সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৪০। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

(গত পর্বের পর)

লিংউড ওরফে সঙ্ঘরক্ষিতা

লিংউড জন্মেছিলেন লন্ডন শহরের টুটিং নামের একটা জায়গায়। স্কুলের পড়াশুনো শেষ করার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, কিছুদিন এখানে ওখানে কাজ করার পর সরকারি ডাক আসে, তিনিও ব্রিটিশ সেনাদলে যোগ দিয়ে ভারতে চালান হয়ে যান। যুদ্ধে বা সেনাকাজে আদৌ রুচি ছিলো না, যুদ্ধ শেষ হবার প্রায় পরপরই তিনি  ‘ডেজার্ট’ করেন, বা বাহিনী ছেড়ে পালান। ‘রেইনবো রোডে’ তাঁর লন্ডনের বাড়ি, পরিবার, পাড়া, শৈশবকৈশোর ইত্যাদি নিয়ে চিত্রময় বর্ণনা আছে। লিংউড অল্পস্বল্প ছবি আঁকতেন, কবিতাও লিখতেন, তবে বর্ণনাময় গদ্যে(যাকে বলে ডেসক্রিপ্টিভ প্রোজ) তাঁর আসল স্ফূর্তি, এবং সিদ্ধিও। কালিম্পং-এর গল্প খুঁজতে গিয়ে তাঁর সন্ধান পাওয়া, গল্পও হচ্ছে কালিম্পং-এর, লিংউডের গদ্যসিদ্ধি কিম্বা লেখার সাহিত্যগুণ নিয়ে অনেক কিছু বলার উপায় নেই। এই লেখা চলতে চলতে তাঁর লেখা ও গদ্যে আমাদের ঢুকতেই হবে, তাঁর সাহিত্যক্ষমতার পরিচয়ও, অল্প হলেও পাওয়া যাবে। এখানে, লিংউডের শৈশবজীবন থেকে এক টুকরো মনকাড়া ছবি তুলে দিই। মনে রাখা ভালো, যাবতীয় বৌদ্ধ সিদ্ধপুরুষদের ঘরানামাফিক লিংউড জন্মান্তরে বিশ্বাস করতেন, কী স্মৃতিকথা কী ধর্মকথা, তাঁর লেখায় অলৌকিক ঘটনা ও ভাবনা ফিরে ফিরে আসে, যেমন বৌদ্ধধর্মের সঙ্গে পরিচিত হবার আগেই, সত্যি বলতে কী, আজন্ম, সে ধর্মভাবনার প্রতি অনুরাগ।

টুটিং-এর বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে আছেন বালক লিংউড। শুয়ে শুয়ে দেখছেন, মাথার ওপরে ছাদের নিচে সিলিং, সিলিং থেকে ঝোলানো, না জ্বালানো গ্যাসবাতি। ঘরের মধ্যে, বাইরে, ভরা নিশুত রাত।লিংউড তাকিয়ে আছেন নিষ্পলক, মুগ্ধ:

সিলিংসজ্জা হিসেবে খোদাই করে বসানো পাতার বর্তনী, সেদিকে তাকিয়ে থাকতাম। পাতার তোড়া তো নয়, হুবহু একটা গাড়ির চাকা…বাইরের বড় রাস্তায় মোটরগাড়ি আসছে যাচ্ছে, তাদের হেডলাইটের আলো এসে সেই চাকাটায় পড়ছে, ঠিক যেন জমাট অন্ধকার ঘিরে লম্বা লম্বা উজ্জ্বল রেখা। গাড়িগুলো যদি দক্ষিণে সমুদ্রের দিকে যেত, রেখারা ঘুরতো ঘড়ির কাঁটা বরাবর, যদি উত্তরে যেত, শহরকেন্দ্রের দিকে, রেখা ঘুরতো উল্টোদিকে। কানে আসতো দূরাগত ট্রামগাড়ির ঘন্টা, অন্য গাড়িঘোড়ার ঘরঘর।অন্ধকারে শুয়ে থেকে থেকে দেখছি, চাকা একবার এদিকে ঘুরছে, একবার ওদিকে, কখনো কখনো দুদিকেই, দুদিক থেকে যখন দুটো গাড়ি একসঙ্গে এসে পড়ছে…দেখছি তো দেখছিই, যতক্ষণ না চোখ জড়িয়ে আসে ঘুমে।

সিংহল, সারনাথ, রাজগৃহ বা রাজগীর, ও নেপাল ঘুরে, বহু ধরণের বৌদ্ধ পন্ডিত ও ভিক্ষুর সঙ্গে আলাপ করে, লিংউড ঠিক করে ফেললেন,  পছন্দসই কোনো বৌদ্ধ সঙ্ঘে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দিয়ে ভিক্ষু হবেন। সেই সূত্রে তাঁর কালিম্পং আসা, ইতিমধ্যেই যেখানে কাঠমান্ডু থেকে আসা বৌদ্ধ নেওয়ারিরা ধর্মোদয় বিহার নামে একটি মন্দির ও উপাসনাকেন্দ্র খুলে ফেলেছেন। ‘কাঞ্চনজঙ্ঘার মুখোমুখি’ বইতে ধর্মোদয় বিহার সম্পর্কে অনেক কথা আছে, বিহারের ভিক্ষু, অন্য কর্মী ও বিহারে যাঁরা নিয়মিত আসতেন, এঁদের সবাইকে নিয়েই  লিংউড-সঙ্ঘরক্ষিতা বহু গল্প ফেঁদেছেন। বিহারের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যক্তিবর্গ তো বটেই, কালিম্পঙের সামাজিক জীবন নিয়েও নানান গল্পকথা।

হবার কথাও।  তিস্তা থেকে কালিম্পং ওঠার পথে, শহর শুরু হবার মুখটায় ধর্মোদয়, সেখান থেকে রাস্তা চলে যাচ্ছে বড় রাস্তা, মোটরস্ট্যান্ড, বাজার, সেসময়ের ভিক্টোরিয়া চক হয়ে আলগাড়া, সেখান থেকে পেডং হয়ে ঋষি নদী, নদী পেরিয়ে জেলেপিলা হয়ে তিব্বত ঢোকার ক্যারাভানপথ। তিব্বত অর্থাৎ চিন সীমান্তে যায় বলে, এখন ওই পথে গাছের সবুজের তুলনায় সামরিক সবুজ অনেক বেশি, তৎসহ গত পনেরো-কুড়ি বছর হলো সিল্ক রুট এবং বরফ দেখবার বিশুদ্ধ বঙ্গীয় হিড়িকে ট্যুরিস্ট বাণিজ্যের ধূম পড়েছে(যদিচ জেলেপ-লা যাবার রাস্তাটা কস্মিনকালে সিল্ক রুট নয় ও ছিলো না, শুধু জেলেপ-লা কেন, সিকিম, ভূটান ও নেপাল থেকে তিব্বত যাবার যতগুলো পথ আছে তার কোনটাকেই কোনভাবে সিল্ক রুট বলা যাবে না, মূলত পশ্চিমি বর্হিবিশ্বের সঙ্গে চিনের বাণিজ্য ওই সব পথে চলতো না)। সিল্ক পথ না হোক, লিংউড এবং মনিলার কালিম্পংবাসের সময়টায়, তিব্বত-কালিম্পং এর মধ্যে রমরমা বাণিজ্য চলতো। সে কথায় পরে আসা যাবে। মনিলার লেখায় কালিম্পং-আলগাড়া পথের সরস বর্ণনা আছে।পেডং-এর বিখ্যাত সরকারি মেলা শুরু করিয়েছিলেন স্বয়ং গ্রাহাম। আশপাশের ছোট বড় পাহাড়ি গ্রাম থেকে পায়ে হেঁটে ও ঘোড়ার পিঠে, অসংখ্য পাহাড়ি মানুষ আসতেন শাকসবজি ফলপাকুড় ও গরুছাগলশুয়োরমুর্গি ইত্যাদি নিয়ে, লেপচা ভোটে তিব্বতি তো বটেই, সংখ্যাগরিষ্ঠ নেপালি ভাষাভাষীরাও। মেলাটা দেখবার মতো ব্যাপার ছিলো, তবে কালিম্পং থেকে মেলার মাঠে পৌঁছনোটা সোজা ব্যাপার ছিলো না, আলগাড়া থেকে পেডং যাবার খাড়াই পাকদন্ডী পথ নামতো জোঁকভর্তি পাহাড়ি জঙ্গলের ভিতর দিয়ে। আলগাড়া যাওয়াটাও সহজ ছিলো না, মোটররাস্তা বলতে সরু পাথুরে পথ, শক্তপোক্ত জিপ জাতীয় গাড়ি ছাড়া অন্য গাড়ি যেত না, তায় যখন তখন হুড়মুড়িয়ে উঠে আসতো খচ্চরের ক্যারাভ্যান। খচ্চর পিছোবে, না গাড়ি, এ নিয়ে ষন্ডাগুন্ডা তিব্বতি ক্যারাভ্যানচালকদের ঝগড়াঝাটি লেগেই থাকতো। মনিলা বলছেন, সচরাচর পিছোতে হতো গাড়িকেই।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *