সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪৩। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

ত্রিলোকধারী, মহাসন্ত ও অন্যরা
লিংউড এবং জগদীশ কাশ্যপের সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মে উৎসাহী ত্রিলোকধারীর আলাপ হয় রাজগীরে। এঁরা দুজনে যখন কালিম্পং-এ থাকতে এলেন, তরুণ ত্রিলোকধারীও পিছন পিছন এলো, ধর্মোদয় বিহারে তাঁদের সঙ্গে একসঙ্গেই থাকতে শুরু করলো। কাশ্যপ বিহার ও কালিম্পং ত্যাগ করলেন, ত্রিলোকধারী থেকে গেলো, সঙ্ঘরক্ষিতার ভিক্ষাভাণ্ডের প্রতিদিনের সঞ্চয় দিনশেষে দুজনে ভাগ করে খাওয়া হতো। যে তরুণের সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠ বসবাস করছেন লিংউড, তার ছবি:
মাঝারি, রোগাটে গড়ন…মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, সেখান থেকে একটা গিঁটপাকানো টিকি বেরিয়ে আছে, বর্ণহিন্দুদের যেমন হয়। একমাথা চুলের নিচে চ্যাপ্টাগোছের বাদামি মুখ, তাতে ঢেউখেলানো ঘন ভুরু, কোটরে ঢোকানো, বাদামি, কুঁতকুঁতে একজোড়া চোখ, চোখের কোণগুলো খুব হলদে, যেন লাম্পট্যলোল। পরণে লম্বা নীল নীল চাপা ওয়েস্টকোট, তলায় কলারহীন দিশি কুর্তা, একটা মাঝারিমাপের ধুতি। তিনটেই তাঁতে বোনা খসখসে খাদির, কংগ্রেসি বা গ্রামসেবকেরা যেমন পরে আরকি, বিচ্ছিরি রকমের কুঁচকোনো, যেন এক্ষুনি ইস্তিরি দরকার। বাদামি পা দুটোয় মোজা নেই, সেগুলো সাইজ কয়েক বড়, ঢলঢলে একটা গোড়ালি-উঁচু জুতোয় ঢোকানো, হাঁটলেই ক্রমাগত নামে আর ওঠে( গুচ্ছ গুচ্ছ ভারতীয়দের মতোই, ও হাঁটতো পা দুটোকে সামনের দিকে বিদঘুটে রকমের ভেঙে)। মাথার এক কোণে বসানো একটা কাপড়ের টুপি, যা দেখে বোঝা যায় ও আসলেতে গান্ধীবাবার চ্যালা, এবং খাঁটি কংগ্রেসি…আধুনিকতার চিহ্ন হিসেবে ওর কাছে থাকতো সস্তাদামের একটা ফাউন্টেন পেন, একটা রোদচশমা, ঘাড়ের ওপরে বেপরোয়াভাবে ফেলে রাখা একটা গামছা….
প্রায় ডিকেন্সিয় ধরণে বলা এ ছবি যত না মজার তার চাইতে অনেক বেশি নির্মম। বোঝা যায়, ভিক্ষু হলেই বা, দয়াধম্মে লিংউড সাহেবের বিশেষ বিশ্বেস ছিলো না। কংগ্রেসি রাজনীতি বা গান্ধিবাদের প্রতিও তিনি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। ত্রিলোকধারী প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে লিংউড জানাচ্ছেন, স্রেফ বিহারে এলে, এসে থাকলে, বা ভিক্ষুদের একনিষ্ঠ সেবা করলে কীই বা হয়, সবাই তো আর ভিক্ষু হবার জন্য জন্মায় না। ত্রিলোকধারী ব্যাটার ধ্যানতপস্যা ইত্যাদিতে মন ছিলো না, যত তাকে বলা যাক, মনকে সে কিছুতেই আর বশে আনতে পারে না। একদিন লিংউড চেপে ধরলেন, জেরায় ভেঙে পড়ে ত্রিলোকধারী জানালো, তার লাম্পট্যপাপের অন্ত নেই, দেশে থাকতে সে গান্ধিটুপি এবং কংগেস দেখিয়ে গাঁয়ের বিস্তর মেয়েদের নষ্ট করেছে(গ্রামের দিকে এইটাই রেওয়াজ ছিলো, লিংউডের সংযোজন), সে কথা তার বারবার মনে পড়ে। সে এমন পাপী, একদিকে নিজে এইসব করে বেরিয়েছে, অন্যদিকে অন্যদের চরিত্রদোষ ধরতে তৎপর, যেমন, এক জৈন সাধু কোন একটা ঘরে এক মহিলার সঙ্গে নষ্টামি করছিলো, ত্রিলোকধারী অন্য গ্রামবাসীবৃন্দ সমভিব্যাহারে সেখানে গিয়ে তাকে যাকে বলে ‘লাল-হাতে পাকড়ে’ ফেলে উত্তমমধ্যম দেয়। লিংউড বলছেন, ছিছি, কী পাপ কী পাপ, নিজে চরিত্রভ্রষ্ট হয়ে অন্যদের চরিত্রদোষ দেখা, এমন পাপ করে যে, সে কিকরে সদধর্ম পালন করবে, ভিক্ষু হয়ে বিহারে থাকবে? অদৃষ্টের এমন কল, জীবনের শেষদিকে লিংউডকেও সমতুল পাপের দায় নিয়ে, একের পর এক সঙ্ঘ ও বিহার ছাড়তে হয়েছে। সে কথায় ফিরবো।
(ক্রমশ)