সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ১৬। লিখছেন অলোক সান্যাল

সেই আশ্চর্য লোকটা
………………………………….
ফাইলটা খুঁটিয়ে পড়ছিল সামিরা। চার্চ ট্রেজারী লাগোয়া একটা ব্যক্তিগত ঘর। ছোট্ট, কিন্তু দরকারী। এই সময়টায় সংগ্রহশালায় পর্যটকদের ভিড় থাকে। আজও আছে। সামিরার দু’জন সহকারী। তারাই টুরিস্টদের কৌতূহল মেটাচ্ছে। ফাইলে চোখ বোলানোর পাশাপাশি অভ্যাসবশত মাঝে মাঝেই কাচের দরজা দিয়ে তার নজর বেরিয়ে যাচ্ছিল। বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে এক অল্পবয়সী কিশোরী। কিং শার্লামেনের সোনার পানপাত্রের সামনে দাঁড়িয়ে। তড়বড়িয়ে কিছু বলে চলেছে। হয়তো বৃদ্ধ দম্পতিকে তার নাতনি ইতিহাসের পাঠ দিচ্ছে। তার বলা কথাগুলো অবশ্য কাচের দরজাকে এড়িয়ে সামিরার অফিস ঘরে প্রবেশের অনুমতি পাচ্ছে না। সেদিক থেকে নজর ফিরিয়ে আবার ডেস্কে থিতু হতেই সকালের কাগজে চোখ পড়ল। প্রথম পাতার বড়ো হেডলাইনের অর্ধেক চাপা পড়েছে ফাইলের নিচে। যদিও তাদেরই তৈরি, তবুও ছাপার হরফে নতুন করে পড়তে পড়তে মুহুর্তের জন্য মন ভিজে উঠল। পাদরি নিকোলাসের মৃত্যুর কারণকে সংবাদ মাধ্যম দারুণভাবে ব্যাখ্যা করেছে। ঠিক যেমনটি তারা চেয়েছিল। পৃথিবীতে এখন খুব কম খবরের প্রকৃত জন্ম হয়। অধিকাংশই ক্ষমতাশালীরা চার দেয়ালের ভেতর তৈরি করে। পাদরি নিকোলাসের মৃত্যুর পাশাপাশি ইন্টেরিম হেড হওয়ার্ড লেভিও শিরোনামে ঠাঁই পেয়েছেন। যৌন কেচ্ছায় ম ম করছে কাগজের পাতা। প্রচারমাধ্যম বরাবরই যে-কোনো ধরনের কেলেঙ্কারির ওপরে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়। ইন্টেরিম হেডের তুম্বো মুখ কল্পনা করে দুঃশ্চিতার মাঝেও সামিরার হাসি পেয়ে গেল। হাওয়ার্ড লেভি সকালেই হত্যে দিয়েছিল। মিডিয়ার সামনে তার হয়ে সাফাই গাইতে হবে। সামিরা হাঁকিয়ে দিয়েছে৷ কাল দুপুরের পর থেকেই চার্চের ইতিউতি ফিসফাস শুরু হয়ে গেছে। হওয়ারই কথা। সুপ্রাচীন এই উপাসনালয়ের গায়ে গর্হিত অপরাধের দাগ। এমন দাগ যা সহজে মোছা যাবে না। খ্রিস্টের সেবক হয়ে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত! সামিরার সামনে যদিও অনেক জটিল সমস্যা, তবুও আশেপাশের ঘটনাপ্রবাহ থেকে নিজের ছোঁয়া বাঁচিয়ে রাখা যায় না।
‘নাহ্, আসল কাজে মন দাও মেয়ে। খুঁজতে থাক। কিছু না কিছু সূত্র এই কাগজগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে। শুধু ধৈর্য্য ধরে তুলে আনতে হবে।’
নিজেকে বলল সে। অবশ্য অনুসন্ধানে পুনরায় নেমে পড়ার আগেই মাথা তুলতে হলো তাকে। চার্চ লাইব্রেরিয়ান নাওমি দরজার সামনে হাজির হয়েছেন। ইশারা পেতে দরজা অর্ধেক খুলেই ত্রস্তভাবে কথাগুলো ভেতরে ছুঁড়ে দিলেন তিনি, ‘খবর শুনেছ?’
এই দুটো শব্দ সামিরা সকাল থেকে অনেকবার শুনে ফেলেছে। যা ঘটছে এবং যা ঘটতে চলেছে, সবই তার জানা। আরও ভালো করে বললে তার তৈরি। তবুও চোখেমুখে বিস্ময়ের ভাব ফুটিয়ে তোলা থেকে সে নিজেকে বিরত করল না।
‘আবার কিছু হলো নাকি? মিডিয়ার হামলা?’
‘আরে ধুর… সে তো সকাল থেকেই চলছে।’
যেন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ খবরটা কানে না নিয়ে সামিরা কোনো দণ্ডনীয় অপরাধ করে ফেলেছে!
‘চারিদিকে যা চলছে, তার পরেও তুমি যে কীভাবে এখানে নিশ্চিন্তে বসে আছ, জানি না। ছুটে মরছি আমি।’
মধ্যবয়স্কা লাইব্রেরিয়ানকে সকলেই চেনে। পরিচিতদের জীবনে ঢুঁ মারা স্বভাব। আর তারপর যা শুনেছেন, তার সত্যমিথ্যা যাচাই বিনা প্রচার করা। সুতরাং সেন্ট-মরিস চার্চকে ঘিরে যে বিতর্ক দানা বেঁধেছে, তাতে লাইব্রেরিয়ান নাওমির পক্ষে সুস্থিরভাবে নিজের চেয়ারে বসে থাকা খুবই কষ্টকর। হেসে জবাব দিল সামিরা, ‘কী করি বলুন? ট্রেজারী বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত আমার কি আর নড়ার উপায় আছে। আবার নতুন কিছু ঘটল নাকি?’
‘নতুন এবং বড়ো খবর সামিরা। ভাটিকান থেকে উড়ে এসেছে একেবারে!’
শেষের কথাগুলো বেশ গদগদ চিত্তে বললেন লাইব্রেরিয়ান। দু হাত নাচিয়ে দরজা থেকে পাঁচ পা দূরত্ব খরগোশ ছানার মতো লাফিয়ে এসে বসলেন টেবিলের উলটো দিকে। যদিও কেউ কান পাতলেও বদ্ধ ঘরের আলাপ বাইরে পৌঁছাবে না, তবুও তিনি জিরাফের মতো গলা এগিয়ে দিলেন সামিরার দিকে। তারপর কণ্ঠস্বর প্রায় খাদে নামিয়ে বললেন,
‘চার্চ অ্যাবটকে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ এসেছে! আর ওই নরকের কীট লেভিকেও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ভাটিকানের সরাসরি নির্দেশ। বুঝতে পারছ?’
বক্তব্য শেষ করে সোজা হলেন লাইব্রেরিয়ান নাওমি।
‘সেকি! অ্যাবটকেও সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে নাকি? তিনি তো এসব কেলেঙ্কারির সঙ্গে যুক্ত নন!’
‘সরাসরি না হলেও, দায়িত্ব বলে একটা কথা আছে সামিরা। ভুলে যেও না।’
ভীষণ গম্ভীর সুরে দায়িত্ববান নাগরিকের মতো বললেন নাওমি, ‘এতকিছু হচ্ছে, আর তিনি চোখ কান বুঁজে থাকবেন! যদি কিছু চোখে পড়েও যায়, চাপা দেবেন! ছাই দিয়ে কি আগুনকে চাপা দেওয়া যায়?’
চার্চ অ্যাবটের ওপরে ভদ্রমহিলার ক্ষোভ সঙ্গত। বেচারিকে লাইব্রেরি ছেড়ে উড়ে বেড়ানোর জন্য মাঝেমধ্যেই ধমক খেতে হতো। সামিরা ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে বলল, ‘ঠিক বলেছেন। দায় তো নিতেই হবে। তা নতুন চার্জ নিচ্ছেন কারা? নামধাম কিছু শুনলেন নাকি?’
লাইব্রেইয়ান বেশ উৎসাহে কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, সামিরার প্রশ্নে থমকে গেলেন।
‘এই যাহ্… সেটাই তো জানা হয়নি!’
বলেই লাফিয়ে চেয়ার ছাড়লেন নাওমি।
‘লাইব্রেরিতে আজ বিস্তর কাজ পড়ে আছে, আর এদিকে এসব ঝামেলা। চলি হে, আমি না থাকলে সবকটা শুধু বসে বসে ঢোলে।’
প্রায় হরিণের ক্ষিপ্রতায় দরজা খুলে আলো-আঁধারে ভরা গ্যালারি ছেড়ে উধাও হয়ে গেলেন লাইব্রেরিয়ান। স্বস্তির নিশ্বাস নিল সামিরা। লাইব্রেরিয়ান নাওমির সঙ্গে মিনিট খানেক কাটানোও তার কাছে দুঃসহ মনে হয়। তবে এবার ভদ্রমহিলা একটা কাজের খবর দিয়ে গেছেন। ভাটিকানে চক্রের কেন্দ্রীয় সদস্যরা যে এত দ্রুত পদক্ষেপ নিতে পারবেন, সে আশা করেনি। বদলি হিসেবে কে আসছে জানাটা তার কাছে অতটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। নির্ভরযোগ্য কেউ আসবেন নিশ্চয়ই। এখন সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর চেয়ে জরুরি হলো মিলার ভাইবোনকে খুঁজে বের করা। কাচের দরজা দিয়ে চট করে সংগ্রশালার ভেতর চোখ বুলিয়ে নিল সে। ফাঁকা হয়ে এসেছে। এখন দুটো দশ। কুড়ি মিনিট পর ট্রেজারী সেকশন বন্ধ হয়ে যাবে। টেবিল থেকে ফাইলটা তুলে সামিরা বাইরে বেরিয়ে এল। চোখাচোখি হতেই তরুণ সহকর্মীর উদ্দেশে বলল, ‘বাকিটা সামলে নিতে পারবে?’
‘সময় তো প্রায় শেষ। আপনি চিন্তা করবেন না।’
ছোটো করে ধন্যবাদ জানাল সামিরা। তার এখন একটা নিরিবিলি জায়গা দরকার। চার্চ লাইব্রেরি ছাড়া অন্য কোথাও সেটা পাবে না। লাইব্রেরিয়ান নাওমি থাকলে অবশ্য পারতপক্ষে সে ওই চত্বর মাড়ায় না। তবে আজ লাইব্রেরি ছাড়া বাকি যে-কোনো জায়গায় তাঁর দেখা পাওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
পরনে সাদা কাসাক। মাথা জুড়ে কাঁচা পাকা চুল। পরিপাটি হাসি। সবচেয়ে আকর্ষক হল চোখ দুটো। গভীর এবং শান্ত। ফাদার সাইমনের ছবি দেখে সামিরার এই কথাগুলোই মনে এল। ব্রিটেনের গ্রেট মঙইয়াম চার্চের ফাদার। ছোটো গ্রামে দারুণ জনপ্রিয় ছিলেন। ড. এমা মিলারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। এছাড়া রয়্যাল ইনভেন্টার্স ছাড়ার আগে এমার সঙ্গে যারা কাজ করেছে তাদেরও বায়োডাটা রয়েছে। মেরিন আর্কিওলজিস্ট এমা মিলারের পেশাদার জীবন এই কয়েকজনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এক ফাদার সাইমন ছাড়া কেউ-ই মনোযোগ কাড়ার মতো নয়। মুশকিল হলো একটা দুর্ঘটনায় মঙইয়ামের চার্চ পুড়ে প্রায় ছাই হয়ে গিয়েছিল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ফাদার সাইমনও সেই বিধ্বংসী আগুনের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারেননি। সুতরাং তাঁকেও সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ রাখতে হয়। এমার কাছের বন্ধুদের সংখ্যা খুবই সীমিত। যারা আছে, তাদের সম্পর্কেও তথ্য জোগাড় করেছেন মি. দানিয়েল। কল হিস্ট্রি ডিটেইলস অনুযায়ী কারোর সঙ্গে মিলার ভাইবোনের নিয়মিত কথোপকথনের রেকর্ড নেই!
‘নাহ্, লোকটা খেটেছে। কোথাও কিছু ফেলে রেখেছে বলে মনে হচ্ছে না।’
স্বগোতক্তি ফুরোতে না ফুরোতে আপাত নিরীহ একটা ছবিতে তার চোখ আটকাল। ধ্বংসের পর নির্মাণের সাক্ষী। নতুন তৈরি গ্রেট মঙইয়াম চার্চ। কাজ প্রায় শেষের দিকে। আগের তুলনায় অনেক বেশি সাজানো গোছানো।
‘রীতিমতো যুদ্ধকালীন তৎপরতা দেখছি!’
সামিরাকে বিষয়টা সামান্য অবাক করল। অখ্যাত গ্রামের আরও স্বল্পপরিচিত চার্চের জন্য ইংল্যান্ডের চার্চ কমিশনারস এত দ্রুত পদক্ষেপ নিলেন! কেন? প্রশ্নটা হয়তো অকারণ, তবু সামিরা তলিয়ে দেখতে চাইল। ব্যাগ থেকে দ্বিতীয় সেলফোনটা বের করল সে। প্রথমটা সব সময় ব্যবহারের জন্য। নির্দিষ্ট নম্বরে একটা ছোট্ট মেসেজ করল সামিরা-
‘গ্রেট মঙইয়াম চার্চ নির্মাণে ফান্ডিং কারা করছে জানা দরকার।’
ফোর্ট শিন্ডের অধিকর্তাকে বার্তা পাঠিয়ে আবার গুচ্ছের কাগজে তলিয়ে গেল সে।
দানিয়েল করিৎকর্মা লোক। ঘড়ির কাঁটা আধ ঘণ্টা হাঁটতে না হাঁটতেই ‘টুং’ শব্দে নড়ে উঠল সামিরার সেল ফোন। আঙুলের ছোঁয়া পেতেই পরপর কতগুলো স্ক্যান করা কাগজ ভেসে উঠল সামিরার ফোনে। ফরোয়ার্ডেড মেসেজ। তর্জনী এবং বুড়ো আঙুলের টানে কাগজের লেখাগুলো বড়ো করল।
ইনফিনিটি লাইনস। একটা শিপিং কোম্পানি। ব্রিটেন থেকে সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, সাউথ আমেরিকার বিভিন্ন দেশে পণ্য আমদানি রপ্তানির কাজ করে। নতুন চার্চ তৈরির পুরো টাকা তারাই মেটাচ্ছে। অঙ্কটা খুব কম নয়!
‘একটা জাহাজ কোম্পানির ধর্ম নিয়ে এত মাথাব্যথা!’
কৌতূহল সামিরাকে বাধ্য করল অন্তর্জালের দুনিয়ায় পা রাখতে। নাম খুঁজে বের করার জন্য বেশি সময় খরচ করতে হলো না তাকে। জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র। চকচকে ব্যাকব্রাশ করা চুল। সানগ্লাসের কারণে চাহনির ধরন বোঝার উপায় নেই। আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব। ভদ্রলোকের পারিবারিক ব্যবসা। শিপিং লাইন ছাড়াও ব্রোকার হাউস, কনসট্রাকশন কোম্পানি রয়েছে। ব্রিটেন ছাড়া স্টেটসেও ব্যবসা ছড়ানো। দ্বৈত নাগরিকত্বও রয়েছে।
‘ধুরন্ধর ব্যবসায়ী হয়ে ভদ্রলোক গ্রেট মঙইয়াম চার্চে ফেরৎ অযোগ্য বিনিয়োগ করতে গেলেন কেন? ফাদার সাইমনের সঙ্গে সখ্যতা? তেমন হলে ড. মিলারের সঙ্গেও যোগাযোগ থাকতে পারে। থাকলে জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়রের মতো প্রভাবশালী ধনকুবেরের পক্ষেই সম্ভব দেশের বাইরেও সাহসের পরিচয় দেওয়া। একটা প্রফেশনাল টিম ভাড়া করা তো এর কাছে মামুলি ব্যাপার। সামিরার উত্তেজিত আঙুলগুলো দ্রুত আরও একটা গোপন বার্তা পাঠাল ফোর্ট শিন্ডের অধিকর্তাকে-
‘ইনিফিনিটি লাইনস। ইউ কে। কর্ণধার জোনাথন ডারওয়ার্ড জুনিয়র। লোকটার সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য জোগাড় করুন। যত দ্রুত সম্ভব।’
(ক্রমশ)