সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ৩৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

শ্রম, সাম্রাজ্য ও নিসর্গের রকমফের
শ্রমের মর্যাদা বলতে গ্রাহাম কি বুঝিয়েছিলেন, বুঝতে অসুবিধা হবার কথা নয়। শ্রম মানে শ্রম, নিতান্তই গায়ে গতরে খাটা, অন্যের প্রয়োজনে মজুর হয়ে খাটা। হোমে আসতো যে বাচ্চারা, তাদের তৈরি করা হতো সেইমতো। ছেলেরা শিখতো মিস্তিরির এবং চাষের কাজ, মেয়েরা ঘরগেরস্থালির। আমাদের গল্পে, জেন এবং অন্যান্যদের যে সব লেখাপত্রের উল্লেখ করা হয়েছে, তাতে দেখাই যাচ্ছে, মেয়েদের কাজ পাওয়া মানে ‘ভালো’ পরিবারে ‘কাজের লোক’ হওয়া, বড়জোর, ভালো প্রেমিক বা স্বামী পাওয়া। যে সব ছেলেদের কথা জানা যাচ্ছে, তারা কেউ খামারের মজুর, কেউ মিস্ত্রি, কেউ বা আবার কোন কাজেই টিকতে পারছে না বেশিদিন। হোম থেকে দফায় দফায় নিউজিল্যান্ড যাত্রার পর থেকে কমবেশি এক শতাব্দী অতিক্রান্ত, যে আবাসিকরা প্রথম গিয়েছিলেন, তাঁদের তৃতীয় বা দ্বিতীয় প্রজন্মের সঙ্গে জেনের যোগাযোগ ঘটেছে, বা তাঁরা নিজেরাই পারিবারিক ইতিহাসের খোঁজে হোমে আসছেন। নিউজিল্যান্ডপ্রবাসী কিম্বা অন্য পরবর্তী আবাসিকরা, বা তাঁদের সন্তানসন্ততি, যাঁদের কথা কেসাং-এর ছবিতে বিধৃত, তাঁদের সবার সঙ্গেই কালিম্পং পাহাড়ের, হোমের সম্পর্কটা নেহাৎ, নিতান্তই ব্যক্তিগত, গ্রাহাম সাহেব বা হোমের অন্যান্য কর্তাব্যক্তিদের সাম্রাজ্যচেতনা ও সাম্রাজ্যধর্ম সেই ব্যক্তিগত গল্পে মোটের ওপর অনুপস্থিত। অথচ, পুরোনো আবাসিকরা অনেকেই হোম বিষয়ে স্মৃতিকাতর, ‘উই হোমস চ্যাপস’ ছবিতে তাঁরা একবাক্যে বলছেন, হোমে কাটানো শৈশব কৈশোর তাঁদের ভবিষ্যত জীবনকে বহুলাংশে নিয়ন্ত্রণ করেছে। বাকিরা, আরো বেশি বয়সীরা, ভুলে যেতে চেয়েছেন, ভুলে গেছেন, নিজেদের ছেলে মেয়েদের কাছ থেকেও সযত্নে লুকিয়ে রেখেছেন পুরোনো গল্পকথা, সুখদুঃখের উপাখ্যান। কেন, কেন এবং কেন? জেন উত্তর খুঁজছেন, পাচ্ছেন না। শেষে তাঁর মনে হচ্ছে, হোমের জীবন মানে দিশি উৎস, দিশি শিকড়বাকড়, দিশি রক্ত, অর্থাৎ দিশি মা। গ্রাহাম এবং তাঁর হোম নিরবচ্ছিন্ন দৃঢ়তায়, সমস্ত উৎস মুছে ফেলতে চেয়েছে। শ্রম ও নিয়মানুবর্তিতা, হোমের সযত্ননির্মিত ‘সাদা’ পরিবেশ, অবশেষে বিদেশি উপনিবেশ যাত্রা, সবটাই সে প্রক্রিয়ার অংশ। রক্তের দোষ শ্রমে ও পরিবেশে মিটে যায়, গ্রাহাম সায়েবের হোম এই শিক্ষা দিতে চেয়েছে বরাবর। বিশ শতকের গোড়ায়, ১৯০১ সালে, হোমের নাম যখন ‘সন্ত অ্যান্ড্রু-র ঔপনিবেশিক বাড়িঘর’, বা ‘সেন্ট অ্যান্ড্রুজ কলোনিয়াল হোমস’, হোমের পত্রিকায় বলা হচ্ছে:
‘যেসকল ভারতীয় শিশুদের শিরায় ব্রিটিশ শোণিত প্রবাহিত, এই পত্রিকা তাহাদের হিতের কথা বলিবে।
এই কর্ম অতি মহৎ, যাহাতে সকল ব্যক্তি যাঁহারা আপন প্রতিবেশীগণকে ভালোবাসিয়া থাকেন, এবং বিশেষত:, যাঁহাদের হৃদয়ে ব্রিটিশ জাতি ও সাম্রাজ্যের প্রকৃততম উদ্দেশ্য রহিয়াছে, ইহাদের প্রত্যেকের সাহায্য লাগিবে। এই কর্ম উপযুক্তরূপে সাধনে প্রয়োজন সহযোগী শ্রমিকবাহিনী, এবং আমাদিগের লক্ষ্য, শ্রমদানে সদাপ্রস্তুত এইরূপ একটি বাহিনী তৈয়ার করা।’
হোমের মতো আরো নানাবিধ ইস্কুল পাহাড়ে ছড়িয়েছিটিয়ে আছে, যথা দার্জিলিং এর সেন্ট পলস, নর্থ পয়েন্ট, বা লোরেটো, কারসিয়াং-এর ডাওহিল, ভিক্টোরিয়া, গোয়েথেলস। যেহেতু দার্জিলিং পাহাড় আগে সায়েবদখলে আসে, এগুলোর গড় বয়স গ্রাহামস হোমের চাইতে বেশি, এবং এদের সবকটাতেই সায়েব ও সাম্রাজ্যমাহাত্ম্য শেখানো হতো। এখনো অবধি এই ইস্কুলগুলোর মধ্যে ঢুকলে সব বেভভুল হয়ে যায়, পুরোনো বাড়িঘরদোর, একইরকম ভিক্টোরিয় স্থাপত্য, ফাঁকা মাঠ, রাশি রাশি চিমনি, গড়ানে ছাদ। মিশনারী সহ অন্যান্য সায়েবরা ব্রিটিশ পাবলিক ইস্কুলের ধাঁচে এই সব ইস্কুলবাড়ি, ইস্কুল বানিয়েছিলো। বাইরের দেখায়, গ্রাহামস হোম অন্যরকম কিছু নয়, এবং একেবারে হালের কথা বললে, হয়তো ভিতর থেকেও নয়। কিন্তু অন্য আর দশটা মিশনারী বা সায়েবি ইস্কুল থেকে কালিম্পং-এর হোম একেবারে আলাদা, চরিত্রে, স্বভাবে, উদ্দেশ্যে, এবং বিশেষত, ইতিহাসে, যে ইতিহাসের গল্পে আমরা এতক্ষণ ছিলাম। অন্য ইস্কুলগুলো মূলত সায়েবশিশু এবং সায়েব হতে চাওয়া অবস্থাপন্ন বা ধনী দিশিদের জন্য তৈরি, গরীব অনাথ বাচ্চারা সেখানে জায়গা পেতো না, সাদা সায়েবদের ব্যভিচারক্লিন্ন আধা বা পোয়াটাক সাদা ইউরেশিয়ান বাচ্চারা তো নয়ই। যাদের কেউ নেই, গৃহহীন স্বজনহীন সেই শিশুদের জন্য গ্রাহাম সায়েব ‘গৃহ’ তৈরি করলেন, তাঁদের ‘মানুষ’ করে তুললেন, কাজ করতে বাইরে পাঠালেন। অন্য কোন সায়েবি ইস্কুলের এই দায় ছিলো না। সম্ভবত সেই কারণেই, বানানো সায়েবনিসর্গের মধ্যে ঢুকে থাকা অন্য দামী ইস্কুল নিয়ে নয়, গরীব হোম নিয়ে এখনো গল্প তৈরি হয়, সেই গল্প লোকে খুঁজে খুঁজে বার করে, পড়ে, যেমন, আমরা পড়লাম, পড়ছি।
পড়তে পড়তে আমরা দেখলাম, ভিতরবার মিলিয়ে একসঙ্গে দেখলে, দেখা নিসর্গের মধ্যেও অন্য বহু নিসর্গ থাকে, সায়েব অ-সায়েব মানুষের, তাদের মনের। নিসর্গ মানে নিসর্গের গল্প, স্মৃতি, নির্মাণ। হোমের ভিতরে বাইরে ঘুরে ঘুরে যে গল্পগুঁড়ো জড়ো করা হলো, তাতে দেখাবোঝা গেলো, গ্রাহাম সায়েবের উদ্দেশ্য যাই-ই থাক, হোমে জমা হওয়া বাচ্চাদের তিনকুলে বা সাতপুরুষে কেউ ছিলো না, ব্যাপারটা সবসময় এমন আদৌ নয়। বরং, চক্ষুলজ্জায় বা দোআঁশলা রক্তের কারণে, সায়েব বাবারা নিজেদের বাচ্চাদের পরিত্যাগ করছিলো, এবং দিশি মায়েদের কাছ থেকে প্রায়শই জবরদস্তি সেই বাচ্চাদের আলাদা রাখা হচ্ছিলো। অন্য দশটা সায়েবইস্কুলের চৌহদ্দিতে যদি সাম্রাজ্যের অবসৃত বৈভবগরিমা ফুটে ওঠে, কালিম্পং-এর হোমের প্রতি কটেজবাড়ির প্রত্যেক ঘরে, শয়ে শয়ে আলাদা করে রাখা শিশুদের কান্না ও ঘাম, থেকেও না থাকা মায়েদের যন্ত্রণা মিশে আছে। মেঘ কুয়াশায় ভিজে থাকা, রোদে ধুয়ে যাওয়া পাহাড়ি নিসর্গ দেখতে দেখতে সেই সব কান্নাঘামযন্ত্রণার কথা আমাদের মনে পড়ুক। পড়ে, আমাদেরও মন খারাপ হোক।
(ক্রমশ)