অকূলের কাল। পর্ব ১১। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

0

(গত পর্বের পর)

খিদিরপুরের কোম্পানি

শ্রীরামপুর ছাড়াও আর একটা যাওয়ার জায়গা আছে ক্ষিতির। সেটা অবশ্য কলকাতার মধ্যেই। খিদিরপুরের মনসাতলায়। সেখানে থাকে অমিয়, অশোক আর রঞ্জিত। ডাকতে গেলে রঞ্জিত, কিন্তু লিখতে গেলে নরজিত। অমিয় অশোক ক্ষিতির চেয়ে দু-এক বছরের ছোট, নরজিত তাদের চেয়ে প্রায় বছর দশেকের বড়। অমিয় ক্ষিতির ভাগ্নে, তার মেজদির বড়ো ছেলে। অশোক অমিয়র পিসির ছেলে। তারা তিনজনে সেই ছোটবেলা থেকেই ঘনিষ্ঠ। অমিয় মামাবাড়িতেই ছিল ছোটবেলায়। তারা মামা-ভাগ্নে একই পাঠশালায় পড়েছে। অমিয়র বাড়ি ক্ষিতির গ্রাম থেকে মাইল পাঁচেক দূরের এক গ্রামে। হাই ইস্কুল তাদের তিনজনের ভিন্ন ভিন্ন হলেও প্রতিটা লম্বা ছুটির ঠিকানা তিনজনেরই ছিল জুনশোল গ্রাম – অমিয়র বাড়ি, অশোকের মামাবাড়ি আর ক্ষিতির দিদিবাড়ি। ফুটবল খেলার জন্য জঙ্গল লাগোয়া বিশাল মাঠ, বিচরণের জন্য আম জাম তাল গাছও দেদার। রুখাশুখা গ্রামে জলেরই যা কিছুটা অভাব। গ্রীষ্মের ছুটিতে পুকুর শুকিয়ে যায়। নদী আছে – শিলাবতী, কিন্তু আধ মাইল হাঁটলে তবে। তিনজনে একসাথে হুটোপুটি করার টানে সামান্য এই অসুবিধে গায়ে লাগে না।

মনসাতলায় গলি, তস্য গলির ভেতরে বাড়ি ভাড়া করে থাকেন রাধারমণ ষণ্ণিগ্রহী। অমিয়র পিসেমশায়, অশোকের বাবা, নরজিতের ‘কোম্পানি’। সামান্য উঁচুদরের বস্তি। দশ বারোটা ছোট ছোট ঘর, কারোর ছাদ আছে, কারোর মাথায় এসবেস্টস। গোটা চারেক এজমালি পায়খানা-বাথরুম। বারোয়ারি কল। সবই ভাড়া দেওয়া। বাড়ির মালিকও তার মধ্যেই বসবাস করেন।

রাধারমণ খিদিরপুর ডক লেবার বোর্ড হাসপাতালের হেড কম্পাউন্ডার কাম স্টোরকিপার। প্রথম প্রথম এখানেই একটি মাত্র ঘর ভাড়া নিয়ে একাই থাকতেন, বাইরে খাওয়াদাওয়া সারতেন। তারপর অশোক গ্রামের স্কুলে প্রাইমারি ডিঙিয়ে যেতেই তাকে এনে খিদিরপুর সেন্ট বারনাবাস স্কুলে ভর্তি করলেন। সেই সঙ্গে তাঁর গ্রামদেশ থেকে নরজিতকে জোগাড় করে আনলেন। নরজিতের বাবা একে গরিব, তায় বোষ্টম। সামান্য কিছু জমিজমা আছে, কিন্তু চাষবাস করার পরিশ্রম বোষ্টমের পোষায় না, করতাল বাজিয়ে ঘরে ঘরে হরিনাম শুনিয়ে মাধুকরী করে বেড়ান। নরজিত তাঁর বড়ো ছেলে, সে খিদিরপুরে এসে বাবা-ছেলের রান্নাবাড়া সহ যাবতীয় গৃহস্থালির কাজ সামলায়। হাসিমুখে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে পারে নরজিত, মহিলাদের থেকেও  পরিপাটি তার কাজ। নিরক্ষর কিন্তু রসিক ছেলে সে। রাধারমণের অতি বাধ্য, তাঁকে ভয়ভক্তি করে, আবার তাঁর অসাক্ষাতে তাঁকে নিয়ে রসিকতাও করতে পারে। রাধারমণ তাকে কোনোরকমে নাম সই করতে শেখালেন। তারপর বছর তিনেক বাদে প্রথম সুযোগেই ডক লেবার বোর্ড হাসপাতালে চতুর্থ শ্রেণির স্থায়ী কর্মীর পদে ঢুকিয়ে দিলেন। ঠিক এই সময়েই রাধারমণ পাশাপাশি দুটি ঘরও পেয়ে গেলেন, পায়খানা বাথরুম মাত্র একজনের সঙ্গে ভাগ করে সরতে হবে। তিনি দেশ থেকে স্ত্রী এবং বাকি দুই পুত্রকন্যাকে নিয়ে এলেন এই দুই ঘরের বাসায়। বড় পাকা ঘরটি ছোট মেয়েটি সহ তাদের শোয়ার ঘর, তার বারান্দায় রান্নাবান্নার ব্যবস্থা, বাকি এসবেস্টসের ছোট ঘরে দুই ছেলে ও নরজিত থাকবে।

এদিকে নরজিত চাকরি পেয়েছে খবর পেয়েই তার বাবা দেখেশুনে একটি বৌমা নিয়ে এলেন ঘরে। নরজিত হাসপাতালের লাগোয়া চতুর্থ শ্রেণির আবাসনের দোতলায় একটি এক কামরার কোয়ার্টারও পেয়েছে। কিন্তু সেটি তালাবন্ধই আছে। সেখানে বউ নিয়ে ওঠার অনুমতি সে এখনও রাধারমণের কাছ থেকে পায়নি, থেকে গেছে খিদিরপুরেই। রান্না তাকে করতে হয় না – কিন্তু যে করতে চায়, তার কাজের কি আর শেষ আছে! হাসপাতালে তার শিফট ডিউটি, বাকি সময় সে খিদিরপুরের ডিউটি করে। এই ডিউটির মধ্যে তার খাওয়া আর পাখাহীন ছ’ ফুট বাই দশ ফুট এসবেস্টসের ঘরে মেঝেতে পাতা বিছানায় দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঘুমনোও আছে। তার বউ বার দুয়েক এসে কলকাতা দেখে গেছে। যে পাঁচ-সাত দিন করে ছিল, ঘুমিয়েছে ছোট ঘরের বারোয়ারি ভূমিশয্যায় সকলের সঙ্গেই।

রাধারমণ একটু কড়া ধাতের মানুষ। শৃঙ্খলার মধ্যে থাকা এবং বাকি সবাইকে রাখা তাঁর অভ্যাস। তার অন্যথা হলে কটু কথা, এমনকি চড়চাপড়ও চালিয়ে দিতে পারেন। এই বাকিদের মধ্যে নিজের পরিবার ছাড়াও তাঁর কলকাতায় থাকা এক ভাই, ভাইপো এবং নানা সূত্রে আত্মীয়, অভিভাবকহীন দু-চার জন ছাত্রও আছে। তারা যাতে আর্থিক বা পরমার্থিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে না পড়ে সেদিকে তাঁর তীক্ষ্ণ নজর থাকে। তাঁর ভাইটি বড়ো সাদাসিধে, তাকে তিনিই ডক লেবার বোর্ডে কেরানির চাকরিতে ঢুকিয়েছিলেন। অফিসের কাজে সে ভুল করলে তার দায় দাদার উপরেই এসে পড়ে। সদ্যই তার বিয়ে দিয়েছেন, সে কাছাকাছিই একটি নিখাদ বস্তিতে এক কামরা অর্ধপক্ক ছিটেবেড়ার ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। প্রতি সকালেই তাকে দাদার কাছে হাজিরা দিতে হয়। অফিসের কাজে ভুলসহ অন্যান্য গাফিলতির জন্য দাদার কাছে কড়া ধমক সে প্রাতরাশের মতোই সোনামুখ করে খায়। এই গাফিলতির মধ্যে পড়ে তার গোঁফও। সে নাকের নীচে হিটলারি কায়দায় ছোট্ট একখানি গোঁফ রাখে যেটা রাধারমণের চক্ষুশূল – গোঁফই যদি রাখবি ভালো করে রাখ, তা না ইঁদুরের নাদির মতো কয়েকটা ফেলে রেখেছে নাকের তলায়!

রাধারমণ বিড়ি খান, খাওয়াদাওয়া অতি সাধারণ, পোশাকও সেরকম – ধুতি আর শার্ট। একটা বস্তিপ্রায় বাড়িতে থাকেন, একটা ঘরে ফ্যান যদিও আছে, গরম নিদারুণ না হওয়া পর্যন্ত তা বন্ধই থাকে। থাকা খাওয়া পরায় এর অন্যথা হলেই তা বিলাসিতা। তিনি যে চাকরিটা করেন তাতে এই কৃচ্ছ্রসাধন স্বাভাবিক নয়, এটা একেবারেই স্বেচ্ছা-আরোপিত। তাঁর পরিবার পরিজনের সকলের কাছেই তিনি এরকম কৃচ্ছ্রসাধনই প্রত্যাশা করেন। এইসব নিয়ে নরজিত অশোক ক্ষিতি ইত্যাদিরা নিজেদের মধ্যে হাসি-মস্করাই করে, তাঁর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা তাদের বোধের মধ্যে ধরা দেয় না।

ক্লাস নাইনে অশোকের স্কুল বদল হলো। ভর্তি হলো খিদিরপুর একাডেমিতে। ১৯৬৭ সাল, খাদ্য আন্দোলন তুঙ্গে। খিদিরপুর ট্রাম ডিপোর কাছে একটা ট্রামকে থামিয়েছে জনতা। ড্রাইভারকে টেনে নামিয়ে সারা ট্রামে কেরোসিন ছিটানোও সারা। দেশলাই জ্বালানোর ঠিক আগেই পুলিশ পৌঁছে গেল। সেই জনতার মধ্যে অশোক আর তার দুই বন্ধুও ছিল। দিলীপ আর প্রণব। প্রণব বয়সে বেশ বড়ো, মস্তানিতে হাত পাকাচ্ছে। জনতার মধ্যে থেকে পুলিশ তাদের পছন্দমতো বেশ কিছু আন্দোলনকারীকে ভ্যানে তুলেছে। পুলিশ দেখে অনেকেই পালিয়েছে, অশোকরা আছে। প্রণবকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। অশোক ভীষণই বন্ধুবৎসল। এগিয়ে গিয়ে ভ্যানের মধ্যে উঁকি দিয়ে দেখে তাকে ভ্যানে তুলেছে পুলিশ। সামনেই বসে আছে সে। অশোক হাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নামাতে গেল। সঙ্গে সঙ্গেই দুটো কনেস্টবল তার আর তার পিছনে দাঁড়ানো দিলীপের কলার ধরে ভ্যানে তুলে নিল। থানায় নিয়ে গিয়ে সোজা লক আপে। রাধারমণ খবর পেয়ে পরদিন গিয়ে থানা থেকে ছাড়িয়ে তাকে কিল-চড় মারতে মারতে ঘরে নিয়ে আসেন। দু-এক দিন পরে অফিসে ছুটি নিয়ে অশোককে বগলদাবা করে সোজা বাঁকুড়ার সাবড়াকোনে। সাবড়াকোন উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও ভালো স্কুল। ছাত্রদের থাকার জন্য বোর্ডিং আছে, তার দেশের বাড়ি থেকে খুব দূরেও নয়। বিশেষ সুবিধে যে তাঁর সেজ ভাই সেই স্কুলের ইংরাজির শিক্ষক। রাধারমণের মতো এই ভাইটিও বেশ কড়া অভিভাবক। তিনি সারা সপ্তাহ বোর্ডিঙয়েই থাকেন। তাঁর পরিবার দেশের বাড়িতে, সপ্তাহান্তে বাড়ি যান। সেখানে ভাইয়ের হেফাজতে অশোককে ভর্তি করে দিয়ে এসে খানিক শান্তি পেলেন রাধারমণ। যে-দু’বছর সাবড়াকোন বোর্ডিঙয়ে অশোক ছিল, তার নিত্যনতুন দৌরাত্ম্যে সেজকাকুর ভাবমূর্তি খানিক ক্ষয়ে গেলেও সেসব দাদার কাছে রিপোর্ট করে নিজের মান খোয়াতে চাননি তিনি।

ক্ষিতি তার হস্টেল থেকে প্রথম যে-রবিবার বহু খুঁজেপেতে খিদিরপুরে বাসায় পৌঁছতে পেরেছিল, সেদিন অমিয়র চিঠির বিবরণমতো সকলেই তাদের সর্বজনীন মামাকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত। অমিয় অশোক নরজিত দিলীপ বুলি। হস্টেলের ‘কাকু’ খিদিরপুরে পা দিয়ে নিমেষেই ‘মামা’ হয়ে গেল। অমিয়র মামা, অশোকের মামা, কাজেই নরজিতের, দিলীপের এবং বুলিরও মামা। দিলীপ আর বুলি অশোকের প্রাণের বন্ধু। অমিয় এক বছর আগেই স্কুল ফাইনাল পাশ করে পিসেমশায়ের কাছে এসে উঠেছিল। তাঁরই অভিভাবকত্বে সুরেন্দ্রনাথ কলেজে প্রি ইউনিভার্সিটি, সংক্ষেপে পি ইউ ক্লাসে ভর্তি হয়েছিল। এবছর সে পি ইউ পাশ করে সুরেন্দ্রনাথেরই নৈশ বিভাগে বিএসসি ক্লাসে ভর্তি হয়েছে। অশোক সাবড়াকোন থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে এসে নিউ আলিপুর কলেজে বিএসসিতে ভর্তি হয়েছে। বুলি আর দিলীপ এখানে তার সহবাসী আর কলেজে সহপাঠী।

অমিয় যে নৈশ বিভাগে ভর্তি হয়েছে তার একটা বিশেষ কারণ আছে। রাধারমণ বাগরি মার্কেটের এক প্রাইভেট কোম্পানিতে তার চাকরির ব্যবস্থা করেছেন। জয় ইন্ডাস্ট্রি গজ-ব্যান্ডেজ ধরনের মেডিক্যাল সরঞ্জাম তৈরি করে। সেই সূত্রে তারা সরকারি হাসপাতালের ভান্ডারির অনুরোধকে আদেশ বলে ধরে নিতে অভ্যস্ত। অতএব উনিশ বছরের অমিয় এখন  দিনে চাকুরে, রাতে ছাত্র। মাইনে একশো টাকা। সে অশোকের মতো বেয়াড়া নয়, পিসেমশায়ের যোগ্য অনুসারী। নিজের জন্য দশ টাকা মাত্র বরাদ্দ করে বাকি সবটাই জমায়, গ্রামে গেলে সেটা মায়ের হাতে তুলে দেয়। রাধারমণেরও সেরকম নির্দেশ। জুনসোলের রুখা জমিতে চাষবাস ভালো হয় না। অমিয়র বাবা পাঁচ বোনের একমাত্র ভাই। বড়ো আদরে মানুষ, স্বভাবসুখী। চাষবাস দেখাশোনার মতো পরিশ্রমসাধ্য কাজ তার পোষায় না। কাজেই অমিয়র মাকে সংসারের নিত্য অভাব সামলে চলতে হয়।

অশোকের ছোটকাকার চাকরি, নরজিতের চাকরি, অমিয়র চাকরি – হিসেব কেবল এখানেই শেষ নয়, কলকাতায় অভিভাবকহীন যতো আত্মীয়পরিজনের ছেলে পড়াশোনা করে, সকলের খোঁজ তিনি রাখেন। প্রয়োজনে তাদের টিউশনি থেকে ছোটখাটো চাকরি জুটিয়ে দেওয়া তিনি নিজের কর্তব্য বলে মনে করেন। এই কারণে তাঁর অগোচরে তিনি ‘কোম্পানি’ অভিধা অর্জন করেছেন। সৌজন্যে সুরসিক নরজিত। অশোক অমিয় নরজিতের ঘনিষ্ঠ মহলে রাধারমণের ‘কোম্পানি’ নামটি দ্রুত ছড়াচ্ছে।

এক ছুটির দিনের সকালে এই ‘কোম্পানি’ এসে হাজির হলেন ক্ষিতির হস্টেলে।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply