অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ১৩। অনন্ত জানা

এসব ছাড়াও ইংলন্ড তথা ইউরোপে পারিবারিক পরিচয়ের অভিজ্ঞান হিসেবে কোট অফ আর্মস, ক্রেস্ট এবং ব্যাজ দেখা যেত। কোট অব আর্মস বলতে বংশপরিচয়, কোনো বিদ্যাপ্রতিষ্ঠান বা শহরের প্রতীক বোঝাতো। [কোট অব আর্মস্্, দি প্রিন্সিপ্যাল পার্ট অব এ সিস্টেম অব হেরিডিটারি সিম্বলস্্ ডেটিং ব্যাক টু আর্লি মিডিয়েভ্যাল ইউরোপ, ইউজড্ প্রাইমারিলি টু এস্টাব্লিশ আইডেন্টিটি ইন ব্যাটেল। আর্মস্্ ইভল্্ভড্ টু ডিনোট ফ্যামিলি ডিসেন্ট, অ্যাডপ্শান, অ্যালায়েন্স, প্রপারটি ওনারশিপ, অ্যাণ্ড, ইভেনচ্যুয়ালি, প্রফেশন। (ব্রিটানিকা)] ইত্যাকার প্রতীকগুলি পারিবারিক পোশাক-আশাক, নথিপত্র, ব্যবহৃত জিনিসপত্রের উপরিভাগে চিত্রিত হতো অথবা প্রাসাদোপম বাড়ির প্রবেশপথের শিরোদেশে, সৌধগাত্রে উৎকীর্ণ করা হতো। সৌধগাত্রের পরিচয়লিপিও পোস্টারের মতোই তথ্য জ্ঞাপনের জন্য ব্যবহার করা হতো। পুরোনো যুগে সম্রাট-রাজা-সুলতান-শাসকেরা নিজস্ব গর্বিত অবস্থানকে স্থায়ী রূপ দেওয়ার জন্য, শিলাশাসন, তাম্রশাসন, নিজের নাম ও প্রতীকী উপস্থিতির সাহচর্যে মুদ্রার প্রচলন ইত্যাদি পন্থা অবলম্বন করতেন। অশোকস্তম্ভ এই ধরনের প্রতীকের ভালো উদাহরণ হতে পারে। উপনিবেশিক ভারতে তো বটেই, এমন-কী উত্তর-উপনিবেশিক ভারতেও দেশীয় ক্ষমতাবানেরা, রাজা-জমিদারেররা বিদেশী শাসকদের দৃষ্টান্ত অনুসরণে কোট অব আর্মস্ ধরনের প্রতীক ব্যবহার করতে থাকেন।
পেইন্টারের অমরত্ব, চিত্রজীবন
……………………………………………………………
সাইনবোর্ড শিল্পী হয়ে সুমনের সংকোচ ও বিষণ্ণতার দ্বিতীয় কারণটিও দূর হয়ে গিয়েছিল অচিরেই।
গিয়েছিলেন কলকাতায়। বাড়ি ছাড়বার পর এই দ্বিতীয় বার। ইচ্ছা ছিল কফি হাউজে একবার গিয়ে দেখবেন তাঁর আর্ট কলেজকালীন কারও দেখা মেলে কী-না! দেখার ইচ্ছা ছিল প্রখ্যাতি-প্রত্যাশী শিল্পীবর্গের অন্যরা যারা সেই কলেজকালেই তাঁকে রাস্তার শিল্পী বলে দেদার ব্যঙ্গ করত ; আর্ট গ্রুপ তৈরি করে প্রদর্শনীর নামে যারা নামীদের চামচাগিরি আর লবিবাজিতে হাত পাকিয়েছিল―তাদের কে কেমন আছে!
সুধাময় যথারীতি সঙ্গে ছিল। সুতরাং কফি হাউজ মুলতুবি রইল। তাছাড়া সুধাই তাঁকে বাধা দিল, বলল―‘কী দরকার বাপু তোর ঘাঁটবার। যাদের দেখতে চাইছিস তারা কি দেখার যুগ্যি! উয়াদের ছাড়ান দে না ক্যানে! নিজে যা করছিস কর।’
কলকাতায় তো রাত কাটাবার মতো কোনো সুনির্দিষ্ট ডেরা ছিল না তাঁর, ফলে ফেরার তাড়া ছিল যথেষ্টই। তবু কলেজ স্ট্রীট ক্রসিং-এ বাস থেকে নামবার পর রাস্তার অন্য-পাড়ে কলেজ রো-র মুখে চকিতে অনিন্দিতাকে দেখে অনভ্যস্ত-দ্রুততায় শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটের মুখটুকু পেরিয়ে এসে অন্যমনস্কতায় শ্লথ হয়ে এসেছিল পায়ের গতি। সেদিনই দিলখুশার সামনের ফুটপাথে একটুকরো পলিথিনের বই ছড়িয়ে বসে থাকা এক নাম না-জানা পুরোনো বই বিক্রেতা বুড়োর বইয়ের সম্ভারের মধ্যে তিনি ফ্রিটজ অগুস্ত গটফ্রায়েড এনডেল (১৮৭৩-১৯৫৫)-এর ‘ওল্ড ট্যাভার্ন সাইনস ; অ্যান এক্সকার্সন ইন দি হিস্ট্রি অব দি হসপিটালিটি’ বইটা হাতে পেলেন। বইটার প্রাপ্ত সংস্করণটি কেম্ব্রিজের রিভারসাইড প্রেস থেকে ১৯১৬ সালে ছেপে বেরিয়েছিল। সরাইখানার বিশিষ্ট সাইন নিয়ে সাড়ে তিনশোরও বেশি পৃষ্ঠার একটি বই। বইটা হাতে পাবার পর তিনি বুঝতে পারলেন যে, দোকান, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান কিংবা অন্য যে-কোনো ধরনের প্রতিষ্ঠানের নাম বা পরিচয়-নির্দেশক লিপির মতোই গুরুত্বপূর্ণ যে-কোনো ধরনের দিক-নির্দেশক লিপি বা সাইন। এই লিপি, সাইন বা ইঙ্গিত-লিপিকে সাইনবোর্ডের প্রকৃত পূর্বপুরুষ বলে মনে করা যেতে পারে। এই ধরনের নির্দেশনায় এগিয়ে রাখতে হবে যাত্রাপথের কিংবা মধ্যযুগের বড়ো বড়ো নগরগুলির সরাইখানা, বিশ্রামাগার এবং পানশালাগুলির অবস্থানসূচক বিজ্ঞাপনগুলিকে। বস্তুত লারউড ও হট্টেন উল্লেখিত রোমান সরাইখানা মদিরার জন্য পথপার্শ্বের চিরহরিৎ রোমান গুল্মের চিহ্নের মতোই প্রাক-মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে এবং পরবর্তীকালে আমেরিকায় লিপিশিল্পের ক্ষেত্রে সরাইখানার দিক-নির্দেশক এবং পরিচয়জ্ঞাপক চিহ্ন ও লিপিগুলির একটা বিরাট পরিসর আছে। তিনি এ-ও বুঝতে পারলেন যে, আর্টিস্ট হতে চাওয়ার সঙ্গে সাইনবোর্ড লেখা বা কারিগরিমূলক শিল্পকর্মের সত্যিকার কোনো বিরোধ নেই।
আর্ট কলেজে থাকাকালীন শিল্পের ইতিহাসের নানাদিক সম্বন্ধে জেনেছিলেন, কিন্তু এই বই থেকেই সুমন বিশেষভাবে জানতে পারলেন ইংরেজ চিত্রক ও কুশলী তক্ষণশিল্পী উইলিয়াম হোগার্থ (১৬৯৭-১৭৬৪)-এর সংগ্রামী ও বহুমুখী জীবন এবং শিল্পকর্মের কথা।
এনডেলের বইটির ভূমিকার শুরুই হয় স্কটিশ প্রাবন্ধিক, দার্শনিক, ইতিহাসবিদ, ব্যঙ্গাত্মক লেখক এবং তাঁর সময়-বলয়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ও প্রভাবশালী চিন্তক টমাস কার্লাইল (১৭৯৫-১৮৮১)-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে (‘ফর এ সাইন ! অ্যাজ ইনডিড ম্যান, উইথ হিজ সিঙ্গুলার ইমাজিনেটিভ ফ্যাকাল্টিজ, ক্যান ডু লিটল অর নাথিং উইদাউট সাইনস।’)
১৭৫০ সালে হোগার্থ ‘দি মার্চ অব দি গার্ডস টুওয়ার্ডস স্কটল্যাণ্ড’ (‘মার্চ অব দি গার্ডস টুওয়ার্ডস ফিঞ্চলি’) নামে একটি ছবি এঁকেছিলেন। তেল-ক্যানভাসের চিত্রকর্ম হলেও পরে শিল্পী নিজেই এটি ধাতুফলকে খোদাই করেছিলেন। এই রচনাটির মধ্যে পথপার্শ্বে সরাইখানার অবস্থান-নির্দেশক একটি সরাই-চিহ্নে আদি মানব-মানবী আদম ও ইভকে অঙ্কন করা হয়েছিল। ইংরেজি ‘টি’ (T) অক্ষরের মতো একটি দ্বিমুখী স্ট্যাণ্ডের দুই বাহুর একদিকে আদম ও ইভ-এর প্রতিমূর্তি আঁকা প্লেটটি ঝুলছে, তার সঙ্গে লেখা গাইলস গার্ডিনার (সরাইয়ের মালিক বা প্রতিষ্ঠাতার নাম, অথবা প্রতিষ্ঠাতার নামে সরাইয়ের নাম)। এই বাহুর একেবারে প্রান্তে সরাইখানার নিদর্শনস্বরূপ রোমান গুল্মের একটি গুচ্ছ ঝোলানো। অপর বাহুতে ‘টোটেনহ্যাম কোর্ট নার্শারি ১৭৪৫’ লেখা বোর্ড টাঙানো। ছবিটিতে কুচকাওয়াজরত বাহিনীর সামনে মদ্যপ সেনাদের সঙ্গে নাদান জনতার ঢল। নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধে মেশামেশি এক জনপিণ্ড বা মব। পথপার্শ্ববর্তী অট্টালিকাগুলির বাতায়নগুলি কৌতূহলী, আমোদকামী দর্শকে পরিপূর্ণ। হোগার্থের এই ছবিটি দ্য মার্চ অফ দ্য গার্ডস টু ফিঞ্চলি, যা দ্য মার্চ টু ফিঞ্চলি বা দ্য মার্চ অফ দ্য গার্ডস নামেও পরিচিত। সুমন ছবিটির মধ্যে বিষয়ের মহত্ত্ব ও চিরন্তনতার সন্ধান পেলেন। এই ছবিটিকে তাঁর যুদ্ধ, ক্ষমতা. হিংসা, যুদ্ধকেন্দ্রিক নির্বিবেক বেলেল্লাপনা এবং হুজুগে জনপিণ্ডের পাত্রাধার তরলের মতো গড্ডল আত্মবোধহীন জীবনযাপনের সমাহার বলে মনে হয়েছিল। হোগার্থের চিত্ররচনার প্রেক্ষিত ও আকরণিক আয়োজনের মধ্যে সুমন সংগোপিত সামাজিক, রাজনৈতিক বিদ্রূপের উপস্থিতি টের পেলেন। তাঁর মনে হলো স্বল্পায়তনিক ব্যবধানে কুচকাওয়াজরত এবং মাতাল সৈন্যের একীকৃত বৈপরীত্য, পথপার্শ্বে পানশালার অস্তিত্ব, ট্যাভার্ন সাইনে আদম-ইভের প্রতীকী উপস্থিতি, গবাক্ষে ও রাস্তায় জন-উন্মাদনা একই কটুত্বের বহুকৌণিক উপস্থাপনা। ছবিটির মূল বিষয়বস্তু ছাড়াও ছবিতে ব্যবহৃত সাইনবোর্ডের দৃশ্যমানতা স্বতন্ত্র মাত্রা পেয়েছে। এনডেল মনে করেছেন―লণ্ডনে বেড়াতে আসা কোনো পর্যটকের পক্ষে এই কাজটি পরিদর্শন করাটা আবশ্যিক (‘উই সি আদম অ্যাণ্ড ইভ ফিগারিং অন এ ট্যাভার্ন সাইন। নো ভিজিটর টু লণ্ডন শ্যুড্ ফেল টু সি দিস ওয়ার্ক অব দি ইংলিশ পেইন্টার-স্যাটায়ারিস্ট।’)
এই সম্মানজনক উল্লেখ সত্ত্বেও লণ্ডনের দরিদ্র ল্যাটিন স্কুল শিক্ষকের পুত্র উইলিয়াম হোগার্থকে দীর্ঘ সময় যাবৎ প্রাথমিকভাবে পরিপূর্ণ-অর্থে আর্টিস্ট না বলে পেইন্টার এবং এনগ্রেভার বা চিত্রক ও তক্ষণকারী বলেই মনে করে আসা হয়েছে (লক্ষ্য করার বিষয় : এনডেল নিজেও প্রাথমিকভাবে হোগার্থকে ইংলিশ ‘পেইন্টার-স্যাটায়ারিস্ট’ বলেই উল্লেখ করেছেন)। হোগার্থ যৌবনে খোদাইকারী এলিস গ্যাম্বেলের কাছে মুখ্যত ট্রেড কার্ড (পরিচিতি ও ব্যবসা প্রসারের জন্য ব্যবহৃত কার্ড। আজকের দিনের ভিজিটিং কার্ডের মতো) খোদাইয়ের কাজ শিখেছিলেন। পরে আরও কয়েকটি স্বল্পস্থায়ী বা সাধারণ প্রতিষ্ঠানে চিত্রকলা শিক্ষা গ্রহণের চেষ্টা করেছিলেন। কর্মজীবনের শুরুতে হোগার্থ অস্ত্রের কোট, দোকানের বিল খোদাই করতেন এবং বই-বিক্রেতাদের জন্য প্লেট ডিজাইন করতেন। এই সময়ে যশুয়া মরিস নামে এক ট্যাপেস্ট্রি কর্মী তাঁকে এলিমেন্ট অব আর্থ-এর নকশা প্রস্তুত করার বরাত দেন। মরিস তাঁকে শিল্পী নয়, নেহাৎই কারিগর বলে মনে করেছিলেন! ফলে নকশার কাজ সম্পূর্ণ হবার পরে মরিস সেটি প্রত্যাখ্যান করেন। হোগার্থ ওয়েস্টমিনিস্টার আদালতে মামলা করে নিজের পাওনা অর্থ আদায় করেন।
হোগার্থের বহু চিত্রে এমন বহু সাইন, সাইনবোর্ড―এমন-কী সৌধলিপিরও ব্যবহার আছে।
হোগার্থ সম্ভবত নিজেই পেইন্টার হিসেবে তাঁর নিজের অবস্থান সম্পর্কে হীনম্মন্যতার পরিবর্তে ইতিবাচকভাবে সচেতন ছিলেন। হয়তো কিছুটা গর্ববোধও ছিল তাঁর। এমন অনুমান করার কারণ তাঁর ‘বিয়ার স্ট্রীট’ ছবিটিতে একাধিক সাইন, শিরোলিপি, তোরণলিপির সঙ্গে সাইন অঙ্কনরত এক শিল্পীর দেখা মেলে। এ যেন সাইনবোর্ডের এক জীবন্ত ও চলমান প্রদর্শনী। লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে সমগ্র ছবিতে সাইন শিল্পীর উপস্থিতি নিছক আলংকারিক নয়, বিশিষ্ট ইঙ্গিতবাহী। কেউ কেউ সাইন-শিল্পীর এই উপস্থিতিকে স্বকীয়তাহীনতার প্রতি হোগার্থের শ্লেষ বর্ষণ বলে মনে করতে পারেন কিন্তু ‘বিয়ার স্ট্রীট’-এ আসবতৃপ্ত স্থুলোদর মানুষের ভিড়ে, দুই বা ততোধিক রাস্তার সংযোগস্থলে বসে যাওয়া প্রায় মাছের বাজারের মাঝে মইয়ে চড়ে একমাত্র সাইন-পেইন্টারই সস্তা হলেও, একটি শিল্পকর্মে রত। চেহারায় তিনি লম্বা ও নির্মেদ, দেহভঙ্গি ঈষৎ ছন্দিত। নিজের শিল্পকর্মকে বেশ অপত্যস্নেহের সঙ্গে অবলোকনরত। এত মানুষের ভিড়ের মধ্যেও হোগার্থ এই অকিঞ্চন শিল্পী ও তাঁর অকিঞ্চিৎকর শিল্পকে বিশিষ্টতা দিয়েছেন। এই চিত্রে যা ঘটেছে তাকে আমরা এক ধরনের শৈল্পিক-ন্যায়বিচার ও সহানুভূতিমূলক ব্যঙ্গ বলতে পারি।
প্রথম জীবনে পেইন্টার হিসেবে সম্ভবত কিছুটা অবজ্ঞাত হলেও হোগার্থ পরে একজন রাজনৈতিক বিদ্রূপকারী, ব্যঙ্গাত্মক-শিল্পী, সামাজিক সমালোচক, সচিত্র খোদাইকারী এবং স্বল্পমাত্রার হলেও রচক হিসেবে প্রশ্নাতীত খ্যাতি ও স্বীকৃতি অর্জন করেন। তাঁর বিদ্রূপাত্মক চিত্র-রচনাগুলি এতটাই জ্বালাময় যে সমকালের অন্যতম প্রাসঙ্গিক এই শিল্পী সম্পর্কে এমন মন্তব্য করা হয়েছে : ‘হোগার্থস মেথড অব এক্সপোজিং মিননেস, ডিফর্মিটি, অ্যাণ্ড ভাইস, প্যাডিং ইন হোয়াটএভার ইজ রিডিক্যুলাস, ফল্টি, অ্যাণ্ড ভিসিয়াস।’ (―চার্লস ল্যাম্ব : অন দি জিনিয়াস অ্যাণ্ড ক্যারেক্টার অব হোগার্থ উইথ সাম রিমার্কস অন এ প্যাসেজ ইন দি রাইটিংস অব দি লেট মি. ব্যারি) অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের ইংলণ্ডে এমন মানুষও ছিলেন যাঁরা তাঁদের লাইব্রেরির জন্য শেক্সপীয়রের বইয়ের পরেই উইলিয়াম হোগার্থের চিত্র ও তক্ষণের কাজগুলিকে সংগ্রহযোগ্য বলে মনে করতেন। চার্লস ল্যাম্বও (১৭৭৫-১৮৩৪) হোগার্থের চিত্ররচনা ও তক্ষণের কাজগুলিকে পাঠযোগ্য গ্রন্থ বলে মনে করতেন। ল্যাম্বের মতে―হোগার্থের গ্রাফিক চিত্রের উপস্থাপনাগুলি প্রকৃতপক্ষে বই : সেগুলিতে শব্দের সৃজনোন্মুখ ফলপ্রসূতা এবং ইঙ্গিতপূর্ণ অর্থ রয়েছে। অন্যান্য ছবি, যা আমরা দেখি, কিন্তু হোগার্থের ছবির প্রিন্টগুলি আমরা পড়ি (ল্যাম্বের ভাষায় : ‘হিজ গ্রাফিক রিপ্রেজেন্টেশনস আর ইনডিড বুকস দে হ্যাভ দি টীমিং, ফ্রুটফুল, সাজেস্টিভ মিনিং অব ওয়ার্ডস। আদার পিকচার্স উই লুক অ্যাট,―হিজ প্রিন্টস উই রিড।’―তদেব)।
ইতিহাস এটাই যে, পেইন্টার ও এনগ্রেভার উইলিয়াম হোগার্থ তাঁর শ্রম, মেধা, বিষয়ের মহত্ত্ব, উপস্থাপনার বুদ্ধিমত্তা ও করণকৌশলের বিস্ময়কর প্রয়োগসহ শিল্পরচনার জোরে বিশ্বশিল্পে স্থান করে নিয়েছেন। আধুনিক ও সমকালীন শিল্পীদের সঙ্গে তাঁর কাজ ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারিসহ নামী প্রদর্শশালাগুলিতে স্থান পেয়েছে।
উইলিয়াম হোগার্থের জীবনকথা পাঠ করার পর সুমনের আত্মক্লেশ বহুলাংশে অপসারিত হলো। শিল্পসন্ধানের কতই না পথ আছে। কোনো পথই আপৎকালে পরিত্যাজ্য নয়! কেন জানা নেই নিজেকে সাইনবোর্ড-লিখিয়ে বলতে কষ্ট হয় না। এক্ষেত্রে সুকুমার রায় অঙ্কিত ‘আবোল তাবোল’-এর প্রারম্ভিক ছবিটির কথা মনে হয়। সেখানে ‘আবোল তাবোল’ লেখা একটা আস্ত সাইনবোর্ড লাগাচ্ছে কয়েকজন মানুষ। সাইনবোর্ডটার হরফগুলিও বিশিষ্ট, অদ্ভুত। হরফগুলি ত্রিভুজ, রুইতন ইত্যাদির টুকরো দিয়ে তৈরি। লক্ষ্য করতে হবে―বোর্ড টাঙানোর জন্য পোঁতা খঁুটির গায়ে নোটিশের মতো একটা ছোট্ট বোর্ডও দৃশ্যমান। এখানে সুকুমারের হাতে সাইনবোর্ড ও জ্ঞাপনীবিদ্যার ব্যঙ্গাত্মক চিত্ররূপ অমরত্ব প্রাপ্ত হয়েছে।
বিষয়, উপস্থাপনা, উপকরণ-উপাদান, বয়ান সব মিলিয়ে সাইন-আর্টের ইতিহাসের বিস্তারের ইতিবৃত্ত ক্রমেই উন্মুক্ত হওয়ায় গঞ্জে আসার পর থেকে এতদিনের আর্ট-কলেজীয় আত্মাভিমানের দ্বিধাজড়িত দৌর্মনস্য চিত্তক্ষোভের জন্য সুমন লজ্জিত হলেন।
(ক্রমশ)
…………………………………………………………………………
(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, ই-সূত্র থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)