সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৮। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
বাড়ির নাম মঞ্জুলা
মনিলা জানাচ্ছেন, তাঁর শোকস্তব্ধ মা এই আশ্চর্য নতুন বাড়ির নাম রাখেন মঞ্জুলা। বাড়িটা ঠিক তাঁর দিদি মঞ্জুলার মতোই সুন্দর, অথবা তার চাইতেও বেশি। সময় স্মৃতি তৈরি ও নষ্ট করে অবলীলায়, অক্লেশে, মঞ্জুলা নামের বাড়ি, মানুষ, সায়েবি কালিম্পং-এর আপাত-নিষ্কলুষ নিসর্গ, সব কিছুই ধূসর, হলদে হয়ে আসা ঝাপসা ছবি হয়ে গিয়েছে।
মনিলার কথা শুনতে শুনতে, তাঁর লেখা পড়তে পড়তে, আমার নিজের দেখাশোনা কালিম্পং-এর সঙ্গে মিলিয়ে ভাবছিলাম, কেমন ছিলো সে সময়, সে বাড়ি, সে শহর? অতীশ পথ ধরে চিত্রভানু যাবার রাস্তা এখনো একইরকম সরু, ঢালু, চিত্রভানু বাড়িটাও হয়তো একইরকম আছে। সম্প্রতি সারানো হয়েছে, বাড়ির গায়ে নতুন করা হলদে-গেরুয়া রঙ। চিত্রভানুর কথা, কালিম্পং শহরের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ এবং ঠাকুর পরিবারের যোগাযোগের কথা আলাদা করে বলতে হবে। আমরা বলছিলাম মনিলা ও মঞ্জুলার কথা।
মঞ্জুলা বাড়িটা যে জায়গায় ছিলো, মনিলার বলা গল্প থেকে জানা যাচ্ছে, বাড়ি বানানোর আগে সেখানে ঝোপজঙ্গল ছাড়া কিছু ছিলো না। বাড়ি যখন তৈরি হচ্ছে, অতীশ পথে সব মিলিয়ে বড়জোর গুটি দশেক বাড়ি ছিলো। যে ঢালে পরে মঞ্জুলা গড়ে ওঠে, সেটা গিয়ে শেষ হতো গভীর এক গহ্বরে। সেই গর্ত বুঁজিয়ে, মাটি কেটে ঢাল সমান করার কাজ যখন চলছে, কুলিরা কাজ ছেড়ে দিতে চাইলো। মাটির তলায় সারসার কঙ্কাল, চাপা পড়া ও কবেকার, না থাকা মানুষের তাল তাল হাড়:
হাড়গুলো সব কঙ্কালের, বয়সের ভারে হলুদ। হাড়, হাড়, হাড়, মানুষের শরীরের প্রত্যেক অংশ থেকে হাড়। গোল মসৃণ খুলি, তাতে তিনটে কালো গর্ত, বাইরে বেরিয়ে আসা দাঁত, দৃষ্টিহীন চোখের কোটর থেকে সেগুলো সোজা আমার তাকিয়ে। মেরুদন্ড দিয়ে ভয়ের হিমস্রোত নামছিলো…চিৎকার করে উঠলাম।
মনিলাকে পরে কেউ বলেছিলেন, ব্রিটিশদের আসার আগে, ওটা ছিলো লেপচাদের প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র। নিচে যে গর্তটা, ওটা আসলে পরিত্যক্ত পাথরখাদান, সেখান থেকে সায়েবদের পাথরের বাড়ি বানানোর জন্য পাথর তোলা হতো।
সম্ভবত সেই হাড়, কঙ্কাল ইত্যাদি অন্য কোথাও পুঁতে দেওয়া হয়, কিম্বা ফেলে দেওয়া বা নষ্ট করে ফেলা হয়। গর্ত থেকে তোলা পাথর দিয়ে যে সব সায়েববাড়ি তৈরি হয়েছিলো, হয়তো তাদের ভিতর ম্যাকফার্লেন গীর্জা, বা গ্রাহাম সায়েবের হোমও ছিলো। আমাদের এদিকে সায়েবসময়ের আগেকার মানুষদেরই ইতিহাস বলতে কিছু নেই, সায়েবসময়ের কথাগল্পও পুরোনো হাড় বা পাথরের মতো জীর্ণ হয়ে ঝুরঝুর করে পড়ে যাচ্ছে। চিত্রভানুর ঠিক ওপরে যে মঞ্জুলা বাড়ি প্রায় অর্ধ শতক ধরে অসংখ্য ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব ও তাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিচিত্র আখ্যানরাজিকে ধারণ করে রেখেছে, সে এখন উঁচু টিনের পর্দায় ঘেরা সমতল একটা মাঠ, সেখানে কোনকালে যে অন্য কিছু ছিলো, থাকতে পারে, ভাবাই যায় না। মাঝে মাঝে কুয়াশায় মাঠটা ঢাকা পড়লে, ডানদিকে চিত্রভানু বাঁদিকে মাঠের ওপারে অন্য দু একটা বাড়ি নজরে পড়ে। মেঘ অনেক দুঃখ ও না থাকা ঢেকে দিতে পারে, সর্বগ্রাসী ও সর্বব্যাপী ইতিহাসহীনতার মধ্যে ইতিহাসের কল্পনাবীজও হয়তো সঞ্চারিত করতে পারে। মেঘ না থাকলে মাঠ, টিনে ঘেরা, বৃষ্টির মতো বালি বজরি সিমেন্ট পড়তে থাকা মাঠ, যে কোন দিন সেখানে নতুন একটা বাক্সবাড়ি গজাবে, যে জন্ম ও যে নির্মাণ আগের সমস্ত থাকা না থাকাকে বাতিল আগাছার মতো উপড়ে ফেলে দেবে।
এরকম, এরকমই হয়, হবার কথা, হওয়াটা দস্তুর। বদল অবশ্যম্ভাবী, অপ্রতিরোধ্য, জানি। এক ইতিহাসকে অন্য ইতিহাস গিলে নেবে, ধ্বংস করবে, এক গল্পকে অন্য বহু গল্প। তবু কেন যে মনে হয়, আছে, আছে, আছে! প্রথম গোর্খা আন্দোলনের সময় জ্বলে যাওয়া, বিক্রি হয়ে মাঠ হয়ে যাওয়া মঞ্জুলা বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কেন যে সাতসতেরো আকাশপাতাল ভাবি, যা নেই, একেবারেই নেই, তাকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি। বয়স বাড়ে, বাড়ে, পাহাড়ি পথে বেশি ওপরনিচ করলে বুকে ব্যথা হয়। চোখ বুঁজে, চুপ করে দাঁড়িয়ে ভাবি, এই তো মাত্র দেড়শো বছর আগে, লেপচা গ্রাম কালিম্পং-এ শিবির ফেলছেন ইডেন সাহেব, স্কটিশ মিশনারিরা তিস্তার খরস্রোত পেরিয়ে, বনজঙ্গল ভেঙে আসছেন, ইস্কুল আর গীর্জাবাড়ি বানাচ্ছেন। আরো সায়েব মেমসাহেবরা আসছেন তারপর, তাঁরা সঙ্গে করে কি পিছনে পিছনে নিয়ে আসছেন বাঙালি, নেপালি, অন্য মানুষদের। গ্রাম শহর হচ্ছে, দ্রুত শহর ছেড়ে অন্য গ্রামে সরে যাচ্ছেন কালিম্পং এর পুরোনো মানুষেরা, লেপচা, ভুটিয়া, তিব্বতিরা। সময়, জায়গা, মানুষ, গল্প সব বদলাচ্ছে। বদলাতে বদলাতে একদিন, শুধু বদলটাই থাকছে। বাকিটা টিনের বেড়ায় ঢাকা বাড়ি বা বাড়ির ভূত, ধসে পড়া পাহাড়, ঘেরাবন্দি অবরুদ্ধ নদী।
(ক্রমশ)
