বাঘাচাঁদের কথাকাব্য। পড়লেন সজলকুমার বর্মণ

0

“বলো ভাই সবাই কার এঁজ্ঞে? বাঘাচাঁদের এঁজ্ঞে—”

বাঘাচাঁদের কথাকাব্য শুধু বাঘাচাঁদের কথাই বলে না, বলে বাদার দেশ সুন্দরবনের আদি কথা; হাড়হাভাতে মানুষের কথা, যারা চোখে স্বপ্ন নিয়ে বাদার মাটিতে পা রেখেছিল একদিন। বাদাকে আবাদে করেছিল কুড়াল আর কোদাল চালিয়ে; আর বলে সোঁদরবনের সামাজিক রীতিনীতি। রীতিনীতির কথা বললে যেটা এই বইয়ের পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে, তা হলো ভাইচারা, এর কারণ হয়তো সবাই ক্ষুধিত, তাই ক্ষুধাই বড় ধর্ম হিসেবে প্রকাশ পেয়েছে।

এবার আসা যাক গল্পের কথায়, মোট এগারোটি পর্বে বিভক্ত এই কথাকাব্য। আমি পর্ব অনুযায়ী গল্পের সার তুলে ধরার চেষ্টা করি—

‘সূচনা পর্বে’ দেখা যায় আকালে জর্জরিত মানুষদের বাঘের প্রতি ভয়, সুন্দরবনে এসেও তারা যেন হার মানে। সেখানে প্রাণের মায়া বিশাল। তারপর তাদের মধ্য থেকেই এগিয়ে আসে এক সাহসী, যে বাঘ মেরে শুধু বাঘাচাঁদ নাম পায়নি; পেয়েছে বন্ধু, যাদের চোখে সুখের স্বপ্ন।

‘পরিচয় পর্বে’ বাঘাকে রাজা ঘোষণা করা হয় আর জল পানির ভেদাভেদ ভুলে পুরোনো পরিচয় ত্যাগ করে সবাই আবাদে হয়ে ওঠার চেষ্টায় লেগে পড়ে।

বাদায় এবার বাঘের ভয় কম তাই লোকজনও আসতে শুরু করল বেশি, তারা বাঘাচাঁদ কে রাজা মানতে নারাজ তার কারন, বাঘা তো আর রাজার মতো জমকালো পোশাক পরে থাকেনা, কিংবা রাজমুকুট; তাই তারই প্রস্তুতির কথা চলে ‘প্রস্তুতি পর্বে’ আর বাঘাকে দেওতা সাজানো হয় ‘সাজগোজ পর্বে।

সবই তো হল, এবার রাজার তো একটা প্রাসাদ লাগবে নাকি! রাজা তো আর গরীবের মাঝখানে থাকবে না, তাই কোলাহল থেকে অনেক দূরে জঙ্গল লাগোয়া তিন গাঙের মুখে তৈরি হল তার গোলপাতার ছাউনিওলা সুন্দরী-পরশ-গরান-গেঁও কাঠের প্রাসাদ বাড়ি ‘অধিষ্ঠান পর্বে’।

তারপর লাগে বসন্তের ছোঁয়া, যখন ধুধুল গাছে ফুল ধরে আর ঘুঘু ডাকে কুরুর, তখন প্রেমগ্রন্থি পূর্ণ হয় রসে। সেই শালিডাঙার মেয়ের প্রেমে পড়ে বাঘা ‘প্রেম পর্বে। তারপর কী হয়? সে এক বিরাট ঝামেলা।..

‘সম্প্রীতি পর্ব’ চলে শালিডাঙায়। বুঝিয়ে দেওয়া হয় সোদরবনের রাজা বাঘাচাঁদকে উপেক্ষা করার ফলাফল। এরপর শুরু হয় বাদার দেশের বিভিন্ন জায়গার নামকরনের সমস্যা। তারই সমাধান হয় ‘নাম পর্বে’।

‘চুক্তি পর্ব’ হল আত্মউপলব্ধির পর্ব, যেখানে বাঘার সাথে সুন্দরবনের কালো হলুদের ডোরাকাটা বাঘ রাজার কথোপকথন চলে। গল্পের এখানেই সূত্রপাত দৃঢ় হয় বন্ধুদের রাজার প্রতি বিরুদ্ধাচরণ। তারপর তার পরিসমাপ্তি ঘটে ‘ক্ষয় পর্ব’ ও ‘অন্তিম পর্বে’। কীভাবে?— তাহলে আপনাকে বইটি খুলে একটু পড়ে ফেলতে হবে।

এখন প্রশ্ন হল এই বইটি কী তাহলে ইতিহাস মূলক? না তা একদমই নয়। লেখক নিজেই বলেছেন বাঘাচাঁদ কাল্পনিক চরিত্র তবে অনৈতিহাসিক নয়, আদতে আমার মনে হয়েছে এই গল্পের দ্বন্দ্ববিন্দু তৈরি হয়েছে দুই রকমভাবে; এক, বাঘাচাঁদের রাজা হয়ে ওঠা এবং দুই—সেকেলে আর হাল আমলের চিন্তাধারার সংঘর্ষ। একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা এবং রাজাকে কাঠের পুতুল করে চারিদিকে শোষণ, কোথাও গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাটক ‘রক্তকরবী’ বা ‘অচলায়তন’-এর কথা মনে করায়। এর মধ্যেই নতুনের আহ্বান এবং চিন্তনের পরিবর্তন এই ঠুনকো রাজনীতির প্রাচীরে ভাঙো ভাঙো রব তুলেছিল জোরালো। এবং শেষটায় সব কিছু চুরমার করে নতুন আলোতে যে মুক্তি, এরকমই একটা শেষ আশা করেছিলাম; পেয়েছিও।

এই বইটা নিয়ে যে কথা না বললেই নয়, তা হল লেখার আঙ্গিক। লৌকিক ছন্দে লেখা বই নিয়ে কাজ এখন খুব কমই হয়; কিংবা হয়তো আমার চোখে পড়েনি।

সবশেষে সৌজন্য চক্রবর্তীর করা প্রচ্ছদ এবং অদ্বয় দত্তের অলংকরণ এককথায় অসাধারন, অনবদ্য। কুর্ণিশ তাঁদের আর ‘সুপ্রকাশ’কে ধন্যবাদ।

……………………………………………………….

বই : বাঘাচাঁদের কথাকাব্য
লেখক : অনিল ঘোষ
প্রচ্ছদ : সৌজন্য চক্রবর্তী
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
কলেজস্ট্রীট বইপাড়ায় : সুপ্রকাশ, দেজ, দীপু ইত্যাদি।
বাংলাদেশে : ইন্দোবাংলা বুকশপ, বুকস অফ বেঙ্গল, বাতিঘর, কথাপ্রকাশ ইত্যাদি।

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *