সৌভাগ্যশলাকা। ধারাবাহিক উপন্যাস। পর্ব ৮। লিখছেন অলোক সান্যাল

0

(গত পর্বের পর)

স্বীকারোক্তি

………………………

‘কী হয়েছে বন্ধু? তোমাকে এত সন্ত্রস্ত আগে কখনো দেখিনি! কাকে ভয় পাচ্ছ?’

 

দুই পুরোনো বন্ধু মুখোমুখি বসে। ছাদের খোলা অংশ দিয়ে অবাধে আলোর অনুপ্রবেশ ঘটেছে। সেই আলোতে বৃদ্ধ পিলেতের মুখমণ্ডল আরও পাংশুল মনে হচ্ছে। অ্যালবিনাসের কথায় চারপাশে নজর বুলিয়ে কাঁপা স্বরে জবাব দিলেন বহিস্কৃত মানুষটি, ‘চারপাশের সবাই, সবকিছু আমার আতঙ্কের কারণ। পৃথিবীর সকলের চোখে আমি একটা ঘৃণ্য কীট। ইহুদিরা আমাকে স্বৈরাচারী মনে করে। আমার নিজের দেশ আমাকে অপরাধীর কাঠগড়ায় তুলতে উদ্যত। নাজরাতীয়রা আমাকে তাদের মাসিহা, ঈশ্বরের হত্যাকারী ঠাওরেছে। কুৎসিত ভাষা প্রয়োগ করে তারা। আমি সর্বস্বান্ত বন্ধু।’

‘ঈশ্বরের হত্যাকারী! তুমিও কি অন্তত এই বিষয়ে নিজেকে দোষী মনে করো? তোমাকে চিরকাল সৎ ভেবে এসেছি, এই শেষ বয়সে এসে সেই ধারণা ভেঙে দিও না বন্ধু।’

‘একেবারেই না।’

প্রায় চিৎকার করে উঠলেন পিলেত। তারপরেই চমকে উঠলেন। সভয়ে তাকালেন চারিপাশে। গলা যথাসম্ভব খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এখানে খোলাখুলি কথা বলা নিরাপদ?’

‘নিশ্চিন্ত থাক। এখানে আমাদের কথা শোনার মতো কেউ নেই। তবুও তুমি যখন দ্বিধায় রয়েছ…’

বলে নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে গেলেন প্রবীণ অ্যালবিনাস। জানালা দিয়ে এক ভৃত্যকে ডেকে নিলেন।

‘তুমি প্রবেশদ্বারের সামনে দাঁড়িয়ে থাক। কেউ এলে তৎক্ষনাৎ যেন আমাকে সতর্ক করা হয়।’

ভৃত্যটি মাথা নেড়ে বিদায় নিতে তিনি আবার নিজের আসনে ফিরে এলেন। সামনে সাজিয়ে রাখা পান পাত্র ভরে বন্ধুকে দিলেন। নিজেও নিলেন।

‘এবার বলো। আমি খোলাখুলিই আলোচনা করতে চাই। যা শুনেছি, তার সত্যতা যাচাই করা দরকার।’

‘নাজরাতীয় জিশু সম্পর্কে অনেক অভিযোগ আমার কাছে জমা পড়েছিল।’ পিলেত বলে চললেন, ‘আমি সে বিষয়ে যথাযথ তদন্ত করেছিলাম। সত্যি বলতে আশ্চর্য মানুষটা আমাদের বিরুদ্ধে, রোমের শাসনের বিরুদ্ধে কোনো বিরূপ কথা বলেনি। তার অধিকাংশ বক্তব্য ছিল ইহুদি যাজকদের স্বৈরাচারী মনোভাব, মহাযাজকের দূর্নীতি, এবং সম্ভ্রান্তদের বিরুদ্ধে। তারাই জিশুকে নিজেদের পথ থেকে সরাতে যাবতীয় ষড়যন্ত্র করেছিল।’

‘আশ্চর্য, তারা আমাদের মন্দির কিংবা জাদুকরদের থেকে জিশুর মৃত্যু নিয়ে বেশি আগ্রহী ছিল!’

‘একেবারেই তাই বন্ধু। ইহুদি যাজকসভাতেই ক্রুশবিদ্ধকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। অথচ তাদের অভিযোগ এবং শাস্তি নিয়ে সেই আশ্চর্য মানুষের কথা শুনলে তুমি অবাক হয়ে যাবে।’

অ্যালবিনাস সামান্য ঝুঁকে বসলেন। বিগত বছরগুলোতে নাজরাতীয় জিশুর সম্পর্কে অনেক কথাই তাঁর কানে এসেছে। ক্রুশবিদ্ধকরণ এবং পরবর্তীতে মাসিহার মৃত্যু থেকে ফিরে আসার কাহিনী।

‘বলো বন্ধু পিলেত। একজন সাধারণ ইহুদিকে তুমি বারংবার আশ্চর্য মানুষ বলে সম্বোধন করেছ! নাজরাতীয় জিশু নিঃসন্দেহে আমাদের মনযোগ দাবি করে।’

‘আমি তার শাস্তি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করায় সে বলেছিল- হে মহান প্রশাসক, আপনি যথেষ্ট প্রভাবশালী হলেও নদীর গতিপথকে বদলাতে পারবেন না। ফ্যুমাইলো পর্বত থেকে নেমে আসা জলধারাকে বিপরীত মুখে চলার নির্দেশ দিলে, টাইবার নদী আপনাকে অবজ্ঞা করবে। বলবে আমি একমাত্র ঈশ্বরের নিয়ম পালনে বাধ্য। ঠিক তেমনই আমি, ঈশ্বরের সন্তান, আমার পিতার নির্দেশ পালন করছি মাত্র। পাপ, অনাচার, নীতিহীনতায় মাটি দূষিত। গাছের ফল পচে যাওয়ার আগে নিরীহ রক্তে মাটিকে পবিত্র করার দায় নিয়ে এসেছি। এই বলে আমার সমস্ত প্রচেষ্টা নাজরাতীয় জিশু ব্যর্থ করে দিয়েছে।’

‘সত্যিই আশ্চর্য এক মানুষ! ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক পবিত্র সমাজ তৈরি করতে চেয়েছিল যে মানুষটা, তার এমন করুণ পরিণতি! এ আফসোস অপূরণীয় বন্ধু পিলেত।’

‘আফসোস! পরিতাপের পাহাড়ে আমি বাস করেছি বন্ধু অ্যালবিনাস। সেই অভিশপ্ত ঘটনার মাত্র তিন দিন পরে, আমি যখন জুডেয়ার অবস্থা জানিয়ে সম্রাট টাইবেরিয়াসকে চিঠি লিখছি, হঠাৎ বিউগলের শব্দ কানে এল। জানালা দিয়ে দেখি রোমান সৈন্যদল শহরের প্রাচীর সীমার মধ্যে! হায় ঈশ্বর, তাদের যদি আর মাত্র কয়েকটা দিন আগে পেতাম, এমন দুঃসহ স্মৃতির বোঝা আমাকে বইতে হতো না। তবে শুধু আফসোস নিয়ে আমি বসে থাকিনি বন্ধু। ভেড়ার ছাল পরে যেসব ধূর্ত শেয়াল জুডেয়ার আনাচেকানাচে লুকিয়ে ছিল, গর্ত থেকে টেনে বের করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরেছি।’

‘ইহুদিদের বুকে আতঙ্কের মেঘ তৈরি করে তুমি দ্বিতীয় ভুল করেছ বন্ধু পিলেত। জুডেয়ার অস্থিরতা রোম, এমনকি দামাসকাসে তোমার শত্রুদের শীতঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। সিরিয়ার ল্যাগেটাস ভিসিলিয়াস ধারাবাহিকভাবে রোমে চিঠি পাঠিয়েছেন। সঙ্গত করেছেন ম্যারি মাগদালিন। তুমি কি ভদ্রমহিলাকে চেন?’

‘শুনেছি তাঁর কথা। ধুরন্ধর মহিলা। চিন্তাভাবনায় দার্শনিক মার্কাস টুলিয়াস সিজেরোকে মনে পড়ান। আর হৃদয়ে একজন দুর্ধর্ষ রোমান সৈনিকের মতোই সাহস ধরেন। তিনি আমার বিরুদ্ধে সম্রাটের কান ভারী করেছেন। যে মাথাগুলো নিরপরাধ একটা মানুষকে ক্রুশে তুলতে বাধ্য করেছিল, আমি তাদের গলায় রোমান তরবারি রেখেছি মাত্র। অথচ এই ভদ্রমহিলা স্পষ্টভাবে আমাকে অভিযুক্ত করেছেন!’

পিলেত পুরোনো কথাগুলো মনে করে ক্রমশ উত্তেজিত হয়ে উঠতে শুরু করলেন। হাতের পানপাত্র নিঃশেষ করে আবার পূর্ণ করে নিলেন। দ্রুত আবার তা খালি হতে পাত্র নামিয়ে রাখলেন। তারপর গোপনীয়তার কথা ভুলে গলা উঁচুতে তুললেন।

‘হ্যাঁ, আমি স্বীকার করছি নাজরাতীয় জিশুর হত্যাকারীদের শাস্তি দিতে আমি কোনো কার্পণ্য করিনি। অথচ জিশুর অনুসারী হয়েও ম্যারি তার জন্য আমাকেই দোষারোপ করেছেন! আমি নাকি কেবল নিজের স্বার্থ রক্ষায় সেই আশ্চর্য মানুষের ক্রুশবিদ্ধকরণে অনুমতি দিয়েছিলাম। আমি, পয়েন্টাস পিলেত, তার পরেও জুডেয়ার প্রশাসক হয়ে নীতিহীনতার পথ থেকে সরে আসিনি। ইতর ইহুদিগুলোকে হত্যার মধ্যে দিয়ে আমি নাকি নাজরাতীয় জিশুর মৃত্যুর প্রতিশোধ নিতে চাওয়ার মতো পাপ করেছি! সেই মানুষটার জন্য টাইবার নদীর জলের রঙ বদলে দিয়েছি যে ক্রুশবিদ্ধ হয়েও নিজের শত্রুদের জন্য ঈশ্বরের কাছে ক্ষমার অনুরোধ করে গেছে। এরপরেই সম্রাট টাইবেরিয়াস আমাকে জুডেয়ার প্রশাসক পদ থেকে অপসারণ করেন। আমার দুর্ভাগ্য দেখ, রোমে ফিরে সম্রাটের কাছে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি রাখার সুযোগটুকুও পেলাম না! রোমে পৌঁছানোর পূর্বেই তিনি নিহত হলেন। আর তারপর, ক্যালিগুলা নানান অজুহাত খুঁজে গেছেন আমাকে অপদস্ত করার। তাতেও সম্রাটের সন্তুষ্টি মেলেনি। অবশেষে বহিষ্কার। কী নিদারুণ ভাগ্য আমার!’

‘যথার্থ বলেছ বন্ধু। ভদ্রমহিলা সম্রাট টাইবেরিয়াসের সামনেও একইরকম অকপট ছিলেন! সত্যি বলতে, এ বিষয়ে ম্যারি মাগদালিনের মতামত আমি একেবারে অগ্রাহ্যও করতে পারছি না। ভাগ্যের কথা আমাদের অজানা, কিন্তু নিজের দায়িত্ব নয়! সবকিছু জানার পরেও নিজের কর্তব্য পালন না করে তুমি ঈশ্বর এবং মানুষ, উভয়কেই রুষ্ট করেছ।’

‘অ্যালবিনাস, বন্ধু আমার, তুমিও আমাকে কাঠগড়ায় তুলছ! বিশ্বাস করো, যে কারণে আমাকে রোম আজ ব্রাত্য করেছে, তা আমার ব্যক্তিগত ছিল না। একেবারেই নয়। এই ইহুদিগুলো ইঁদুরের মতো সুযোগসন্ধানী। ভীষণ কূট এবং স্বার্থপর।’

অ্যালবিনাস উঠে দাঁড়ালেন। হাতের পানপাত্রের অবশিষ্ট সুগন্ধি ভেষজ মিশ্রিত তরল গলায় উপুড় করে দিলেন। তারপর ধীর অথচ অবিচলিত কণ্ঠে বললেন,

‘এ তোমার ভুল ভাবনা পিলেত৷ কোনো জাতিকে সাধারণভাবে বিচার করা অনুচিত। প্রত্যেক জাতির মধ্যেই ভালো-মন্দ মিশে থাকে। এমনকি আমরা, রোমানরাও যে সকলে নিষ্পাপ তা নয়। তুমি নিজেকে দিয়েই বিচার করে দেখ।’

স্পষ্টবাদী অ্যালবিনাস নিজের মনোভাব আড়ালে রাখলেন না। অতীতের খেলার সঙ্গীটি তাঁর কথায় আরও মুষড়ে পড়বে জেনেও জুডেয়ার প্রাক্তন প্রশাসককে রূঢ় সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিলেন। আলোচনার প্রায় শেষের পথে। তাঁর বন্ধুকে টাইবেরিয়াস দ্বারা প্রথমে জুডেয়ার প্রশাসক পদ থেকে অপসারণ, এবং তারপর ক্যালিগুলা কর্তৃক রোম থেকে বহিষ্কারের কারণ এখন এই দিনের আলোর মতোই পরিষ্কার। রোমের বিরুদ্ধে পয়েন্টাস পিলেতের অভিযোগের ভিত্তি আদতে ভীষণ ঠুনকো। যা শোনার এবং যেটুকু বোঝার প্রয়োজন ছিল, প্রায় সাঙ্গ হয়েছে। অ্যালবিনাসের নির্দেশ পেতেই এক পরিচারিকা হাজির হলো। তাকে মুলসম এবং সঙ্গে মধু পরিবেশনের নির্দেশ দিয়ে বিতারিত এবং বিতর্কিত জুডেয়ার প্রাক্তন প্রশাসকের মুখোমুখি আসন নিলেন তিনি। আলোচনার শুরুতে রেজিনের প্রলেপ দেওয়া পাত্র ভরা পানীয় এনে রাখা ছিল। মনের জ্বালা প্রশমনে পিলেত তার অধিকাংশই গলাধঃকরণ করেছেন। তাতে মানসিক অস্থিরতা বরং ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে। কথায় অসংলগ্নতা বেড়েছে। লাভই হয়েছে তার ফলে। অভিজ্ঞ বৃদ্ধ প্রশাসক মনের আগল খুলে কথা বলেছেন। একসময়ের সঙ্গী এবং পুরোনো বন্ধুকে নিয়ে আবেগে বাঁধা পড়েছিলেন সজ্জন অ্যালবিনাস। বন্ধু নিজে সেই দায়বদ্ধতা থেকে মুক্তি দিয়েছে।

‘অতীতের সমস্যা থেকে আমরা বর্তমানে আসি। এ শহর তোমাকে বারবার কঠিন প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। গলবাসীরা জীবন অতিষ্ঠ করে তুলবে। রাস্তায় তোমাকে ঘিরে মুহুর্মুহু বিক্ষোভ সংঘটিত হবে। আমার মতে শেষ আশ্রয় হিসেবে এ শহরকে বিবেচনায় না রাখলেই ভালো করবে তুমি। তার চেয়ে বরং শহর থেকে দূরে পাহড় ঘেরা কোনো ভিলায় বাকি দিনগুলো স্বচ্ছন্দে কাটিয়ে দিতে পারো। মনে হয় না আমাদের গভর্নর এ বিষয়ে কোনো আপত্তি জানাবেন। প্রয়োজনে আমি নিজে তাঁর সঙ্গে কথা বলব। পাহাড়ের স্বাস্থ্যকর আবহাওয়া এবং নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে যদি তোমার মন ধীরে ধীরে কিছুটা শান্ত হয়।’

বৃদ্ধ পিলেত অবাক দৃষ্টিতে নিজের ফেলে আসা সময়ের সুখ-দুঃখের সঙ্গীর দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। তারপর নিজের অবসন্ন মন এবং ভারী শরীরকে কোনোক্রমে ঠেলে তুললেন। দীর্ঘ পানের ফলে তাঁর পা দুটো বেসামাল হতে চাইল। প্রায় একই সুরে তিনি প্রিয় বন্ধুর উদ্দেশে বললেন, ‘সেক্ষেত্রে অ্যালবিনাস, আমি কি ধরে নেব যে আমার জন্য এ বাড়ির দরজা তুমি বন্ধ করে দিতে চাইছ?’

‘পরিস্থিতি বন্ধু…’ কিছুটা দ্বিধান্বিত কণ্ঠে অ্যালবিনাস বললেন, ‘এবং বিভিন্ন বিষয়ে তোমার ভুল সিদ্ধান্ত। নাজরাতীয় জিশুর মৃতদেহের কথাই ধরা যেতে পারে। একটা শরীর সমাধি থেকে উধাও হয়ে গেল, অথচ তুমি তা নিয়ে তদন্ত করার প্রয়োজন মনে করলে না! তারপর জুডেয়ায় ইহুদিদের প্রতি তোমার বিদ্বেষমূলক আচরণ। একটার পর একটা ভুল করেছ তুমি। তোমার ভুলের জন্য আমি কারোর বিরাগভাজন হতে চাই না।’

‘বুঝলাম।’ খানিকটা সময় নিয়ে অস্বাভাবিক ধীরে কথাটা বললেন পিলেত।

‘তুমিও আমাকে অপরাধী মনে করো। এবং রোমে একজন অপরাধী কখনো অতিথির মর্যাদা পায় না। বেশ, তবে তাই হোক। আমার ভৃত্যদের খবর পাঠাও। আর দেরি করতে চাই না।’

‘ভৃত্য! তারা তো চলে গেছে। এমনকি তোমার দুই রক্ষীরাও। কেবল এক বয়স্ক রক্ষী রয়েছেন।’

‘ওহ্ লুসিয়াস, ধন্য তুমি।’

বয়স্ক রক্ষীর উদ্দেশে বলে উঠলেন পিলেত। তারপর ছেলেবেলার খেলার সঙ্গীর দিকে এগিয়ে গেলেন। আবেগ মথিত স্বরে বললেন, ‘তোমাকে ধন্যবাদ অ্যালবিনাস। একজন পাপবিদ্ধ মানুষের জন্য অনেকটা সময় তুমি ব্যয় করেছ।’

অ্যালবিনাস বন্ধুর চোখ থেকে নজর সরিয়ে নিলেন। সিদ্ধান্তটা নিঃসন্দেহে বেদনাদায়ক। স্মৃতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। কিন্তু এছাড়া অন্য কোনো পথ তাঁর সামনে খোলা নেই। সকলের চোখে অপরাধী একটা মানুষকে তিনি আশ্রয় দিতে পারেন না। পিলেত সম্পর্কে তাঁর নিজের ধারণাও আলাদা নয়। তবুও এই মানুষটা তাঁর বন্ধু। একজন কাছের মানুষ। গলায় ঘনিয়ে ওঠা বাষ্পকে উবে যেতে সময় দিলেন সজ্জন অ্যালবিনাস। পরিচারিকা বড়ো পাত্র ভরে মুলসম এবং মধু দিয়ে গিয়েছিল। ভারী আহার গ্রহনের আগে শরীরকে আগ্রহী করে তোলার জন্য রোমানদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় পানীয়। অবশ্যই সম্ভ্রান্ত রোমানদের মধ্যে৷ সাধারনের জন্য ব্যবস্থাও অতি সাধারন। পোসকা কিংবা লোরা। আঙুরকে দু’বার পেষাই করার পর পরে থাকা অংশকে আবার ছেঁচে তৈরি করা পানীয়।

অ্যালবিনাস বন্ধুর হাত দুটো নিজের তালুতে ভরে নিলেন।

‘খাবার প্রস্তুত। এসো দু’জনে কিছুটা পান করি। তারপর…’

‘না বন্ধু। আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না।’

পিলেতের কণ্ঠস্বর শুনে মনে হলো দুঃসহ ভবিষ্যতের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করে নিয়েছেন।

‘আমাদের আবার দেখা হবে বন্ধু পিলেত।’

অ্যালবিনাস বললেন। তখনো তাঁর অজানা ছিল অতি সত্তর জুডেয়ার প্রাক্তন প্রশাসকের জীবনে পাকাপোক্ত দাড়ি নেমে আসতে চলেছে। কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে পাহাড় চুড়ো থেকে নিজের রক্তাক্ত অতীতে ঝাঁপ দিতে চলেছেন রোমের কাছে ব্রাত্য বৃদ্ধ পয়েন্টাস পিলেত।

 

 

অদম্য একঝাঁক যোদ্ধা

…………………………………..

ওরা বিদুৎ, ওরা ঝড়

ওরা সূর্যে শান দেয় অস্ত্র

পদভারে শত্রুরা ত্রস্ত

মৃত্যুও কাঁপে থর থর।

ওরা বিদুৎ, ওরা ঝড়।

 

সুরে সুরে বলা শব্দগুলো এখনো মরিসের কানে আন্দোলিত হচ্ছে। সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানের নির্দেশ মেনে তারা গলের পথে বহুদূর এগিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠা বিদ্রোহীদের দমন করা। দায়িত্ব দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেছে থেবান লিজিয়ন। তারপর অ্যাপেইন ওয়ে ধরে ব্রিক্সিয়া, ক্রিমোনা, মেডিওলানেমের মতো বসতি পেরিয়ে পইনাইনাস মনস-এ( এখন সেণ্ট বার্নার্ড পাস) এসে পৌঁছেছিল। চলার পথে ভিড় জমিয়েছিল স্থানীয়রা। তাদের অবাক দৃষ্টি স্থির হয়ে ছিল সুসংবদ্ধভাবে হেঁটে চলা সৈন্যদলের ওপরে। আর মুখে ছিল অদ্ভুত ছন্দে বলা কথাগুলো-‘… ওরা বিদুৎ, ওরা ঝড়।’

অতিরঞ্জিত নয়। ৬৬০০ সদস্যের দলটা যখন পাহাড়ি রাস্তা ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছিল, উদ্ধত সূর্যালোক তাদের বর্মে প্রতিফলিত হয়ে আরও হাজার সূর্যের জন্ম দিয়েছিল! তাদের সুশৃঙ্খল পদচারণায় বুঝি কেঁপে উঠছিল আল্পসের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ! এমন দৃপ্ত, নির্ভীক লিজয়নের নেতৃত্ব দিতে পেরে মরিস নিজেও কম গর্বিত নয়। মরিস, তার দুই লেফটেন্যান্ট ক্যানডাইডাস ও এক্সপেরিয়াস, এবং সেনেটর মিলিটাম, সকলের অনলস প্রচেষ্টায় ইজিপ্টের এক সাধারণ সৈন্যদলকে অদম্য রোমান লিজিয়নে বদলে ফেলা সম্ভব হয়েছে। আর দেখ, দিকে দিকে এখন তাদের বন্দনা! থেবান লিজিয়ন নয়, এখানে তাদের ফুলমিনান্ত লেজুউইনে, থাণ্ডারিং লিজিয়ন নামে ডাকা হয়। বজ্রের মতো ক্ষিপ্র এবং নির্মম তাদের আঘাত।

ভেষজ মিশ্রিত পানীয়ে তৃষ্ণা মিটিয়ে তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এলেন কমান্ডার মরিস। পইনাইনাস মনস থেকে অনতিদূরে আগুয়ানামে শিবির ফেলা হয়েছে। প্রথমে দীর্ঘ সামুদ্রিক যাত্রা, তারপর শরীর নিংড়ে নেওয়া প্রশিক্ষণ, এবং শেষে লুকিয়ে থাকা বিদ্রোহীদের চোরাগোপ্তা আক্রমণ সামলে তাদের নিশ্চিহ্ন করা। যথেষ্ট পরিশ্রম করেছে ছেলেরা। সামনের অন্তত দুটো সপ্তাহ বিশ্রাম ওদের প্রাপ্য। কমান্ডার মরিস তাই শিবির স্থাপনার জন্য আগুয়ানামকে বেছে নিয়েছেন। একদিকে আল্পসের বিরাট প্রাচীন শরীর, অন্যদিকে চিরযৌবনা রোন। উপত্যকার মাঝে এক গুরুত্বপূর্ণ সামরিক অবস্থান। এখান থেকে উপত্যকা জুড়ে নিয়ন্ত্রণ রাখা অনেক সহজ। একদিন রোমের পরিত্রাতা সিজার অগাসটাস পার্বত্য জনজাতির ওপরে আধিপত্য কায়েম করতে এই উপত্যকা পথ ধরে ঘোড়া ছুটিয়েছিলেন। সেদিনের সেই গ্যালিক যুদ্ধের রক্ত স্যাঁতসেঁতে করে তুলেছিল রোন উপত্যকা। প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পার করে আবার রক্ত চাইছে গল। শিবিরের ইতিউতি ক্লান্ত নজর ঘোরালেন কমান্ডার মরিস। পাশাপাশি পেতে রাখা কাঠের টেবিলে বসে যোদ্ধারা পানাহারে মত্ত। শিবিরের ডান দিকে পাহাড়ের গা ঘেঁষে গোড়াগুলোকে রাখা হয়েছে। নিশ্চিন্তে চোয়ালে যবের দানা ভাঙছে তারা। একদিকে রান্নার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে দেখতে পেলেন মরিস। অল্প সময়ের মধ্যেই ছেলেরা শিবির স্থাপনার কাজ দারুণভাবে শেষ করেছে। তাঁকে দেখতে পেয়ে টেবিল ছেড়ে উঠে এল সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট এক্সপেরিয়াস। কপটিক ভাষায় অভিবাদন জানাল।

‘সুপ্রভাত কমান্ডার মরিস। আমি আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।’

‘সুপ্রভাত। এর মধ্যেই আবার নতুন কোনো নির্দেশ এসেছে নাকি? ছেলেরা সবেমাত্র একটু বিশ্রামের সুযোগ পেয়েছে।’

লেফটেন্যান্ট তার কোমর বন্ধনীতে গুঁজে রাখা নির্দেশপত্র বের করে সামনে বাড়িয়ে ধরল।

‘আপনার অনুমান কখনো ভুল হতে দেখিনি কমান্ডার!’

পার্চমেন্টের মোড়ানো নির্দেশপত্রে ব্রোঞ্জের পাতলা বেষ্টনী। বেষ্টনীর গায়ে লেগে থাকা অক্ষত মোমের প্রলেপ পত্রের কৌমার্য রক্ষার সাক্ষ্য বহন করছে। ধাতু বেষ্টনী থেকে নির্দেশপত্রকে মুক্তি দিলেন কমান্ডার মরিস।

‘কখন এসেছে?’

‘গতকাল রাতে। সোলিটার্ণের গভর্ণর দ্রুত উত্তর প্রত্যাশা করছেন। অশ্বারোহী অপেক্ষা করছে।’

নির্দেশপত্রে চোখ রাখা মাত্র কমান্ডার মরিসের দেহ-মনে সঞ্চিত যাবতীয় ক্লান্তি নিমেষে উধাও হয়ে গেল! হাতের আঙুলগুলো চেপে বসল ভেড়ার চামড়া দিয়ে তৈরি পার্চমেন্ট পত্রে। এক্সপেরিয়াস বুঝতে পারছে কমান্ডারের শরীরী ভাষায় বদল এসেছে। কী এমন নির্দেশ যা পড়ে কমান্ডার মরিসের কালো চামড়ায় ঢাকা পেশী ফুলে উঠেছে? কৌতূহল জাগলেও তৎক্ষনাৎ তা প্রকাশ করতে পারল না লেফটেন্যান্ট। তার আগেই কমান্ডারের কঠিন স্বর শোনা গেল, ‘ভিক্টর, ভাইটালিস, ক্যান্ডিড, সকলকে এখনই খবর পাঠাও। দুপুরের প্রার্থনা শেষে আমার তাঁবুতে জরুরি আলোচনায় বসতে হবে।’

‘নির্দেশপত্র কি কোনো গুরুতর খবর বয়ে এনেছে কমান্ডার?’

চট করে উত্তর দিতে পারলেন না মরিস। গভীর শ্বাসে তাঁর বুক অতিরিক্ত ফুলে উঠল। চিন্তিত এবং বিষন্ন সুরে তিনি যা বললেন, তাতে লেফটেন্যান্ট এক্সপেরিয়াসের কৌতূহলের ছিঁটেফোঁটাও দূর হলো না।

‘সম্রাট আমাদের এক ভীষণ কঠিন পরীক্ষায় ফেলে দিয়েছেন এক্সপেরিয়াস। নির্মম পরীক্ষা। তুমি যাও, দ্রুত সকলকে বলো।’

মাথা নেড়ে দ্রুত পা চালাতে গিয়েও ঘুরে দাঁড়াল এক্সপেরিয়াস।

‘ফেলিক্স এবং রেগুলা শিবিরে নেই। ওরা একটা দল নিয়ে উঁচু পার্বত্য পথে নজরদারি চালাচ্ছে। ওখানেও কি খবর পাঠাব?’

উত্তর দিতে মুহুর্ত সময় নিলেন মরিস।

‘এখনই প্রয়োজন নেই। আমরা যে সিদ্ধান্ত নেব, আশাকরি ফেলিক্স এবং রেগুলা সেই পথেই হাঁটবে।’

দলনেতাকে ঘিরে বসে আছে সকলে। ভিক্টর, অরসাস, লেফটেন্যান্ট ক্যান্ডিড ও এক্সপেরিয়াস এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সেনা কর্মকর্তা। তাঁবুর ভেতরের গনগনে আঁচ সন্ধ্যার শীতলতাকে শিথিল করে তুলেছে। অচল গাছেদের মিছিল, স্বর হারানো পাখিদের দল, বুঝি সমস্ত পার্বত্য উপত্যকার নিথর নিস্তব্ধ আচরণ ইঙ্গিত দিচ্ছে আসন্ন ভয়ংকর দিনের। লিজিয়নের পুরো দলটা আগুয়ানামে নেই। কয়েকটা অংশ টুকরো হয়ে ছড়িয়ে আছে আশেপাশের অঞ্চলে। বিরাট এই গল দেশে বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ সামাল দিচ্ছে দক্ষ হাতে। বাকিরা, যারা এই শিবিরে রয়েছে, জ্বলে ওঠা মশালের আলো তাদের মুখের উদ্বেগ নির্লিপ্তভাবে প্রকাশ করছে। বিষয়টা জেনে গেছে সকলেই। পাহাড়ি বন্য আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়েছে রোম সম্রাট প্রেরিত নির্দেশ। যুদ্ধের আগে দেবতাকে তুষ্ট করা রোমান লিজিয়নের প্রচলিত প্রথা। দেবতা মার্সকে উপঢৌকন দিয়ে জয় সুনিশ্চিত করা রোমান সৈন্যদের দস্তুর। থেবান লিজিয়নকে সেই দস্তুর পালন করার নির্দেশ পাঠিয়েছেন সম্রাট। সোলিটার্ণের গভর্ণরের অধীন রোমান সৈন্যদলের সঙ্গে মিলে দেবতা মার্সের বন্দনা করতে হবে। হাতে গোনা জনা কয়েক নাম বাদ দিলে, থেবান লিজিয়নের প্রায় সকল সদস্য খ্রিষ্ট ধর্মে দীক্ষিত। খ্রিষ্টের অনুসারী হলেও তাদের একাত্ম হতে হবে রোমান দেবতার প্রার্থনায়! না, কমান্ডার মরিস এবং লিজয়নের বাকি সদস্যদের এই বিষয় ভীষণভাবে নাড়িয়ে দিতে পারেনি। অস্বস্তিজনক ঠিকই, তা বলে গভীর সংকটে ফেলে দেওয়ার মতো নয়। বরং সকলকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে নির্দেশপত্রের পরবর্তী অংশ।

গল দেশ জুড়ে বাগৌডে বিদ্রোহীদের দাপাদাপি তটস্থ করে রেখেছে রোমকে। গলদেশীদের এই দল খ্রিষ্টের অনুসারী। তাদের প্রদেশে বিদেশি শাসকের অত্যাচার, শোষনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে খ্রিষ্টান কৃষকশ্রেণী। আর কত দিলে তবে সম্রাট তুষ্ট হবেন? নিজেরা নিরন্ন, নির্বস্ত্র হয়েও সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ানের জঠর জ্বালা নেভাতে পারেনি। আর তাই হাতের কাস্তেকে বদলে নিয়েছে প্রতিরোধের অস্ত্রে। বাগৌডে বিদ্রোহীদের সেই অস্ত্রে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে রোম এবং রোম অধিকৃত আইবেরীয় অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্রিটানিয়া এবং জার্মানিয়া থেকে আদায় করা খাজনা লুঠ হচ্ছে গলের পথে। সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ান বিক্ষিপ্ত অভিযান চালিয়েছেন, তবু কৃষক বিদ্রোহীদের দমাতে পারেননি। বিদ্রোহের কয়েকটা মাথাকে গলের পথে, রাস্তার মোড়ে বর্শার ফলায় টাঙিয়ে রাখা হয়েছিল। সেই দৃশ্য বরং আগুনে ঘি ঢালার কাজ করেছে। তাই আর নয়। অসহ্য, বর্বর গ্যালিকদের এবার নির্মূল করতে হবে। প্রদেশে যেন তাদের চিহ্নমাত্র অবশিষ্ট না থাকে। বৃদ্ধ থেকে শিশু, কাউকে ছাড় দেওয়ার অনুমতি নেই। নারী মানেই তো জরায়ুতে বাঁচিয়ে রাখবে আগামী দিনের বিদ্রোহের রসদ। সুতরাং নিস্তার নেই তাদেরও। প্রতিটি খ্রিস্টান গ্রাম খুঁজে বের করে ভস্মে পরিণত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ান। এবং এই কাজে, রোমান সৈন্যদলের পাশে দাঁড়িয়ে নির্মমতার স্বাক্ষর রাখতে হবে থেবান লিজিয়নকেও।

‘অসম্ভব!’

‘তারা নিষ্পাপ!’

‘এরপর প্রভু জিশুর কাছে কী জবাব দেব আমরা?’

একে একে বলে উঠেছিল ভিক্টর, অরসাস, এক্সপেরিয়াস। বাকি যারা ছিল, নির্দেশপত্র পাঠ শেষ হতে অনুভূতি জানানোর সঠিক ভাষা খুঁজে পায়নি।

সঙ্গীদের নিয়ে নিজের তাঁবু ছেড়ে বেরিয়ে এলেন মরিস। এই অসময়েও তাঁর পরনে যোদ্ধার পোশাক। খাটো বর্শাটা বরাবরের মতো ডান হাতের মুঠোয় ধরা।

‘সম্রাট আমাদের কাছ থেকে দ্রুত উত্তর প্রত্যাশা করছেন। অশ্বারোহী অপেক্ষা করছে। রোমের অনুগত হিসেবে একটা জবাব দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি নিজের সিদ্ধান্ত নিয়েছি ভাইয়েরা। এবার তোমাদের পালা। লিজিয়নের কমান্ডার হিসেবে তোমাদের ওপরে কোনো মতামত চাপিয়ে দিতে চাই না।’

হাতের অস্ত্র তুলে ধরলেন থিবেন লিজিয়নের কমান্ডার। আবেগ মথিত কণ্ঠে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘এই পবিত্র বর্শার কথা তোমরা সকলে জানো। প্রভু জিশুর কৃপায় অজস্র প্রতিকূলতা আমরা পেরিয়ে এসেছি। আমাদের মসিহা ধর্মের জন্য নিজের প্রাণ সঁপে ছিলেন এই অস্ত্রের কাছে। আমিও তাঁর পথে চলতে প্রস্তুত। ভাইয়ের রক্ত ঝরানো মহাপাপ। সম্রাটের তরবারির নিচে নিজের মাথাকে উপহার দেব, তবু এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ভাবনাকে এতটুকু প্রশ্রয় দেব না।’

মশালের আলোয় চকচক করছে অগণিত মুখ। আঠালো আঁধার মেখে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড়ের চূড়া। মরিসের বলা কথাগুলো সূর্যের আলোর মতো সমস্ত সংশয়ের কুয়াশা সরিয়ে দিল। সকলে সমস্বরে চিৎকার করে উঠল, ‘আমরাও এ পাপ নেব না।’

 

 

মৃত্যুর উৎসবে

………………………

‘গোটা একটা ফুটবল মাঠ ঢুকে যাবে!’

সেন্ট-মরিস চার্চ লাইব্রেরি দেখে এমার প্রথমেই মনে হয়েছিল। ডোমের মতো সিলিং অনেকটা উঁচুতে। সেখানে ফ্রেস্কোর কাজ। কোনোটায় ভিড়ের মাঝে জিশুর উজ্জ্বল উপস্থিতি। ধর্মপাঠের আসর। কোনোটা গলগাথায় ক্রুশিফিকেশনের দৃশ্য ধরে রেখেছে। সিলিং থেকে নজর সরানো সহজ নয়। যদি সরে, তবে আগে চোখ পড়বে প্রধান দরজার মুখোমুখি থাকা দেয়ালচিত্রে। মারটাডামের(martyrdom) সাক্ষ্য বহন করছে। বর্মে সজ্জিত এক অস্ত্রধারীর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে রয়েছেন সেন্ট মরিস। উদ্যত গ্ল্যাডিয়াসের মুখেও নির্ভীক, অচঞ্চল অভিব্যক্তি! তাঁর পেছনে দু’জন সহযোদ্ধা। দেয়ালচিত্রের দুপাশে পরপর সাজিয়ে রাখা বুক র‍্যাক। সেগুলো তৈরি করতে কতগুলো চেরি গাছকে জবাই করা হয়েছে তার হিসেব কষা বেশ কঠিন। র‍্যাকগুলো চোখের আন্দাজে বিশ-পঁচিশ ফুট উঁচু। লক্ষাধিক বই থরে থরে সাজানো রয়েছে। মাঝের বিরাট অংশে বসে পড়ার জন্য অনেকগুলো টেবিল। প্রতিটি টেবিলের জন্য আলাদা করে আলোর ব্যবস্থা। তারই একটা দখল করে রয়েছে এমা। গত দুদিন ধরে এটাই এমার ঠিকানা। এই লাইব্রেরি, এবং এই টেবিল। চার্চ গেস্ট হাউসের ঘর কেবল রাতটুকু পার করার জন্য। সকাল হলেই আবার সেই এক চেয়ার। ঠিক পাশেই এলিন। অসহায়ের মতো বসে।

দু দিকে উঁচু করে রাখা বইয়ের পাঁচিল ডিঙিয়ে বোনের মুখ তার নজরে আসছে না। একেবারে একঘেয়ে সময় কাটছে এলিনের তা বলা যাবে না। গতকাল যেমন অনেকটা সময় কাটিয়েছে সেন্ট-মরিস চার্চের কোষাগার দেখে। চমকে যাওয়ার মতো সংগ্রহ। হাজার বছর আগের প্রাচীন ইতিহাস সংরক্ষণের দায়িত্ব সামিরা টিসডেলের সুযোগ্য কাঁধে। দারুণ প্রাণচঞ্চল এবং কর্ম কুশলী মেয়েটা! গত দু’দিনে এলিনের সঙ্গে তার সখ্যতা সামান্য গাঢ় হয়েছে। এই ঐতিহাসিক চার্চ তাকে ঘুরে ঘুরে দেখিয়েছে সামিরা।

‘কী খুঁজছিস? লাইব্রেরির বইয়ে হোলি লেন্সের হদিস থাকলে এতদিনে কেউ না কেউ ঠিক বের করে ফেলত। এখানে বসে না থেকে, বরং চার্চের আনাচেকানাচে তল্লাশি করলে লাভ হতো।’

জ্ঞানের প্রাচীর টপকে এমার প্রত্যুত্তর ভেসে এল, ‘বিরাট এলাকা নিয়ে ছড়িয়ে থাকা চার্চের ঠিক কোথায় জিনিসটা আছে খালি চোখে বোঝা যাবে না ব্রাদার৷ সঠিক জায়গার নির্দেশ বইয়ের পাতাতেই আছে।’

‘কোনো মানে হয়!’

‘নাহ্‌, তোর এখানে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না।’

বলে চেয়ারে হেলান দিয়ে আড়াল থেকে মুখ বের করল এমা। চশমাটা কপালের ওপরে ঠেলে তুলে রহস্যঘন হাসিতে যোগ করল, ‘সুন্দরীর সাহচার্য ত্যাগ করে এখানে প্রাচীন সন্ন্যাসীর মতো বসে আছিস কেন? বরং অ্যাবটের সঙ্গে কথা বলে দেখ, চার্চ ট্রেজারিতে সিকিউরিটির একটা কাজ জোটানো যায় কিনা। ডকের কাজটা যখন গেছেই, তখন অন্য ডাঙায় তরী ভেরানোর এমন সুযোগ ছাড়িস না।’

‘কোনো মানে হয়!’

পুনরাবৃত্তি করল এলিন। তারপর বোনের মস্করা অন্যদিকে ঘুরিয়ে দিতে চাইল। এই কাজটা সে ভালো পারে।

‘রাতের গল্পের শেষটা কী? রোমান সম্রাটের শাস্তির ভয় কমান্ডার মরিস এবং তাঁর সঙ্গীদের টলাতে পারেনি?’

ধীরে ধীরে ঘাড় নাড়ল এমা।

‘ম্যাক্সিমিয়ান শমন পাঠালেন। থেবান লিজিয়ন ভেঙে দেওয়ার হুমকি দিলেন। শুধু তাই নয়, রোমান সৈন্য পাঠিয়ে লিজিয়নের প্রত্যেক অবাধ্য যোদ্ধাকে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়ার কথাও জানালেন।’

‘তা বলে সকলকে একসঙ্গে নয়।’

তৃতীয় কণ্ঠস্বর বলে উঠল। দুই ভাইবোন নজর ঘোরাতে দেখতে পেল সামিরা কখন ঠিক তাদের পেছনে হাজির হয়েছে। স্বর্গের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটা।

‘আপনাকেই দরকার ছিল সামিরা। ভীষণরকম।’

এমার কথায় সামান্য বিস্ময় বোধ করল সেন্ট-মরিস চার্চের কোষাগার রক্ষক।

‘আমাকে!’

‘এই অত্যাচারী ভাইটির হাত থেকে দয়া করে আমাকে উদ্ধার করুন। বসে বসে কেবল মাথা খাচ্ছে।’

বেয়ারাভাবে হেসে উঠল তিনজনে। একটু দূরে চাপ দাড়িয়ালা বয়স্ক একজন মোটাসোটা একটা বইয়ে মুখ গুঁজে ছিলেন, খরখরে দৃষ্টিতে তাদের মেপে নিলেন। চটপট নিজেকে সামলে গলা নামাল সামিরা।

‘আবার কোনো নতুন গল্পে আটকা পড়েছেন বুঝি? থেবান লিজিয়নের শেষ পরিণতি?’

দু হাত মেলে কাঁধ ঝাঁকাল এমা। চোখে কৌতূহল ফুটিয়ে বলল, ‘ব্রাদার, গল্পের শেষটুকু বলার যোগ্য মিস সামিরা ছাড়া কেউ হতেই পারে না। তাই না?’

কথাটা আন্তরিক, নাকি তাকে ফাঁদে ফেলার নতুন পন্থা বুঝতে না পেরে সাবধানী উত্তর দিল এলিন, ‘সেন্ট-মরিস চার্চের একজন গণ্যমান্য প্রতিনিধি হিসেবে ভাবলে, হ্যাঁ সামিরা নিখুঁতভাবে বর্ণনা দিতে পারবেন।’

‘অতএব আমরা উত্তম শ্রোতার মতো আচরণ করব। আপনি শুরু করুন সামিরা।’

পাশের টেবিল থেকে চেয়ারটা টেনে এনে মুখোমুখি নিঃশব্দে স্থাপন করল সামিরা।

‘গল্পের শেষটুকু জানার আগে শুরুর কিছু কথা না বললে বিষয়টা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। ডায়াক্লেশিয়ানিক তাড়নার কথা জানা আছে?’

সামিরার প্রশ্নে হতাশভাবে ঘাড় নাড়ল এলিন। তাকে দেখে মুচকি হেসে ফুট কাটল এমা।

‘এবার ইতিহাসকেও ভালোবাসতে শুরু কর ব্রাদার। এরপর তোর ডাইনে বাঁয়ে শুধুই ইতিহাসের খুঁটি। বাঁধা পড়তে চলেছিস। এ এক মহানিপীড়ন বটে।’

পাছে আবার কেউ বিরক্ত হয়, তাই ইতিহাসের দুই খুঁটি কোনোমতে হাসিকে সংবরণ করল। হতভম্ব এলিনের দিকে তাকিয়ে সামিরা বলতে শুরু করল, ‘হ্যাঁ, মহানিপীড়ন। খ্রিস্টানদের ওপরে রোম কর্তৃক সর্বশেষ এবং সবচেয়ে গুরুতর নিপীড়ন। সম্রাট ডায়াক্লেটিয়ান শুরু করেছিলে। তাঁর পরে ম্যাক্সিমিয়ান, গ্যালারিয়াস এবং কনস্টানটিয়াস বেশ কয়েক দশক ধরে অত্যাচারের সেই ধারা বজায় রাখেন। খ্রিস্টানদের আইনি অধিকার বাতিল করা হয়। তাদের তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী রোমান ধর্মীয় রীতি-নীতি মেনে চলতে বাধ্য করা হয়। এখানেই শেষ নয়। চার্চ ধ্বংস করা, ধর্মগ্রন্থ পুড়িয়ে দেওয়া, বিচারের অধিকার কেড়ে নেওয়া, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, এবং অবশ্যই যাজকদের ধরে ধরে প্রথমে বন্দী ও পরে হত্যা করা। নিপীড়নের কোনো অস্ত্রই প্রয়োগ করতে বাকি রাখেননি তাঁরা। তবে এক্ষেত্রে প্রথম তিনজন যতটা উৎসাহী ছিলেন, সম্রাট কনস্ট্যানটিয়াস সে তুলনায় যথেষ্ট উদাসীন ছিলেন বলা যায়।’

‘উদাসীন নিপীড়ক। ঠিক বলেছেন সামিরা।’

এমা বলল, ‘সে হিসেবে দেখতে গেলে সম্রাট ডায়াক্লেটিয়ান এবং বাকি দু’জনকে উৎসাহী নিপীড়ক বলা যেতে পারে।’

এলিনের ধৈর্যের বাঁধ ভাঙল এবার।

‘উৎসাহী এবং উদাসীন। বোঝা গেছে। এবার গল্পের শেষ অংশ থেকে পর্দা উঠবে কি? সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ান থেবান লিজিয়নের যোদ্ধাদের কোতল করার নির্দেশ পাঠিয়েছিলেন। তারপর কী হলো?’

সামিরার উদ্দেশে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল এলিন।

‘সুচতুর সম্রাট কোনো হঠকারিতা দেখাননি। খাঁটি রোমান সেনার একটা বড়োসড়ো দল সোলিটার্ণের গভর্ণরের জিম্মায় ছিল। সম্রাটের নির্দেশে হত্যাযজ্ঞের প্রারম্ভিক সূচনা করে তারা। ধাপে ধাপে থেবান লিজিয়নের প্রায় ছশো খ্রিস্টান সেনার মাথা আলাদা করে দেওয়া হয়।’

‘অর্থাৎ এই ছশো খ্রিস্টান সেনাকে শাস্তি দিয়ে বাকিদের একটা বার্তা দিতে চেয়েছিলেন সম্রাট ম্যাক্সিমিয়ান?’

এলিনের প্রশ্নের জবাবে মৃদু ঘাড় নাড়ল সামিরা।

‘হ্যাঁ। সম্রাট মার্কাস অরেলিয়াস ম্যাক্সিমিয়ানের সতর্কবার্তার জবাবে সেন্ট মরিস একটা চিঠি লিখেছিলেন। বীরত্ব এবং ভক্তির এক আদর্শ মেলবন্ধন সেই চিঠির ছত্রে ছত্রে খুঁজে পাওয়া যায়। পাঁচের শতকে বিখ্যাত ফ্রেঞ্চ বিশপ লিয়নের ইউকেরিয়াস সেই চিঠির একটা আনুমানিক ধারণা দিয়েছেন। পড়েছেন নিশ্চয়ই? আমাদের চার্চ লাইব্রেরিতেই আছে।’

‘না…’ বলল এমা, ‘আসলে মূল বিষয় নিয়ে এত হাবুডুবু খাচ্ছিলাম যে অন্যদিকে তাকানোর ফুরসত পাইনি।’

‘বেশ।’

বিষন্ন হাসিতে বলল সামিরা। এমার শব্দ প্রয়োগ তার সতর্ক কান এড়ায়নি। ড. মিলার সম্ভবত লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন। সামিরা মনেপ্রাণে চেয়েছিল এই দিনটা যেন কখনো না আসে। মেয়েটা ভালো। আর এলিন? এই ক’দিনের পরিচয়ে সে আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।

‘লাইব্রেরি, বই, এবং পড়া, আমি এসবে একেবারেই থিতু হতে পারি না সামিরা। তবে ইতিহাসে আগের মতো অরুচি আর নেই। ফেলে আসা দিনের গল্প শুনতে এখন দিব্যি লাগে। বিশেষত তা যদি সেন্ট মরিসের মতো কোনো বীরগাথা হয়৷ চিঠিতে এমন কী লেখা ছিল সামিরা?’

এলিনের প্রশ্নে তার দিকে নজর ফেরাল সামিরা। মুখের অভিব্যক্তি অটুট রেখে নিষ্পলকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। ভেতরে তোলপাড় চলছে। বাইরেটা নীরব শ্মশান। অনাত্মীয় এই পৃথিবীতে দুর্বলতার প্রথম অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। অপ্রকাশিত যন্ত্রণার যে অন্যরকম সুখ আছে, এলিনের সঙ্গে দেখা না হলে অজানাই থেকে যেত।

‘মিস সামিরা… চিঠিতে কী লেখা ছিল?’

এমার কণ্ঠস্বর ভাবনার চোরা স্রোত থেকে সামিরাকে টেনে তুলল। গলাকে পেঁচিয়ে ধরেছে নির্বোধ আবেগ। কথা বলতে গিয়ে তার কণ্ঠস্বর ঈষৎ কেঁপে গেল, ‘সেন্ট মরিস দ্বিধাহীনভাবে জানিয়েছিলেন, থেবেন লিজিয়ন সম্রাটের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে কিংবা তাঁর সামরিক আদেশ পালনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। তবে তারও আগে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ সৃষ্টিকর্তার প্রতি, তাদের একমাত্র প্রভুর প্রতি। সম্রাটের প্রতিটি আদেশ, যদি তা সৃষ্টিকর্তার দেওয়া নির্দেশকে আঘাত না করে, বিনা প্রশ্নে তারা পালন করতে প্রস্তুত। সেন্ট মরিস চিঠিতে লিখেছিলেন, সম্রাটের কাছে শপথ নেওয়ার বহু আগে তারা প্রভু জিশুর কাছে মানবতার শপথ নিয়েছেন। সুতরাং দ্বিতীয় অঙ্গিকার পালন করতে গিয়ে প্রথম প্রতিশ্রুতিকে তারা ভঙ্গ করতে পারে না।’

‘নিজের অতোজন সহযোদ্ধার মর্মান্তিক পরিণতি দেখার পরেও! সেন্ট মরিস না হয় কঠিন স্নায়ুর মানুষ ছিলেন, কিন্তু বেঁচে থাকা বাকিরা? তারাও কী…’

‘সকলে এলিন। থেবান লিজিয়নের প্রতিটি খ্রিস্টানুরাগী যোদ্ধা যারা ২৮৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর আগুয়ানামে উপস্থিত ছিল, প্রত্যেকে বিনা প্রতিরোধে নিজের গলা উপহার দিয়েছিল সম্রাট মার্কাস অরিলিয়াস ম্যাক্সিমিয়ানকে। প্রভু জিশুর প্রতি তাদের এমন পবিত্র সমর্পণ স্বয়ং রোমান সম্রাটও আশা করেননি। তিনি ভেবেছিলেন প্রতিরোধ হবে। অথচ তাঁর পাঠানো বিরাট সৈন্য দলের প্রকৃতপক্ষে কোনো কাজই ছিল না। হ্যাঁ বেশ কয়েকজনকে অবশ্য ছিন্ন হওয়া মাথা এবং দেহগুলোকে রোন নদী পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেতে হয়েছিল।’

‘উফফ!’

অস্ফুটে বলে উঠল এলিন। চোখের পাতা বন্ধ করে ভেসে ওঠা রক্তাক্ত দৃশ্যকে অন্ধকার দিয়ে ঢাকতে চাইল।

‘তারা কিন্তু মারা যাননি এলিন। থেবান লিজিয়নের প্রত্যেক সন্ন্যাসী যোদ্ধা মরেও বেঁচে উঠেছিলেন। এখানকার অনেকে বলে, এই উপত্যকায় দীর্ঘ বছর ধরে ছিন্ন মস্তকের সন্ন্যাসী যোদ্ধাদের দেখা যেত। হাত জোড় করে প্রার্থনারত।’

‘বেঁচে উঠেছিলেন! জিশুর মতো?’

এলিনের বিস্ময়ভাবকে আড়াল করল এমার গম্ভীর স্বর।

‘গল্পের পর এবার কাজের কথায় আসা যাক। সেন্ট থিওডর ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে আগুয়ানাম আবিষ্কার করেন। তিনি এখানে একটি ব্যাসিলিকাও নির্মাণ করেন। তাই তো?’

‘হ্যাঁ। সেই প্রাচীন স্থাপত্যের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। পবিত্র যোদ্ধাদের কিছু সমাধিও আছে। আপনার কী ধারণা ড. মিলার, দ্য হোলি লেন্স সেখানেই রাখা আছে?’

সামিরার কৌতূহলকে চাপা দিয়ে এমা বলল, ‘জায়গাটা দেখার আগ্রহ হচ্ছে সামিরা। জিনিসটা ওখানে আছে কি নেই, সেটা পরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। অবশ্য যদি চার্চ কর্তৃপক্ষ কোনো আপত্তি না করেন তবেই সেটা সম্ভব। সেক্ষেত্রে পরিকল্পনার একজন অংশীদার হিসেবে আপনার সাহায্য আশা করতে পারি নিশ্চয়ই?’

সামিরা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। হেঁটে দেয়ালচিত্রের কাছে পৌঁছাতে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশিই সময় নিল সে। মৃত্যু আলিঙ্গনরত সন্ন্যাসী যোদ্ধার দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইল। অজস্র সম্ভাবনা তার মস্তিষ্কে উঁকি দিচ্ছে। ড. মিলারকে আপাতত থামিয়ে দেওয়া অত্যন্ত সহজ কাজ। সেন্ট-মরিস ডি’আগাউনে অ্যাবের ইন্টেরিম হেড হওয়ার্ড লেভি একাই ড. মিলারের পরিকল্পনায় জল ঢালতে পারেন। চার্চ অ্যাবটকে বোঝানোর জন্য পাদরি নিকোলাস আছেন। সুতরাং এমা মিলার এই মুহুর্তে সেন্ট মরিসের পবিত্র সমাধি স্পর্শ করতে পারবেন না। যদিও সৌভাগ্য শলাকা সেখানে নেই, তবে কোথায় আছে তার সূত্র মৃত্যুর পরে এক পবিত্র যোদ্ধা আজও তাঁর বুকে ধরে রেখেছেন। মেয়েটার চোখ শ্যেনপাখির মতো। নিশ্চিতভাবে সেই সূত্র ধরে অ্যাবের গোপন চেম্বার পর্যন্ত পৌঁছে যাবেন। সুতরাং ড. মিলারের প্রাচীন ব্যাসিলিকা দেখার অজুহাত ঠেকানো দরকার।

দেয়ালচিত্র থেকে সিলিংয়ে খ্রিষ্টের ক্রুশবিদ্ধকরণের দৃশ্যতে নজর ঘোরাতেই অন্য এক সম্ভাবনার কথা সামিরার মাথায় উঁকি দিল। ড. মিলারকে এখন আটকে দিলেও বিপদ থেকেই যাচ্ছে। বিষয়টা জানাজানি হবে। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে অনুমতি আদায় করা কঠিন নয়। ঐতিহাসিক অনুসন্ধানে আপত্তি জানানোর সুযোগ তখন আর চার্চের হাতে থাকবে না। ফলাফল একই। সামিরা যে রাস্তা নিতে চায়নি, সেই পথেই তাকে হেঁটে যেতে হবে। তবে শেষ সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে সে আরও একবার চেষ্টা করে দেখবে। কোনোভাবে মেয়েটার দৃষ্টি যদি ঘোরাতে পারে, চেষ্টা করে দেখবে সামিরা।

‘মিস সামিরা…’

অধৈর্য্য সুরে ডেকে উঠল এমা। দূরত্বের কারণে কিঞ্চিৎ জোর দিতে হলো গলায়। তার কণ্ঠস্বরে মুহুর্তের জন্য বিরাট লাইব্রেরিতে জমে থাকা নৈঃশব্দ্য দুলে উঠল। চকিতে পেছনে ঘুরল সামিরা৷ ধোঁয়াশায় বিব্রত পথিকের মতো প্রায় ছুটে এসে দাঁড়াল এমার সামনে। চোখের জিজ্ঞাসা মুখে ফুটিয়ে তুলল সে।

‘ড. মিলার, সেন্ট মরিসের ব্যবহার্য সবকিছু থিওডর এখানকার ব্যাসিলিকায় পবিত্র স্মৃতি হিসেবে রেখেছিলেন বটে, কিন্তু পরে তো সেসব অস্ট্রিয়ান এবং হাঙ্গেরিয়ান সম্রাটরা নিজের হেফাজতে নিয়ে নেন। সুতরাং সেন্ট মরিসের পবিত্র সমাধি খোঁড়াখুঁড়ি করে আদৌ কি কোনো লাভ হবে? আমার তো তা মনে হয় না।’

এমার ঠোঁটে প্রত্যয়ের পরিচিত হাসি পিছলে গেল।

‘জানি। এই দুটো দিনে নতুন অনেক কিছু জানতে পেরেছি। আপনাদের চার্চ লাইব্রেরির সংগ্রহে এই দুষ্প্রাপ্য বইগুলো আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছে।’ টেবিলে রাখা বইয়ের স্তম্ভকে দেখিয়ে এমা বলল।

‘কিন্তু একটা প্রশ্নের উত্তর এই বইগুলোতে পাওয়া যায়নি মিস সামিরা। হ্যোয়ার ইজ দ্য হোলি লেন্স?’

‘মানে!’

‘মানে যদি বাকি কথাগুলো সত্যি বলে ধরে নিতে হয়, যদি মেনে নিই পবিত্র বর্শা সেন্ট মরিসের সঙ্গী ছিল, তিনি জানতেন হাতে ধরা সেই খাটো বর্শার গুরুত্ব, এবং সেন্ট থিওডর আগুয়ানামের এই স্থানে সেন্ট মরিসের মৃতদেহ সহ সেই বর্শাটিও উদ্ধার করেন, তবে সেটা গেল কোথায়? না মিস সামিরা। অস্ট্রিয়ান হাঙ্গেরিয়ান সম্রাটদের কাছে সেন্ট মরিসের ব্যবহৃত সোর্ড এবং শিল্ড ছিল। এখনো মিউজিয়ামে রাখা আছে। তাহলে বর্শাটা?”

এমার টানা বলে যাওয়া কথাগুলো নীরবে শুনে যাচ্ছিল সামিরা। এবার দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল সে। মেয়েটা তার সামনে অন্য কোনো পথ আর খোলা রাখল না।

‘হয়তো আপনিই ঠিক ড. মিলার। এবার আপনাকে একটা গোপন তথ্য দেওয়া দরকার। প্রফেসর বরিস বেঁচে থাকলে উনি নিশ্চয়ই বিষয়টা অগ্রাহ্য করতেন না।’

এমা কান খাড়া করল। পাশে বসে এলিনও।

‘এখানে, এই অ্যাবের ভূ-গর্ভস্থ ক্রিপ্টে প্রফেসরের নির্দেশ মতো আমি অনেকদিন ধরে খোঁজাখুঁজি করছিলাম। অবশ্য তখনো জানা ছিল না আদতে কী খুঁজছি। কিছুদিন আগে ক্রিপ্টের দেয়ালে একটা বিশেষ সাংকেতিক লেখা আমার চোখে পড়ে। খানিকটা প্রাচীন গ্রিক ভাষার মতো, তবে পুরোপুরি নয়।’

‘ফ্রিজিয়ান ল্যাঙ্গুয়েজ!’

এমা চেয়ার ছেড়ে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল। উত্তেজনা তার গলার স্বরও বুঝি শুষে নিয়েছে। হিসহিসে শোনাল তার কথা।

‘হতে পারে।’ সামিরা বলল, ‘মনে হয় সেন্ট মরিসের পবিত্র সমাধির আগে আপনার একবার ভূ-গর্ভস্থ ক্রিপ্টে যাওয়া দরকার। তাছাড়া ব্যাসিলিকায় তল্লাশি করার জন্য চার্চের অনুমতি পেতে কিছুটা সময়ও লাগবে। ততক্ষণ না হয়…’

‘আমরা কি এখনই যেতে পারি সামিরা?’

এমাও ধীরে ধীরে মেয়েটাকে পছন্দ করতে শুরু করেছে। পরিস্কার মাথা, ভণিতাহীন, এবং আকর্ষণীয়। এলিনের পাশে দিব্যি মানাবে।

(ক্রমশ)

 

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *