তাঁকে ধর্মের নামে শহিদ হতে হয়।’

‘ক্যাপাডোসিয়া! সিজারিয়া মাজকা! নামগুলো কি এই গ্রহেরই?’

আলতো হেসে জবাব দিলেন জোনাথন, ‘ক্যাপাডোসিয়া নামটি কিন্তু দিব্যি এখনো টিকে আছে। মধ্য তুরস্কের মরুপ্রায় অঞ্চল। কিছু কেভ চার্চ এবং আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি আবিষ্কার হয়েছে সেখানে। সিজারিয়া মাজকা বলে কোনো জায়গার নাম অবশ্য তোমার মতো আমিও প্রথম শুনলাম। রোমান পিরিয়ডে কোনো শহরের নাম কি?’

এমার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন তিনি।

‘হ্যাঁ। এখন সবাই কায়সেরি নামে চেনে।’

‘আচ্ছা! এবার চিনতে পারলাম। তুমি জেরুজালেমের পরিবর্তে ক্যাপাডোসিয়ায় অনুসন্ধান চালাতে চাইছ। তাই তো?’

কথার মাঝে তরুণ অ্যাটেনডেন্টটি কফির সঙ্গে কিছু দারুণ স্বাদের কুকিজ দিয়ে গিয়েছিল। জোনাথন ছুঁয়ে দেখেননি। এলিন যথারীতি তার ভাগের অংশ শেষ করে ফেলেছে। এমারও খাস্তা বাদাম ঠাসা কুকিজের স্বাদ বেশ লাগছিল। ‘আর নয়’ স্থির করেও একটা কুকিজ তুলে অর্ধেক ভেঙে নিল সে। মুখ অন্য কাজে ব্যস্ত থাকায় ঘাড় নেড়ে উত্তর দিতে হলো তাকে।

‘বেশ।’

ছোট্ট প্রতিক্রিয়া জানিয়ে ককপিটের কাছে উঠে গেলেন জোনাথন। পাইলটের সঙ্গে কথা বলে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এলেন।

‘ওপরয়ালাও নির্ঘাৎ আমাদের কথা শুনছেন।’

‘মানে! কে?’

এলিনের কথায় ঠাট্টার সুরে বললেন জোনাথন, ‘বিধাতা হে। এখানে এমা বলছে তুরস্কে নামার কথা, এদিকে আমাদের সারথি আগেভাগেই তা স্থির করে রেখেছে। ইতিমধ্যে এরকিলেট থেকে অনুমতি নেওয়াও সারা। ট্যাংকে যতটুকু জ্বালানি আছে, তুরস্কের ওপারে যাওয়া যাবে না। সমাপতন আর কি।’

‘কিন্তু কাগজ অনুযায়ী আমাদের তো ইজরায়েল যাওয়ার কথা। সেক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা হবে না?’

এলিনের প্রশ্নকে গুরুত্ব দিলেন না জোনাথন। বদলে পালটা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুরস্কে আমাদের সাহায্য করার মতো বিশ্বস্ত কেউ আছে? একটা ছোটো পেশাদার টিম দরকার। নিরাপত্তার জন্য৷’

‘কেন?’

মুখের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। এবার ভুরু জোড়া কাছাকাছি এনে প্রশ্ন করল এমা।

‘তোমার অনুমান মিলে গেলে, যার চোদ্দো আনা সম্ভাবনা আছে, সামিরা এবং তার কোম্পানি আমাদের জন্য সেখানে ফাঁদ পাততে পারে। লাগুক না লাগুক, সুরক্ষা ব্যবস্থা সঙ্গে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

 

প্রজেক্ট রিভেঞ্জে ড. এমা মিলারকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন জোনাথন। মেয়েটা তাৎক্ষণিক নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে পারে। পর্যাপ্ত জ্ঞানের সঙ্গে নিখুঁত অনুমান ক্ষমতার মিশেল। সুতরাং এমা যখন গন্তব্য বদলের কথা ভেবেছে, পর্যাপ্ত কারণ আছে নিশ্চয়ই। মেয়েটার দুর্বলতা কেবল বিপদকে আগে থেকে চিহ্নিত না করতে পারায়। বইয়ের বাইরের পৃথিবী বড়ো রহস্যময়। ঈশ্বরকে যেমন চোখে দেখা যায় না, বিপদকেও নয়। এক্ষেত্রে তাই সাবধানতা তাদের অন্যতম অস্ত্র।

 

‘পনেরো মিনিটের মধ্যে আমরা এরকিলেট পৌঁছে যাব।’ স্পিকার থেকে পাইলটের গলা ভেসে এল।

‘কাজের লোক আছে মি. ডারওয়ার্ড। আমার বন্ধু ডেভিস। তার সঙ্গে কথা বলতে পারলে ঠিক একটা হিল্লে করে দিতে পারবে।’

‘ওয়েল, দেন কল হিম।’

বলে সামান্য ঝুঁকলেন জোনাথান। সিটের নিচে যে একটা ছোট্ট ড্রয়ার আছে, আগে চোখে বাঁধেনি! এলিন নিজের সিটে নজর বুলিয়ে তেমন কোনো আলাদা সংরক্ষিত স্থান খুঁজে পেল না। অর্থাৎ ডানদিকে ককপিটের মুখোমুখি সিট প্রৌঢ় ধনকুবেরের জন্যই পাকাপাকিভাবে বরাদ্দ। জোনাথন সোজা হয়ে একটা স্যাটেলাইট ফোন এলিনের দিকে এগিয়ে দিলেন।

‘কল হিম রাইট নাও। যত দ্রুত সম্ভব জনা চার-পাঁচেকের দুরন্ত নিশানাবাজের টিম যেন আমাদের সঙ্গ দিতে তৈরি থাকে।’

 

জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়রকে যতই দেখছে, ততই নতুন করে অবাক হতে হচ্ছে! নিজের বিস্ময়ভাব গোপন রেখেই ডেভিসের নম্বর ডায়াল করল এলিন। এবং যথারীতি, দ্রুত জবাবও পেল। ডেভিস একদিন পর নিজে যোগ দেবে। অবশ্য ততক্ষণের জন্য একটা ব্যবস্থা করে রাখবে। শুধু তুরুস্কে নেমে তারা কোথায় থাকছে জানিয়ে দিলেই হবে। এলিন যতক্ষণ ফোনে ব্যস্ত ছিল, জোনাথন এতক্ষণ ধরে ফেলে রাখা কুকিজ, প্লেট থেকে একটার পর একটা দ্রুত তুলে নিচ্ছিলেন। দৃশ্যটা এমাকেও অবাক করেছিল। কথা শেষ হতে স্যাটেলাইট ফোনটা আবার ড্রয়ারে ঢুকিয়ে রাখলেন তিনি। আর তারপরই ভীষণ জোরে কেশে উঠলেন। ভাঙা কুকিজের টুকরো তাঁর কোলের ওপরে, সামনে ছিটকে পড়ল। হোল্ডারে জলের বোতল রাখা ছিল। বোতলের ছিপি খুলেও মুখে দিতে পারলেন না প্রৌঢ় ধনকুবের। চিবুক হয়ে তাঁর গলা বুক ভিজিয়ে দিল বিশুদ্ধ জল। ডান হাত দিয়ে বুকের কাছটা খিমচে ধরলেন তিনি। জানালা দিয়ে এরকিলেট ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট দেখা যাচ্ছে। নিচে। ছোটো ছোটো বাক্স বাড়ি। মাটিতে পড়ে থাকা চুল বাঁধার ফিতের মতো চকচকে কালো রানওয়ে। জেট ল্যাণ্ড করতে চলেছে। এলিন নিয়ম শিকেয় তুকে সিট বেল্ট খুলে লাফিয়ে পৌঁছাল সামনের সিটে।

‘মি. ডারওয়ার্ড! কী হয়েছে? মি. ডারওয়ার্ড…’

তরুণ অ্যাটেনডেন্টও নিজের জায়গা ছেড়ে এসেছে। দুলুনির কারণে শরীরের ব্যালেন্স রাখাই দায়। তবুও সামনের বেঁকে যাওয়া শরীরটা ধরে নাড়াতে শুরু করল এলিন।

‘মি. ডারওয়ার্ড!’

ভয়ানক বড়ো হাঁ করছেন জোনাথন। একটু বাতাসের জন্য এত আকুতি, অথচ তাঁর জন্য বরাদ্দ পৃথিবীর বাতাস যেন দ্রুত ফুরিয়ে আসছে! তরুণ সহযোগী এবং এলিন, দু’জনে মিলে প্রবল চেষ্টা করছে মানুষটাকে জাগিয়ে তোলার। হেলে যাওয়া ঘাড়, লুটিয়ে পড়া হাত তবুও শরীরের প্রতি কোনো আকর্ষণ টের পাচ্ছে না। জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র। মানুষটাকে এমা ঘৃণা করে এসেছে। প্রতারক, স্বার্থপর, হিংস্র শ্বাপদের মতো ভয়ংকর একটা মানুষ। লোকটা কি সত্যিই বদলাতে চেয়েছিল, নাকি সবটাই আদতে অভিনয়? যাইহোক না কেন, জোনাথন ডারওয়ার্ডের প্রতি তার তিলমাত্র সহানুভূতি থাকার কথা নয়। অথচ এই মুহুর্তে সামনের দৃশ্যটা তাকে স্থবির করে দিতে চাইছে! এক আশ্চর্য অসহায়বোধ ঘিরে ধরতে চাইছে। তার মনে আতঙ্ক জন্ম নিচ্ছে কেন? কাউকে হারিয়ে ফেলার ভয়? প্রশ্নের গোলকধাঁধায় নিজেকে হারিয়ে ফেলা এমা, পুতুলের মতো নিজের জায়গায় স্থির হয়ে রইল। অস্পষ্ট হয়ে আসা চারপাশ থেকে শুধু ক্যাপ্টেনের মৃদু গলার আওয়াজ শুনতে পেল সে,

‘এটিসি এরকিলেট… টেকিং দ্য থার্ড লাইন… এটিসি এরকিলেট… মেডিক্যাল এমারজেন্সি…’

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *