অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১৭। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

পুনরুজ্জীবনের পাঠমালা, রাস্তার শিল্পী ও দেয়ালের লেখা

 

সাইনবোর্ড লিখতে শুরু করার প্রথমদিকে সুমনের একটু অসুবিধা হয়েছিল―তাঁর প্রিয় ক্যালিগ্রাফির বইগুলো তো পড়ে রইলো বাবার টাকায় কেনা দাদাদের উত্তর কলকাতার শহরতলীর একটা আধা-পুরোনো বাড়ির সিঁড়ির নিচের কুচুটে-অন্ধকার!

প্রথমদিকে কলকাতায় গিয়ে একবার তাঁর মনে হয়েছিল এই গঞ্জ জায়গাটা শহর হলে হয়তো কাছাকাছির কোনো প্রেসে গিয়ে টাইপ-ফেস ও ফন্টগুলো দেখে আসতে পারতেন। তিনি শহুরে মানুষ―নিরালম্ব ও অন্তঃসারশূন্য তাঁর জীবন হলেও কোনো কিছুকে না-আঁকড়ে তিনি বাঁচতে শেখেননি―রেফারেন্স বই দেখে দেখে সাত-নকলে আসল খাস্তার মতো তাঁদের সৃষ্টির জগৎ। ওহ্!  চারপাশে চোখ মেলে যদি দেখতেন দোকানপাটগুলোকে। কলকাতা জুড়ে কতই ‘বিপণি, কতই পণ্য / কত কোলাহলকাকলি।’ (রবীন্দ্রনাথ : নগরসংকীর্তন) কত কত বিপণিলিপিতে পরিপূর্ণ তাঁর মহানগর। কলকাতায় দোকানপাটে, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানসমূহে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে, রেঁস্তোরার শিরোদেশে বা পণ্যের বিজ্ঞাপনের লিখন ও থিমেটিক চিহ্ন অঙ্কনের অসামান্য কোনো কাজ দেখে কখনও চমক জাগেনি তা নয়, কিন্তু তাকে কখনও শিল্পকুলীন বলে মনে হয়নি তাঁর। তাঁদের পাড়ার প্রণবদাই তো দেদার সাইনবোর্ড, নেমপ্লেট, অনারবোর্ড, পোস্টবাক্স, ভবনলিপি, মেনুবোর্ড লিখতেন―এক পেস্টকন্ট্রোল সংস্থার অফিসের বাইরে কাঠের পাটাতনকে ইচ্ছামতো ছিঁড়েখুঁড়ে পোকায় খাওয়া রূপ দিয়ে তার ওপরে দামি কাঠের হরফ তৈরি করে সোনালি রঙ দিয়ে রোমান স্টাইলে বোর্ড বানিয়ে দিয়েছিলেন। আসলে প্রণবদার বাবা সাইনবোর্ড লিখেই জীবন অতিবাহিত করেছিলেন। চন্দনগাছির শান্তি বাহার  বা শান্তি পেন্টার কিংবা আমেদাবাদের ঘীকান্ত অঞ্চলের শেখ কামারুদ্দিন জালালুদ্দিনের মতোই আমাদের এই অঞ্চলের অধিকাংশ বিপণির পরিচয়লিপিই তাঁর হাতে লেখা। বোর্ডের কোণে তিনি নিজের নাম সই করতেন ‘মৃন্ময় নন্দী’ বলে। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, চন্দনগাছির পিন্টু বাহারের মতোই প্রণবদা যখন বাবার জায়গায় বোর্ড লেখা শুরু করলেন তখন তিনি বাবার নামই লিখতেন বোর্ডের কোণায়। কেননা মৃন্ময় নন্দীর নামটাই ছিল সেই অঞ্চলের শ্রেষ্ঠ বোর্ড লিখিয়ের ব্র্যান্ডনেম।

 

আজ নিজে সেই কাজ করতে গিয়ে সময়কালে সেগুলি মনোযোগ দিয়ে না-দেখার জন্য, করণকৌশল লক্ষ্য না-করার জন্য সুমনের ভেতরে আপশোষ দেখা দিয়েছিল। বুঝেছিলেন প্রণবদাকে ন্যালাখ্যাপা মনে হলেও সেই ছোট্ট কোম্পানির ততোধিক ছোট্ট সাইনবোর্ডটির স্কিম বা পরিকল্পনাটি ছোটো ছিল না―আজ বুঝলেন―সে ছিল এক গবেষণার ব্যাপার। এই কারণেই শুধু তাঁর মা নন, মহাজনেরা বলে গেছেন জীবনের ধন কিছুই একেবারে অপ্রয়োজনীয় নয়―কোনো না কোনো সময় তা কাজে লেগেই যায়।

প্রথমদিকে তাঁর বিষণ্ণতার আরও একটি কারণ ছিল। আর্টিস্ট হওয়ার শোণিতান্তর্গত বাসনার কারুকৃতি নিজের ছায়ার মতো তাঁকে অনুসরণ করছিল।

ইতোমধ্যে কলকাতায় তিনি বারকয় গিয়েছিলেন, কিন্তু বাড়িতে যাননি। ততদিনে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে, তাঁর আর নিজের কোনো বাড়ি নেই। পরিবার থেকে, যে-কোনো পারিবারিক বন্ধন থেকে, পারিবারিক ঐতিহ্য থেকে তিনি মুক্তি পেয়েছেন―ফ্যামিলি ট্রি থেকে, আবহমানকালের বংশ পরিচয় থেকে শিকড় উপড়ে তিনি উৎখাত হয়েছেন, শুকনো পাতার মতো খসে পড়েছেন নিষ্পরিচয়ের আবিশ্ব শূন্যতায়। সুধাময়ের শুশ্রূষায়, গোপাল বাড়ুজ্যের ছোটো ঘরটির আপ্যায়ন ও অভ্যর্থনা লাভ করে তিনি দেখলেন―এ তো একরকম ভালোই হলো। সুতরাং নিজেই নিত্য-নতুন অক্ষরের ছাঁদ তৈরির মধ্যে দিয়ে সে-অসুবিধাকে অতিক্রম করলেন সুমন। সুধাময়সহ তাঁর কৈশোরকালের এই গঞ্জটির মেরু-সংঘর্ষে কলকাতার চৌম্বকশক্তিও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে শূন্যবিন্দুর দিকে ধাবিত হচ্ছিল। ফলত মনখারাপগুলো আর তেমনভাবে স্পর্শ করতে পারছিল না তাঁকে।

সাইনবোর্ডের বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ ইতিহাসকে মনে রেখে ক্রমাগত ‘একটা নতুন কিছু’ করার আনন্দ তাঁর মধ্যে স্থায়ী থেকে স্থায়ীতর হচ্ছিল।

বাড়ির আওতার ভেতরে, মূল বাড়ির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে খানিকটা পেছন-ঠেলা অনেকটা শহুরে আউট হাউজের মতো সুমনের টিনের চালা-দেওয়া কুটির। টিনের শেড দেওয়া পুবের বারান্দাটা বাড়ি-ঘিরে চলে যাওয়া মাটি আর কাঁকড়ের রাস্তাটার দিকে মুখ করা।

কলতলাটা একটু দূরে, এই চালার পিছনদিকে।

ব্রাশ মুেখ কলতলার দিকে যাওয়ার সময়―সকালের রোদহীন রাস্তা দিয়ে বেশ বড়ো ঝুড়ি কাঁখে এগিয়ে যাওয়া যতীশের মায়ের সাইড প্রোফাইল নজরে এল।

ভাঙাচোরা সেই মুখে সময়ের অজস্র রেখাঙ্কন। অবিরল শ্রমের মুদ্রণ।

ঝুড়ির বাইরে কচুর ডাঁটার লম্বা ও সরু ডগাগুলো বেরিয়ে আছে। ঝুড়ির ভারে নিজের বাঁদিকে অনেকটা হেলেও ঝুড়িটাকে কাঁকালের সঙ্গে ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাচ্ছে। শির-ওঠা শীর্ণ হাতের রূপোর বাঁকাচোরা রুলিটা ঝুড়ির বাঁধালে লটকে আছে যেন। পরনের জ্যালজ্যালে কালা-পাড় ধুতির মতো শাড়িটা গায়ের সঙ্গে লেপটে আছে।

গন্তব্য রেলবাজার।

অন্যদিন যতীশ শাক ভর্তি এই ঝুড়ি, ছালার মধ্যে পোটলা করে বাঁধা শাক-ডাঁটা, টুকিটাকি তরিতরকারি, কচু-ঘেঁচু সব কিছু সাইকেলের রডে, কেরিয়ারে বেঁধে েসদিনের বিক্রেয় বাজারে পৌছে দিয়ে আসে। পরে মা গিয়ে দোকান পাতেন।

কিন্তু আজ তা হবার নয়।

যতীশ আর শিবেন গঞ্জের বাইরে গেছে ‘দিয়াল ফাঁকাতে’ অর্থাৎ কিনা দেয়াল লিখতে!

যতীশের সাইনবোর্ড লেখার আয় তো এত সুনির্দিষ্ট নয় যে তার মা দেন-সওদা বন্ধ রেখে বিশ্রাম নিতে পারবেন।

একটা অননুমোদিত দীর্ঘশ্বাস বুকের কোটরে আটকে থাকল সুমনের।

পৃথিবীর সব মায়েরা প্রায় একইরকম হন।

সারাদিন দুই সহকারীকে নিয়ে সুমন কাজ করেন। দুপুরের খাবার আসে সুধাময়ের বাড়ি থেকে। সন্ধ্যেবেলায় আড্ডা মারেন গোপাল বাড়ুজ্যের দোকানে, আড্ডা সেরে সেখান থেকে সুধাময়ের সঙ্গেই ওর বাড়িতে গিয়ে রাতের আহার সারেন। বুধবার সুধার নটকনা বন্ধ, সেদিন হাতের কাজে সহকারীদের লাগিয়ে দিয়ে তিনি আর সুধা ঘুরে বেড়ান ছায়াময় শৈশবের মাঠে-ঘাটে। ছেলেবেলায় গঞ্জের দিনগুলি ছাড়া এত স্বস্তিতে, এত নিবিড়তায় কোনোদিন তাঁর যাপনের প্রহর কাটেনি।

সমস্যা হয় এই এমন দিনে, যখন শিবেন আর যতীশ দিন কয়েকের জন্য উধাও হয়ে যায়। ঠিক উধাও বলা যায় না, তারা বলে-কয়েই যায় দলের হয়ে দেয়াল লিখতে―সোজা ভাষায় ওয়ালিং করতে।―ব্রিগেডের সভা বা বিবিধ দলীয় কর্মসূচি। এই গঞ্জ ছাড়াও ওরা হায়ার হয়ে যায় সিড়িকোড্ডে, বকুলপুর, তালকোড্ডে, সিড়িঙ্গে, শিমলেহাটা, বহিরগ্রাম, ডিহাদা, কুমড়াডিহি, কর্ণপুরা ইত্যাদি দশটা গ্রামে। গঞ্জ ছেড়ে দিন-কয়েক কাটিয়ে আসে বাইরে বাইরে। এখানে আসার পর একটা পঞ্চায়েত ভোটও পার করেছেন সুমন। তখন মাসাধিককাল  নিজেদের রোজগারপাতি বাদ দিয়ে শিবেন আর যতীশ দেয়াল লিখে বেড়িয়েছে।

সুমন বারণ করেননি। এমন হায়ার হয়ে দেয়াল লিখতে যাওয়ার কী যে মজা, তা সুমন সকলের থেকে ভালো জানেন?

দেয়াল লেখার সূত্রে কত কত নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, কতকিছু জানার চৌহদ্দি পেরিয়ে যায়, কত বাড়ির জানালায় ষোড়শী-সপ্তদশীর কৌতূহলী দৃষ্টি-শায়ক ইন্দ্রজালিক কুহকের মতো ছড়িয়ে যায় রাত্রিকালীন নক্ষত্রমণ্ডলে, কত ভুল জানার সঙ্গে বিনিময় হয় কত অজানিত অভিজ্ঞতার―তার ইতি-ইয়ত্তা নেই।

সোনাবন্ধঘাটে দেখা মিলেছিল মিরাজের। বছর সতেরো-আঠারোর টাটকা ছেলে। যে-দুদিন সুমনরা সেখানে ছিলেন সেই দুদিন মিরাজ এক মুহূর্তের জন্যও সুমনদের সঙ্গ ছাড়েনি―নির্দেশনামাফিক রঙ গুলে দিয়েছে, তুলি ধুয়ে দিয়েছে, রঙের হাঁড়ি, লেখার সরঞ্জাম এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল পর্যন্ত বয়ে দিয়েছে, হাতে হাতে যোগান দিয়েছে প্রয়োজনীয় তুলি, অক্ষর ভরাট করেছে, রঙ গড়িয়ে গেলে হাতের কাছে ন্যাকড়া মজুত রেখেছে, রঙের কৌটো ধরে পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছে, আশপাশের বাড়ি থেকে ঘন ঘন চা বরাত দিয়ে এনে খাইয়েছে!

দেয়াল লিখতে লিখতে মিরাজের সঙ্গে গল্প জমে উঠেছে। লেখাপড়া মন দিয়েই করে মিরাজ। মাধ্যমিকে ভালো রেজাল্ট করেছে সে। আরও পড়তে চায় সে, কিন্তু লেখাপড়া শিখে সে চাকরি করতে চায় না। সে কী-না নতুন অমলের মতো। পণ্ডিত হতে চায় না সে। সে চায়―এমন রঙের হাঁড়ি নিয়ে সে ঘুরে ঘুরে দেয়াল লিখে বেড়াবে। চারপাশে, সমস্ত পৃথিবী জুড়ে যত অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন বঞ্চনা সব কিছুর বিরুদ্ধে সে দেওয়ালে বার্তা দিয়ে লোক জাগিয়ে ফিরবে। এঁকে দেবে মুষ্টিবদ্ধ হাত, প্রত্যয়দীপ্ত মুখ, শ্লোগানের স্বরলিপি। সেই বাতিওয়ালার মতো―যে সন্ধ্যায় রাজপথে-পথে বাতি জ্বালিয়ে ফেরে, অথচ নিজের ঘরে নেই যার বাতি জ্বালার সামর্থ্য।

এই সোনাবন্ধঘাটেই রাত জেগে দেয়াল লেখার পুরস্কারস্বরূপ জুটেছিল কিং-সাইজের রসগোল্লা―প্রতিটি শব্দ-পিছু একটা করে! কিং-সাইজের ইয়া ইয়া সিঙারা প্রতিটি লাইন-পিছু একটা করে! হ্যাঁ ঐ রাত্রে গরম গরম ভাজা সিঙারা!

―‘এসবই হলো সোমেশ ময়রার দোকানের। সোমেশ ময়রা নিজে কিং-সাইজের মানুষ, ছ-ফিট লম্বা দেড়শো কেজি ওজন। তাঁর দোকানের সব জিনিসও কিং-সাইজের!’ বলেছিল মিরাজ―‘শরীরের মতো সোমেশকাকার ভেতরটাও বিরাট। এই সব খাবারই তাঁর উপহার, স্পনসর্ড!’

দেয়াল লিখতে গিয়ে এমন অনেক মানুষের বিরাট হৃদয়ের, দলের প্রতি ভালোবাসা ও আনুগত্যের পরিচয় পেয়েছিলেন সুমন।

সেই তিনি কী করে ‘দিয়াল ফাঁকানো’র কাজ থেকে যতীশ আর শিবেনকে প্রতিনিবৃত্ত করবেন?

বরং আবহমানকালের বাতিওয়ালার মতো নিজেদের ঘরেই জমে থাকা দুঃসহ অন্ধকারকে তারা যদি উপেক্ষা করে সকলের জন্য রাজপথে বাতি জ্বালানোর কাজে যোগ দিতে পারে তো তার থেকে ভালো আর কী হতে পারে!

দেয়াল লেখার বয়সের কোনো গাছপাথর নেই, তা প্রায় প্রাগৈতিহাসিক কালেরই কথা। সংকেতে তার শুরু, চিত্রে তার মূর্ততা, প্রকাশ্য বয়ান ও প্রচারণায় তার চলন। দেওয়ালের আঁচড়ে ফুটে-ওঠা মানবেতিহাসের অনেকটা, মানুষের বেঁচে থাকার অভীপ্সাগুলির এক-একটা চেহারা, ক্ষমতার প্রতীক বা রাষ্ট্রীয় নির্দেশনা, যুগ ও সময়লীন নাগরিক-ব্যবহারের উদ্ভাস, সৌন্দর্যের অচিহ্নিত মাত্রা অথবা মনোলিথিক যুগেও ইতিহাস যাকে লিখে রাখে না এমন হিংসা, অসন্তোষ ও দ্রোহের অব্যাখ্যাত কোনো গোপন লিপির প্রকাশ্য বিবৃতি―এসবই কিন্তু আসলে অন্য অনেক সামাজিকের প্রকাশ্য মনোযোগ আকর্ষণের প্রয়াসী।

‘হরফের হেরফের ঘটানো কারিগর’ কিংবা ‘রাস্তার শিল্পী’ বলে সহপাঠী ও অনিন্দিতার বাক্যবাণে সেদিনের সুমনের আহত হওয়ার লজ্জা আজকের দিনে যতীশ-শিবেনই যেন অপনোদন করেছে। জীবনের বেদনার হিসেব মানুষ নিরন্তর ক্ষুব্ধ-আক্রোশে লালন করে চলে, কিন্ত পুরস্কার যে কার হাত দিয়ে, কখন করুণাধারার মতো এসে পৌঁছয় তার পরিতৃপ্তিটুকু নিঃসংকোচ-আনন্দে উপভোগ করতেও মানুষ ভয় পায়।

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *