অকূলের কাল। পর্ব ১৭। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

 

আলবোলার মূর্ছনা

গোলাপের বদলে দোলনকে কী উপহার দেওয়া যায় ভাবতে ভাবতে ক্ষিতি বোকার মতো অভীকের কাছে টাকা ধার করে হাতিবাগানের একটা সোনারূপার দোকান থেকে পঁচিশ টাকা দিয়ে একটা আংটি কিনে ফেলল। দোকানের নাম অঞ্জলি জুয়েলারস। দোলন মনে হলো খুশিই হয়েছে। জিজ্ঞেস করল, কোত্থেকে কিনলে? দোকানের নাম বলতেই জলতরঙ্গ হাসি। থামেই না। কোনোরকমে একটু থেমে বলল, – ওটা আমার ন’দার দোকান। বলেই আবার খিলখিল হাসি।

হতভম্ব ক্ষিতি। ‘সালংকারা’র দোকান থেকে আংটি কিনে ‘সালংকারা’র মেয়েকেই উপহার দেওয়া! গঙ্গাজলে গঙ্গাপূজা। মাসি আংটি দিয়েছে বলে বাড়িতে ম্যানেজ করেছিল দোলন। কিন্তু সেই আংটি তার আঙুলে বেশিদিন রইল না।

প্রথম থেকেই তাদের প্রেম-পর্ব মিলন-কম বিরহ-বেশি নিয়ে এগিয়ে চলেছিল। দু-তিন মাসে একবার করে মাত্র বেরোতে পারে দোলন। ভর দুপুরে বেরোয়। ক্ষিতি হেদো থেকে একটা ট্যাক্সি ধরে, দোলনের বাসে চড়ার অভ্যেস নেই। তাছাড়া বাসে চড়লে ধরা পড়ার সম্ভাবনা বেশি। কাজেই ঘুরতে যাওয়ার মাসে ক্ষিতির বাড়ি থেকে আসা মাসোহারায় টান পড়ে, বন্ধুদের কাছে হাত পাততে হয়।

ঘুরতে যাওয়ার জায়গা প্রথম বার-কয়েক ছিল ভিক্টোরিয়া আর বোটানিক্যাল গার্ডেনস। তেমনই এক বিকেলে ভিক্টোরিয়ার ঘাসে পাশাপাশি বসেছিল দুজনে। দোলনের আঙুলগুলি নিয়ে আনমনে খেলছিল ক্ষিতি। খেলতে খেলতে কখন যে তার আঙুল থেকে সে-আংটি খুলে ঘাসে লুকিয়ে পড়েছে দুজনের কেউই খেয়াল করেনি। খেয়াল যখন হলো তখন তাদের বসার জায়গা বদলে গেছে। পুরনো জায়গা আন্দাজ মতো বের করে সেখানে বহুক্ষণ খুঁজল দুজনে। বৃথাই। মনে খারাপ করে যে যার জায়গায় ফিরতে হয়েছিল সেদিন।

তারপর থেকে ভিক্টোরিয়া পরিত্যক্ত। তার বদলে তাদের ভ্রমণকুঞ্জ স্থায়ী হলো গিয়ে চিড়িয়াখানায়। সপ্তাহের কাজের দিনে তাদের যুগল-বিহার, সেদিনগুলোয় চিড়িয়াখানা শুনশান। দুপুরবেলায় পশুপাখিরাও মানুষ দেখতে না পেয়ে বোধ হয় মুহ্যমান থাকে। সেই সুযোগে কোনো ঝোপের আড়ালে বসে পড়ে দু’জন। কথা বলে ক্ষিতি, ফোনের অভাবেই হয়তো দোলন ঠোঁট ফাঁক করতে চায় না সচরাচর। নিরুপায় ক্ষিতি তাই মাঝে মাঝে নিজের দুই ঠোঁট দিয়ে তার ঠোঁট ফাঁক করার ফিকির খোঁজে। কিন্তু তখন দোলন, না কি তার ঠোঁট, একটু জেদি হয়ে ওঠে। বিশেষ প্রশ্রয় দেয় না ক্ষিতির ঠোঁট দুটিকে।

 

শেষ বিকেলে হোস্টেলের তিনতলার ছাদে ব্রিজের আসর বসেছে। কিন্তু এই সময়টায় আসর বসলে ক্ষিতি বড়োই আনমনা থাকে। ফোনটা তার এই সময়ই আসে। একতলায় ফোন বাজলে তিনতলায় তার আওয়াজ পেতে কানমগ্ন থাকতে হয়। বন্ধুরা জানে ক্ষিতির অলৌকিক কানমগ্নতা। খেলার মাঝখানে সহসা লাফ দিয়ে উঠে সে সিঁড়ির দিকে ছুটে যাওয়ার পরেই তাদের খেয়াল হয়, কিরিরিং কিরিরিং করে ক্ষীণ একটা আওয়াজ হচ্ছে ঠিকই। আরও আশ্চর্য, ক্ষিতি যখন নামতে নামতে দেড়তলায়, তখনই ফোন তুলে ঠাকুরের ডাক, –ক্ষিতিদার ফোন।

অরূপ তখন ঠোঁটের মাঝে গোটা পাঁচেক তাস ধরে দুই হাতে বাকি তাসগুলো সাজাতে সাজাতে বলে, –শালা কাকু কীকরে বোঝে মাইরি এই আওয়াজটা তারই আকাশবাণীর!

দিনু বলে, –কেষ্টর বাঁশি রাধা যেমন করে বুঝত, আমাদের কাকু তেমন করেই বুঝে যায়।

বলেই সশব্দে একটা কপট দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সে।

কিন্তু আজ প্রায় এক সপ্তাহ পার হয়ে গেল, শ্যামের বাঁশি শোনা যাচ্ছে না। ক্ষিতিকে হাতের তাস ফেলে রেখে সিঁড়ির দিকে ছুটে যেতে দেখা যাচ্ছে না। শচি আলবোলার কল্কেতে বিষ্ণুপুরের অম্বুরি তামাক ঠাসতে ঠাসতে বলে, –কাকু তোর কেস কী? কিচাইন নয় তো?

সপ্তাহখানেক হলো শচি বড়বাজার থেকে আলবোলার সরঞ্জামসহ সুগন্ধি তামাক কিনে এনেছে। খরচ অভীকেরই। হুঁকোর বদলে গড়গড়ার ব্যবস্থাটাও তারই নির্দেশে। এমনিতে বিড়ি সিগারেট কোনদিন ঠোঁটে তোলেনি অভীক। কিন্তু তার দাদু নাকি রুপোর গড়গড়ায় দামি তামাকের ধোঁয়া সেবন করতেন। কিছুদিন ধরেই বিড়ি সিগারেট বাদ দিয়ে হুঁকায় ধূমপানের এজমালি ব্যবস্থা করার জন্য শচি খেপেছিল। অন্যরা তেমন গা করছিল না। জানতে পেরে অভীক একদিন বলল, – শালা খাবিই যদি দু-কড়ির হুঁকা খাবি কেন! আলবোলার ধোঁয়ায় দম লাগা। মেজাজ শরিফ হয়ে যাবে।

কাকু বলল, – এমন বলছিস যেন টেনেছিস মনে হচ্ছে! কোনোদিন তো সিগারেটও ঠোঁটে ছোঁয়াসনি।

অভীক বলল, – আমার দাদু টানত রুপোর গড়গড়া। তারই জিন তো আমার কোষে কোষে। সেই স্মৃতি ধরা আছে আমার জিনে।

শচি বলল, – বড়ো ভালো খবর শোনালি রে। কিন্তু আলবোলার সরঞ্জামে বেদম খরচ। রুপোর গপ্পো ছাড়, কাঁসা-পিতলের খরচই ঢের।

অভীক বলল, – কোই বাত নেই রে শালা, খরচ দেবে তোদের গৌরী সেন।

অতএব কাঁসার হুঁকোয় লাগানো রবারের নল লাগানো আলবোলা শচির কাঁধে চেপে এসে উনিশ নম্বরে জেঁকে বসেছে। সে আপাতত একটা টিকে জ্বালিয়ে কল্কেতে ঠাসা তামাকের উপর রেখে আলবোলার নলে মুখ লাগিয়ে জোরে জোরে টান দিচ্ছে। টান ঠিকমতো না হলে টিকে নিভে যাবে, তামাকে আগুন ধরবে না। আগুন ধরলে তামাক-পোড়া ধোঁয়া জল-ভরা কল্কেতে নামবে, তারপরে জলে ভুড়ভুড় আওয়াজ করে সেই ধোঁয়া আলবোলার নল বেয়ে শচির মুখে আসবে। গাল চুপসে প্রাণপণে হাওয়া টানছে শচি, টিকে এবার লাল হয়ে তামাক জ্বালাচ্ছে। ধোঁয়া আসছে শচির মুখে। প্রথমে কম কম, তারপরেই মুখ ভরে গিয়ে নাক দিয়ে গলগল করে ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে। ভুড়ুক ভুড়ক আওয়াজের সঙ্গে সারা ঘর মিষ্টি-মাদক খুশবুতে ভরে যাচ্ছে।

শচি এবার এক এক করে সকলের দিকে বাড়িয়ে দেবে আলবোলার নল। অভীকও বাদ যাবে না। গড়গড়া আসার পর থেকেই বিড়িসিগারেট অন্ত্যজ হয়ে গেছে। হস্টেলে তো নয়ই, বাইরে বেরিয়েও পারতপক্ষে কেউ বিড়ি সিগারেট ধরাচ্ছে না। অম্বুরি তামাকের পর সেসব নেহাতই পানসে লাগে। কলেজ যাওয়ার আগে সবাই মিলে বসে এক প্রস্থ তামাকু সেবন সেরে নেয়, ফিরে এসে সন্ধেবেলায় আর একবার। তাতেই মনপ্রাণ ভরে থাকছে। শচির মতো পাক্কা নেশাড়ু ছাড়া কেউ এখন পায়খানায় বসেও বিড়িসিগারেট ধরায় না।

অসুবিধে একটাই। শচি ছাড়া আর কেউ গড়গড়ার তামাকে আগুন দেওয়ার ভজকট বিদ্যা রপ্ত করতে পারেনি। কোনো কারণে সে হস্টেলে অনুপস্থিত থাকলেই ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে যায়।

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *