অকূলের কাল। পর্ব ১৬। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

স্বর্গদ্বারে
একটা গোটা রাত, গোটা দিন অনিশ্চয়তার মেঘ আচ্ছন্ন করে রাখল ক্ষিতিকে। পরদিনের সন্ধে ঠিক ছটায় টেলিফোনের ডাক এল। ফোন ধরতেই হাসি, –কাল দুম করে ফোন রেখে দিয়ে চমকে দিয়েছি তো! শোনো, চিন্তা করো না – এমন রোজই হতে পারে। বৌদিদের কারোর পায়ের আওয়াজ পেলেই ফোন রেখে দেব।
ক্ষিতি বলল, –কালকের কথা কোথায় শেষ করলে মনে আছে?
–আছেই তো। আবার শোনার শখ হয়েছে বুঝি! আর হবে না যাও।
–পুতুলরানি তোমার বাড়ির নাম?
–রানি-ফানি নয়, পুতুল বলে সবাই ডাকে। তুমি কিন্তু একদম বলবে না। বললে খুব খারাপ হয়ে যাবে।
ক্ষিতি বলল, –আচ্ছা আচ্ছা, বলবো না।
দোলন বলল, –তুমি যেদিন তোমার নাম লিখলে ‘খিতি’, নেটকি আমাকে বলল, ‘দেখলি তো – বলেছিলাম না ছেলেটা খেতে লাঙল টানে, নামটাও মিলে গেল কাজের সঙ্গে। তুই ওকে ‘খেতি’ বলে ডাকবি।’
ক্ষিতি গাঢ় স্বরে বলল, –তুমি যে নামেই ডাকো, আমার কানে কৃষ্ণ নাম হয়ে ঢুকবে।
–ঈশ কী আহ্লাদ!
–কী যে মিষ্টি গলা তোমার – মনে হয় চোখ বুজে তোমার কথাই শুনে যাই সারা দিন।
–শুধু গলাটাই মিষ্টি লাগে, আর কিছু ভালো লাগে না তো –
–আরও অনেক কিছু লাগে। যেদিন দেখা হবে সেদিন কানে কানে বলব। তুমি গান করো না?
–করি তো। শিখছি –
–কবে যে তোমাকে সামনাসামনি দেখব!
–আমার বেরোনোর খুব অসুবিধে – জানো। দাদারা একা কোথাও যেতে দেয় না। শুধু বাড়ি থেকে মামাবাড়ি আর মামাবাড়ি থেকে বাড়ি একা একা যেতে দেয়। নেটকি বলেছে ওই সময়টাকে কাজে লাগাতে হবে। ওর খুব বুদ্ধি! কিছু একটা ব্যবস্থা করবেই। আমারও তোমাকে কাছাকাছি দেখতে ইচ্ছে করছে খু-উ-ব!
–তোমার বাড়িটা কোথায়? কতদূরে?
–এই তো কাছেই। তোমার হস্টেল থেকে বেরিয়ে হরি ঘোষ স্ট্রিট দিয়ে বিডন স্ট্রিটের দিকে হাঁটবে। তিন-চার মিনিট হাঁটলেই কাশী বোস লেন বাঁ দিকে ঢুকছে। কাশী বোস লেন পেরিয়ে গিয়েই প্রথম বাড়িটা। চারতলা বাড়ি। ২৮ নম্বর। বাড়ির নাম সালংকারা। কাল বিকেলে হাঁটতে হাঁটতে আসবে? আমি তিনতলার ব্যালকনিতে থাকব।
–সালংকারা? গয়না পরে থাকা মেয়েকে তো সালংকারা বলে। বাড়ির নাম সালংকারা কেন?
এক প্রস্থ হাসি ঝরিয়ে দিয়ে তার বাড়ির ব্যাপারে অনেক কথাই বলে গেল দোলন। তার ছয় মাস বয়স হওয়ার আগেই মা বাবা দুজনেই মারা গেছেন। সে মামাবাড়িতে দিদিমার কাছে বড়ো হয়েছে। পাঁচ দাদা, দুই দিদি। দিদিদের বিয়ে হয়ে গেছে। তাদের শ্বশুরবাড়ি কাছেই। দাদাদের সোনারূপার ব্যবসা। বড়বাজারে পাঁচটা দোকান। তিনটে বাড়ি। দুটো হরি ঘোষ স্ট্রিটে, একটা বিডন স্ট্রিটে। একটা বাড়িতে নিজেরা থাকে, বাকি দুটো বাড়ির কিছুটা অংশ ভাড়া দেওয়া, কিছুটা অংশে সোনা রূপার অলংকার তৈরি হয়। সেজন্যেই বাড়ির ওই নাম।
ক্ষিতিও জানাল তার বাড়ির খবর। মেদিনীপুর জেলার পশ্চিম প্রান্তে এক অজ গাঁয়ে তার বাড়ি। সেখানে বিদ্যুতের আলো যায়নি, পাকা রাস্তা নেই। তাদের অনেক চাষের জমি আছে। ক্ষিতির জেঠা, বাবা, কাকার একান্নবর্তী পরিবার। অনেক ভাই বোন ভাইপো ভাইঝি।
পরের দিন কলেজ থেকে ফিরেই ক্ষিতি তার মাথাভর্তি বেয়াড়া চুলগুলোকে চিরুনির শাসনে আনার ব্যর্থ চেষ্টার পর প্রায় চোখের উপর ঝামরে পড়া চুল নিয়েই হরি ঘোষ স্ট্রিট দিয়ে সোজা হেঁটে গেল বিডন স্ট্রিটের দিকে। ২৮ নম্বর বাড়িটা দেখল, দেওয়ালের গায়ে মার্বেল পাথরের উপর লেখা ’সালংকারা’ দেখল কিন্তু ঘাড় তুলে উপরের দিকে তাকিয়ে হতাশ হলো। সেদিন ক্ষিতি ফোন ধরতেই দোলনের হাসি যে শুরু হলো থামতেই চায় না। ক্ষিতির একটু রাগ মতো হলো। বলল, – এতো হাসির ঘটা কেন শুনি – আমাকে বোকা বানিয়েছ বলে?
দোলন বলে, — বাবুর রাগ হয়েছে বুঝি! কাল তোমার রাগ ভাঙিয়ে দেব – প্রমিস।
–মানে?
–মানে আজ আমি তোমাকে সামনে থেকে মন ভরে দেখলাম। কাল তুমি আমাকে প্রাণভরে দেখবে। অনেকক্ষণ ধরে। কাল আমি মামাবাড়ি যাচ্ছি। ঠিক আড়াইটার সময় বেরোব। তুমি রূপবাণীর দুটো টিকিট কেটে রাখবে। ম্যাটিনি শো। কোণের দিকের সিট নেবে।
উৎফুল্ল ক্ষিতি বলে, –তার মানে তোমার বাড়ি থেকে মামার বাড়ি যেতে তিন ঘণ্টা সময় চুরি করবে। তাই তো?
হাসির জলতরঙ্গ ভেসে আসে ওপার থেকে। ক্ষিতি আবার বলে, এবার গাঢ় স্বরে, –তুমি চুরি করবে সময়, আমি চুরি করব তোমাকে।
–ই-ই স্ – দেখা যাবে কে কাকে চুরি –
বলতে না বলতেই ফোন কেটে যায়, ডায়াল টোনের আওয়াজ ভেসে আসে।
ক্ষিতির মাত্র এক জোড়া করে প্যান্ট-সার্ট। অতি ব্যবহারে মলিন। দিনু বলল, –এগুলো পরে প্রেম করতে যাওয়া শাস্ত্রে বারণ।
তাহলে? মলয়ের ভালো ভালো প্যান্ট-সার্ট আছে। একটা হাওয়াই সার্ট, কচি কলাপাতা রঙ, ক্ষিতির গায়ে খুব একটা বেমানান হলো না। কিন্তু প্যান্ট? মলয় তার চেয়ে কম করে তিন ইঞ্চি লম্বা। শেষ পর্যন্ত শান্ত’র প্যান্ট ক্ষিতির মাপে খাপ খেল। বন্ধুদের সহর্ষ শুভেচ্ছা নিয়ে সে রূপবাণীর সামনের ফুটপাথে গিয়ে দাঁড়াল। একটু পরেই দেখল, একই ফুটপাথ ধরে এগিয়ে আসছে দোলন। খুব চমৎকার করে শাড়ি পরেছে সে। হাঁটার ভঙ্গিটিও অত মনোরম। তার মুখটিই কেবল চেনা ছিল ক্ষিতির, আজ তাকে গোটাগুটি দেখে কেমন ঘোরের মধ্যে পড়ে গেল। আর কী সর্বনাশ! তার ডান হাতে ধরা একটি গোলাপ। সন্ত্রস্ত হয়ে রাস্তার মানুষজনের মুখ লক্ষ করতে লাগল সে। সবাই যে সব বুঝে যাবে। আওয়াজ দেবে না তো কেউ!
সর্বনাশের চূড়ান্ত করে দোলন তার কাছে এসে গোলাপটি ক্ষিতির দিকে বাড়িয়ে ধরল। এ তো সিনেমার দৃশ্য হয়ে গেল। চোখ কান বুজে গোলাপটি নিয়েই ক্ষিতি তাড়াতাড়ি রূপবাণীর গেটে ঢুকে পড়ল। পিছন পিছন দোলনও।
ছবির নাম ‘স্বর্গ হতে বিদায়’। হলের মাঝামাঝি সারির এক কোণের সিটে দোলনের পাশাপাশি বসে ক্ষিতির মনে হলো, ছবির নামটা উল্টো হয়ে গেছে, তার কাছে এ তো রীতিমতো স্বর্গে আরোহণ! দোলনের পোশাক থেকে পারফিউমের মিষ্টি সুবাস আর সেই সঙ্গে যেন তার শরীরের উত্তাপও চুইয়ে এসে তাকে আচ্ছন্ন, বিবশ করে দিচ্ছে। সিনেমা চলল সিনেমার মতো, দোলনের হাতে হাত রেখে, তার শরীরের উত্তাপে উষ্ণ হতে হতে ক্ষিতি তার কানে কানে সাহিত্যের ভাষায় প্রেম জানিয়ে গেল। মাঝে মাঝে চাপা হাসি ছাড়া দোলনের মুখে কোনো কথা নেই। সিনেমা শেষে আলো, জনগণমন অধিনায়ক – ক্ষিতি-দোলনের স্বর্গ হতে বিদায় যেন আপাত-সত্য হয়ে উঠল।
(ক্রমশ)