অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর ‘এক যে ছিল গ্রাম’। পড়লেন ত্রিপর্ণা সাহা
কলকাতা বইমেলা ২০২৫-এ ‘সুপ্রকাশ’ থেকে আমার কেনা বই অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী’র ‘এক যে ছিল গ্রাম’। মাত্র কয়েকদিন হলো বইটি পড়া শেষ হয়েছে। অনেকটা ভালোলাগা কিছুটা মন খারাপ—অদ্ভুত এক দোটানায় মন ঘিরে রয়েছে। ‘আগরবাঁধ’, লেখকের হারিয়ে যাওয়া সেই মলিন গ্রামখানা যেন আমাকেও আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ফেলেছে। পড়া শেষ হয়ে যাওয়ার পর বারবার মনে হচ্ছে কেন শেষ হলো! এক ছুটে চলে যেতে ইচ্ছা করছে আগরবাঁধে। ইচ্ছা করছে গ্রামের সেই পাঠশালায় আবার পড়াশোনা শুরু করি, কিংবা ছায়ের হেঁসেলের নিরামিষ আহার চেটেপুটে খাই। কিন্তু শহুরে আদব-কায়দায় এমনভাবে জড়িয়ে গেছি আমরা— অভ্যাস বড় দায়, তা থেকে বেরোনোর উপায় জানা নেই।
আমার কাছে প্রশান্তির আরেক নাম গ্ৰাম, গ্ৰাম্য সহজ সাধারণ জীবন। গ্ৰাম্য জীবনবৈচিত্র্যে কী যে এক অমোঘ টান অনুভব করি তা লিখে বোঝানো সম্ভব নয়। যান্ত্রিক জীবনে যখনই সুযোগ হয় একটু শান্তির খোঁজে ঘুরে ফিরে ওই নীড়ে চলে যেতে মন চায়। তাই পাঠ শুরু করতেই আগরবাঁধের সঙ্গে নিজেকে কেমন মায়ায় জড়িয়ে ফেললাম। লেখকের শৈশবের স্মৃতিকথার তরী বাওয়ায় বলা বাহুল্য, পশ্চিম মেদিনীপুরের এক কোণে অবহেলায় পড়ে থাকা মলিন গ্রামটির মাঠে-ঘাটে ঝোঁপে-জঙ্গলে, কর্দমাক্ত রাস্তায়, বারো মাসের তেরো পার্বণে শিলাই নদীতে আমিও যেন প্রবাহমান হয়ে গেলাম।
এই বই বলা ভালো লেখকের শৈশবের স্মৃতিমালার। পাঠ শেষ করার পর এমনই রেশ থেকে গেছে, বারবার মনে হচ্ছে সবকিছু ছেড়ে চলে যাই, বসবাস করতে থাকি সেই গ্রামটিতে। তবু কতগুলো বিষয়ের ভালোলাগাগুলো তো জানাতেই হয়, নইলে এমন একটা বই পাঠককে উপহার দেওয়ার সার্থকতাটাই যেন হারিয়ে যাবে।
এবারের কলকাতা বইমেলায় সুপ্রকাশের স্টলে বই দেখতে দেখতে হঠাৎ চোখ আটকে গেছিল অদ্ভুত এই নামটি দেখে ‘এক যে ছিল গ্রাম’। ছোটবেলার রচনা লেখার কথা মনে পড়ে গেছিল ‘একটা গ্রামের আত্মকথা’ বা ‘আমার দেখা গ্রাম’। পাঠ শেষ করার পর উপলব্ধি হলো এই বিশাল যান্ত্রিক পৃথিবীর এক কোণে অন্ধকারাচ্ছন্ন অখ্যাত গ্রামটিকে লেখক তাঁর নিজস্ব শৈল্পিক ছন্দে শব্দ ভাষা কথায় যেভাবে এঁকেছেন, তা অবর্ণনীয়।
শিল্পী সুলিপ্ত মণ্ডলকে কুর্নিশ জানাই এমন একটি প্রচ্ছদ অঙ্কনের জন্য। গ্রাম্য জীবনের বহুবিধ উপাদান ও উপকরণ ছড়িয়ে আছে সমগ্র প্রচ্ছদটি জুড়ে। হালকা খয়েরি রঙের উপর সাদা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা ছোট ছোট অলংকরণ গুলি যেন আগরবাধেঁর বারোমাস্যা। অপূর্ব এই প্রচ্ছদখানা মন ছুঁয়ে যায়।
স্মৃতি কথার প্রত্যেকটি লেখার সঙ্গে মানানসই অলংকরণ বারবার করে ‘সহজপাঠ’ মনে করিয়ে দেয়। অলংকরণ শিল্পী অদ্বয় দত্তকে অভিবাদন এমন সুন্দর চিত্রকথা প্রত্যেকটা লেখার সঙ্গে আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য। যেন মনে হয় সাদা কালোর মিশেলে শিল্পী লেখকের স্মৃতিকথাগুলোকে তাঁর আঁকায় লিখেছেন। বইটি পড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি অলংকরণ আলাদা করে শুধু চেয়ে দেখার দাবি রাখে।
দীর্ঘ স্মৃতি মেদুরতার ভারে পাঠ এতটুকু কোথাও ক্লান্তিকর হয়নি। বরং পড়া শেষে মনে হয়েছে আরও কত কিছু অজানা থেকে গেল। মেঠোগন্ধে আরও দীর্ঘ দীর্ঘ পাঠে মন হারাতে চায়। কত নতুন শব্দ শিখলাম, স্থানীয় গ্রাম্য পরিভাষা জানলাম। যেমন ‘আলেকালে’, ‘মোল’ কি-কাদের অন্তরের ধন এমন আরো কত কী। আসলে স্মৃতি কথা পাঠের আনন্দটাই এমন— হঠাৎ কোনও ঘটনার বিবরণে হয়তো চোখ অশ্রুসিক্ত, আবার হয়তোবা কখনও ওষ্ঠপাশে মৃদু হাসির রেখা। তাই একটা স্মৃতি ধরতে গিয়ে যেন সুতোর টানে অন্যরাও একের পর এক উঠে এসেছেন তাঁর লেখনীতে। নিষ্প্রদীপ, নিঝুম অজপাড়া গাঁয়েও যে কতরকমের আলোর ছটা থাকে, কত রঙবেরঙের চরিত্র থাকে তা আমরা শহুরে আদব-কায়দায় আন্দাজ করতে পারি না। লেখকের স্মৃতিকথা নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিসরের বিবরণ হলেও মলিন গ্রামটির স্থির, অথচ সদা পরিবর্তনময় জীবন— আর সেই জীবনযাত্রার হাসি-কান্না, মহত্ত্ব-সংকীর্ণতা, আনন্দ-বেদনা, বিধি-বিধান, আচার-বিচার, দারিদ্রতা-স্বচ্ছন্দ্য, পুজো-পার্বণ এই সবকিছুর সযত্ন বিবরণীতে মাঝে কখন যেন অনুভূত হতে থাকে শিকড়ের টান।
সুপ্রকাশ-এর বইয়ের পৃষ্ঠার মান, বাঁধাই বানানবিধি এসব বিষয়ে নতুন করে বলাই বাহুল্য। কারণ এসব নিয়ে কোন অভিযোগ অনুযোগ কখনই চোখে পড়ে না। এতটাই যত্ন সহকারে, দক্ষতার সঙ্গে আপনাদের কাজগুলো আমরা পেয়ে থাকি বছরের পর বছর ধরে। তাই ভবিষ্যতের জন্য শুভকামনা রইল। আর বইটির মূল্য নির্ধারণ নিয়ে আমি কিছু লিখতেই চাই না কারণ কিছু বই হয় অমূল্য।
শিকড়ের টান অনুভব করতে, শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরের নিঝুম মাঠে খড়ো চালের পাঠশালায় আবার পড়াশোনা শুরু করতে যদি মন চায়, গাঁয়ের ছোটখাটো সব মানুষ, চিতু ওনা লুড়কা লেউল জগা ওন্তা বুড়া মথুর বদনা সত্য পদি কালীমতি উরাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে ইচ্ছা করে, ভাদু পুজোর প্রসাদ খেতে মন উচাটন হয়, বট অশ্বত্থ বকুল গাছের ছায়ায় শীতল চাতালে একমুঠো বিশ্রাম নিয়ে, শিলাই নদীর দ’ আর খালের বাঁধে হারিয়ে যেতে চান তাহলে বলবো অবশ্য পাঠ্য ‘এক যে ছিল গ্রাম’।
