অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৭। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

অনেকদিন পরে দেওয়াল লেখার এমন সাতকাহনের চর্চার প্রাসঙ্গিকতা এসে পড়ল যতীশ আর শিবেনের সূত্রে। দেখা গেল তাদের চেনাজানা লোকেরা তাঁদের দিয়ে দোকানের বারান্দার শেডের শিরোদেশে সাধারণ রঙ দিয়ে দোকানের নামটি বা দোকানের গায়েই পণ্যের পরিচয় বিজ্ঞাপিত করতে আগ্রহী। সাইনবোর্ড কিংবা দোকানের নাম বিজ্ঞাপিত করার জন্য এর চেয়ে বেশি খরচা করতে তাঁরা রাজি নন। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলিও নিজেদের কার্যক্রম লোককে জানানোর জন্য দেওয়াল লেখানোর কাজে যতীশ আর শিবেনকে বরাত দিতে চায়!

প্রথম প্রথম খারাপ লাগলেও নিয়মিত কাজ পাওয়ার স্বার্থে সুমন এটা মেনে নিয়ে দেয়াললিপিকেও জ্ঞাপনী-সৌকর্ষের মাপকাঠিতে দেখতে সচেষ্ট হলেন। ফলে দেওয়াল লেখার অভিজ্ঞতার জগতে যতীশ আর শিবেনের চর্চিত দক্ষতার মিশেল নতুন কৌণিকতায় আলোকিত হলো।

একইভাবে কাগজের পোস্টার রচনার ক্ষেত্রেও পুনর্যাত্রার সূচনা দেখা গেল।

ছোটোখাটো অনুষ্ঠান, ঘোষণা―দু-দশদিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিতব্য কোনোকিছু, পাড়ার ক্লাবের দ্বারা আয়োজিত ক্যারম বা বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, মণিমেলার কোনো অনুষ্ঠান, লাইব্রেরির পক্ষ থেকে বসে আঁকো কিংবা আবৃত্তি ও সংগীত প্রতিযোগিতার তারিখ বা নিয়ম-কানুন ঘোষণা, মা চণ্ডী পূজা কমিটির বার্ষিক সাধারণ সভার আহ্বান, ড্রইংশিটে লেখা ‘চলো যাই বে়ড়িয়ে আসি দীঘা / দুই রাত, তিন দিন / সঙ্গে কোনারক, নন্দনকানন, চিল্কা হ্রদ /  শুভযাত্রা….’ পাড়ার চা-দোকানের বাঁশের খুঁটিতে বাঁশের ফ্রেম দিয়ে টাঙিয়ে দেওয়া দোদুল্যমান বিজ্ঞাপনের কাজও যতীশ আর শিবেনের জন্যই প্রচুর আসতে লাগল।

ডিমাই, ডবল ফুলস্ক্যাপ বা ক্রাউন সাইজের  কাগজে পোস্টার লেখার কাজটা দেওয়াল লেখার মতোই কঠিন ও বহুতর সাপেক্ষতানির্ভর। প্রথমত কাগজের অবতল খুব বেশি খসখসে বা খুব বেশি তেলতেলে হলে তাতে ইচ্ছামতো তুলি চালনা করা কঠিন কাজ। লেখার কাগজের মতো স্বাভাবিক অবতলযুক্ত কাগজই লেখার পক্ষে সেরা। ভালো করে পোস্টার লিখতে হলে নানা ধরনের তুলি ব্যবহার করতে হয়, সরু থেকে ধাপে ধাপে মোটা―গোল আর চ্যাপ্টা―সোজা করে কিংবা তিনকোণা করে ছাঁটা―লম্বা দাঁড়াওয়ালা অথবা বেঁটে করে ছাঁটা―লম্বা বা বেঁটে হ্যাণ্ডেল―ইত্যাকার নানান কিসিমের তুলি কাছে রাখতে হয়। রাজনৈতিক কর্মীরা কোথায় পাবেন এতসব তুলি! তাঁরা সাধারণ তুলির সঙ্গে দেশলাইয়ের ভাঙা বাক্সর থেকে পাওয়া কাঠের পাতলা অংশকে মাপমতো কেটে, ডগাটা তিনকোণা করে ছেঁটে সেই অভিনব তুলি রংয়ে চুবিয়ে কাগজের বুকে হরফ রচনা করেন। অন্তত আশির দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত সুমন এই সেল্ফমেড তুলিতে খুবই স্বচ্ছন্দ ছিলেন। এতদিন পরে আবার দেশলাইয়ের খাপ দিয়ে কাগজ আর ড্রইং শিটে লিখতে গিয়ে সমান আরাম বোধ করলেন তিনি। এ-দিয়ে লেখার প্রধান সুবিধা এই যে, সাধারণ বাংলা হরফ খুব সহজে তার কোণ রক্ষা করে করা যায়, অল্প জায়গায় ছোটোমাপের হরফ খুব স্পষ্ট ও পরিচ্ছন্নভাবে তাড়াতাড়ি লেখা সম্ভব হয়। কিছু সহজ ডিজাইনও স্বল্পায়াসে নির্মাণ করা যায়! দেশলাইয়ের এই অংশ দিয়ে খুব সরু লাইন নিখঁতুভাবে টানা সুবিধাজনক।

একবার ভোটের আগে হাওড়ার এক গ্রামীণ এলাকায় ওয়ালিং করার জন্য আর্ট কলেজ থেকে তিনজনের একটা দলে সুমনও ছিলেন। সেখানে স্থানীয় ইস্যু নিয়ে মাটির দেওয়ালে কয়েকটা ওয়ালিং করতে হয়েছিল। মাটির নিকানো দেওয়াল সিমেন্ট বালিতে প্লাস্টার করা দেওয়ালের থেকেও মসৃণ। চুনের গোলা লাগাবার পর এই দেওয়ালও আর বেশি রং টানে না, রংয়ের উজ্জ্বলতাও থাকে অমলিন। এখানেই স্থানীয় এক দেওয়াল লিপিকার সম্ভবত গাছের ডাল তুলির মতো করে কেটে তার ডগা দেড় ইঞ্চি পরিমাণ ছেঁচে, ছ্যাঁচা ডগাটা কাঁচি দিয়ে তুলি বানিয়ে একেবারে তাক্ লাগিয়ে দিয়েছিল। এই প্রাকৃতিক ব্রাশের আয়ু একটু কম, কিন্তু অভ্যাস করলে লেখা যায় চমৎকার। বিশেষ করে বৃহদায়তন দেওয়ালে বড়ো হরফ ভরাটের কাজে খুবই কার্যকরী। ফাইবারওয়ালা গাছের ডালের এমন ব্রাশ নানা মাপের তৈরি করা যায়।

কাগজে লেখার জন্য রঙের ঝামেলাও কম নয়। যেসব দামি রঙ দেওয়ালে ব্যবহার করা হয় সেগুলো দিয়ে কাগজে লেখাও চলে। কিন্তু সেই রঙ গুলবার জন্য ভালো গদের বা তেঁতুল বিচির (কাই-বিচি) আঠা দরকার হয়। আশির দশকের শেষদিকে জলে দ্রবণযোগ্য পলিমারযুক্ত সিন্থেটিক আঠা এসে পড়ায় আঠার সমস্যার বহুলাংশে সমাধান হয়। এই আঠা দিয়ে গোলা রং তাড়াতাড়ি কাজে লাগাতে হয়, না হলে বাতাসের সংস্পর্শে সরের মতো জমে যেতে পারে। ড্রইং শিটে লেখার জন্য সৌখিন লিখিয়েরা শিশির জল রংয়ের বদলে ফেব্রিকের রং ব্যবহার করেন, স্বভাবতই ফেব্রিকের রংয়ের ঘনত্ব ও গভীরতা অনেক বেশি।

কাজের চাপ, রোজগারের ধারাবাহিকতা, নতুন কিছু করার উত্তেজনায় সুমনের ভেতরে যে দ্বিধা কাজ করছিল তা অপসৃত হলো। এর মধ্যেই প্রচুর পরীক্ষা-নিরীক্ষা করলেন তিনি।

বাদল মুন্সির সহায়তায় কাঠের অক্ষর দিয়ে বোর্ড বানালেন, মিষ্টির দোকানের শো-কেসের গায়ে কিংবা কাপড়ের দোকানের কাউন্টারের সামনের দিকে কাঁচের গায়ে বিবিধ আকর্ষণীয় উজ্জ্বল রঙ দিয়ে উইণ্ডো রাইটিং করে দিলেন, বয়েজ আর গার্লস ইস্কুলের গেটের ওপর লোহার শিট দিয়ে অর্ধ-ডিম্বাকৃতি বোর্ড বানিয়ে তাতে পালিশ-করা পিতলের পাতকে বক্স-অক্ষরে রূপ দিয়ে ইস্কুলের নাম লিখে দিলেন।

পাথরে, কাঠে, পিতলের পাতে, টিনে, লোহা বা জি-আই শিটে, করোগেট শিটের সাইনবোর্ড বানালেন তিনি। শুধু নিত্য-নতুন উপকরণ ব্যবহারই নয়, নানা ছাঁদের অক্ষর লিখে তাঁরা জনপদজনেদের একেবারে তাক লাগিয়ে দিলেন।

কাঠের অক্ষরে সুমন ত্রিমাত্রিকতা আমদানি করলেন। কাজটা করল অবশ্য বাদল মুন্সি। সুমন একবারই মাত্র বাংলাদেশের শিল্পকলা একাডেমির চারুকলা বিভাগে দিন-দশেকের জন্য প্রশিক্ষণ-সংক্রান্ত কাজ করতে গিয়েছিলেন। তখন তাঁদের ঢাকার শিল্পকলা একাডেমী ছাড়াও রাজশাহি আর চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমীতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। ঢাকায় আলাপ হয়েছিল আজরানুল আখতারের সঙ্গে। বাড়ি তার ময়মনসিংহ বিভাগের শেরপুরে। তাঁর সঙ্গে শেরপুরে গিয়েছিলেন সুমন। শেরপুর কাঠের কাজ, বিশেষ করে দারুতক্ষণের কাজ সমন্বিত আসবাব নির্মাণের জন্য মোটামুটি খ্যাতি পেয়েছে। এই শেরপুরেই দেখা মিলেছিল অক্ষর শিল্পের। কাঠের অক্ষরে নাম লেখা! যন্ত্রচালিত সরু করাত দিয়ে নিমেষের মধ্যেই অক্ষর তৈরি করার কৌশলও দেখেছিলেন। শেরপুরের গারো পাহাড়ের গজনী অবকাশকেন্দ্রে এক রাত ছিলেন, সেখানে অবকাশকেন্দ্রের বাইরে পশরা সাজিয়ে বসেছিলেন অক্ষর-শিল্পীরা। প্রতিটি অক্ষরের দাম মাত্র দশ টাকা! পর্যটকেরা অনেকেই কাঠের হরফে নিজের বা প্রিয়জনের নাম লিখিয়ে নিচ্ছিলেন। সুমন শুনেছিলেন যে, বাংলাদেশের দিনাজপুরসহ অন্যত্রও অমন কাঠের হরফ নাম-লেখানোয় এবং গৃহসজ্জায় অত্যন্ত জনপ্রিয়।

এখানে যদি উপকরণ সংগ্রহের এবং কারিগর আরও পাওয়ার সুবিধা থাকত তবে তিনি আরও বৈচিত্র্যের চর্চা করতে পারতেন। আর্ট কলেজে পড়ার সময় এসবের চর্চা কিঞ্চিৎ করতে হয়েছিল প্রথমে দায়ে পড়ে, পরে নিজের আগ্রহ থেকেও জান-পহেচান বেড়েছিল অনেকটা।

 

(ক্রমশ)

……………………………………….

(রচনার সঙ্গের ডিজাইনগুলি শিল্পীর দ্বারা অঙ্কিত বা পুনরঙ্কিত, আন্তর্জাল থেকে সংগৃহীত ও সম্পাদিত এবং বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে গৃহীত। রচনার শেষে একটি বিস্তারিত সূত্র পরিচয়ে তা উল্লেখিত হবে)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *