অকূলের কাল। পর্ব ৭। লিখছেন অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী

ধোঁয়াশায় অনুপম
বোমা ফাটার বিকট আওয়াজ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাকিয়ে আকাশে উঠে যাওয়া, কিছুক্ষণের মধ্যে পুলিশ ভ্যানের আগমন, বন্দুক বাগিয়ে রাস্তায় নেমে পুলিশের বিভিন্ন পজিশনে দাঁড়িয়ে পড়া আর রাস্তার লোকজনের দুহাত আকাশের দিকে বাড়িয়ে এগিয়ে চলা – রাস্তায় এমন দৃশ্য অতি সাধারণ হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন। প্রথম প্রথম যেমন এইসব ঘটনায় লোকে ভয় পেয়ে যেন প্রাণরক্ষার তাগিদেই, এলোমেলো ছোটাছুটি শুরু করে দিত – তেমনটি আর হয় না। ভয়ের বদলে এখন লোকে হাসতে হাসতে ‘লহ গোবিন্দের নাম হে’ আওড়াতে আওড়াতে চৈতন্যদেব হয়ে অকুস্থল পেরিয়ে চলে যায় নিজের নিজের গন্তব্যের দিকে। কাকুদের দৃষ্টির বাইরে যে কিছু ভয়ংকর ঘটনা ঘটছে না, তেমন নয়। কিছু তো খবরের কাগজেও বেরোয়। আর যেগুলো বেরোয় না, সেগুলো আরও ভয়ংকর – লোকের মুখে মুখে ফিসফিসিয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
সেদিন সন্ধের মুখে উনিশ নম্বরে কেবল দিনু আর কাকু। প্রদীপ একটা ক্লাবে ক্রিকেট খেলতে যায়, এখনও ফেরেনি। অভীক ইদানীং খুব খুশমেজাজে আছে। অমলের আঁকা বোটানির ছবি খুব কাজ করেছে। সুবু গলে জল। তাকে নিয়ে সে এদিক ওদিক সাঁতার কেটে বেড়াচ্ছে। আটটার আগে হস্টেলে ফিরছেই না। অনুপমও রোজ বিকেলের টিফিন খেয়েই বেরিয়ে যাচ্ছে। ফিরছে বেশ দেরি করে। কাজেই তাসের আসর প্রায় বন্ধ। রবিবার আর ছুটির দিনের অপেক্ষায় বিশ্রামে থাকে তাস। এই হস্টেলটায় খেলাধুলার জন্য কোনো কমন রুম নেই, স্কটিশের অন্য হস্টেলগুলোয় যেমন আছে টেবিল টেনিস বা ক্যারম খেলার জন্য। তাদের খেলা বলতে ফুটবল, কেবল ছুটির দিনগুলোয় ভোরবেলা থেকে সকাল নটা পর্যন্ত মানিকতলার খালপাড়ের বারোমাস কালো কাদায় থিকথিক করা স্কটিশের মাঠে। মাঠ থেকে যখন সবাই আপাদমস্তক কাদা মেখে কাফ্রি হয়ে ফেরে তখন আলাদা করে কাউকে চেনা যায় না।
দিনু আর কাকু দুজনেরই ক্লাসের নোটস নিয়ে পড়তে বসায় বেজায় আলস্য। অন্য কিছু করার না থাকলে তখন বাধ্য হয়েই বসতে হয়। এই সন্ধেটা সেরকম হয়েও তারা পড়তে বসার হাত থেকে রেহাই পেয়ে গেছে। কারণ গতকালই কাকু অমরশঙ্করের কোয়ার্টারে ‘দেশ’ পড়তে গিয়ে দেখেছে তাতে ছাপা হয়েছে মনোজিৎ দাশের কবিতা। সামান্য সন্দেহ হচ্ছিল সেই কবি তাদেরই মনোজিৎদা কি-না। হস্টেলে ফিরেই কাকু তড়িঘড়ি করে মনোজিৎদার রুমে গিয়ে দেখে ঘর তালাবন্ধ। কোথাও বেরিয়েছে। সন্ধে গড়িয়ে ফিরছে যখন, সিঁড়ির প্রান্তে কাকুর সঙ্গে দেখা। মনোজিৎদার হাতে ‘দেশ’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। নিমেষেই সামান্য সংশয়টুকু উধাও। কাকু তার হাতের দিকে ইঙ্গিত করে বলল, – দাদা, আমি কিন্তু আগেই দেখে ফেলেছি। মনোজিৎদা শুধু মুচকি হাসল, কাকুর গলায় যে-উচ্ছ্বাস, তার ছিটেফোঁটাও নেই তার হাসিতে। তা না থাক, কাকু বা দিনুর উত্তেজনায় একটুও ঘাটতি দেখা গেল না পরের দিনও। মনোজিৎদার গৌরবের আলো মাখার জন্য সন্ধেটা অনায়াসেই নোটস নিয়ে পড়তে বসা থেকে অব্যাহতি নেওয়া যায়। সেটাই করছিল তারা। কাকু সেই কবিতার কয়েকটা লাইন কয়েকবার পড়েই মুখস্থ করে নিয়েছিল। উত্তরের বারান্দার রেলিঙ-এ ভর দিয়ে গলা-ভর্তি আবেগ নিয়ে লাইন ক’টা দিনুকে শোনাচ্ছিল।
এই সময়েই সিঁড়ি দিয়ে উঠে টুক টুক করে এগিয়ে এসে তাদের সামনে দাঁড়াল অনাথদা। অনাথবন্ধু মাইতি। বেঁটে, ছোটোখাটো চেহারা, গায়ের রঙ কালোর দিকে, মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে কপালটা বড়ো হয়ে গেছে। বেশ মিহি সুরে কথা বলে। কথায় বাঁধুনি আছে খুব। দরকার হলে সেই মিহি গলা শানিত করে তুলতে পারে। কেবল বাংলা নয়, ইংরাজি বলাতেও তুখোড়। একতলায় থাকে অনাথদা। কাকুদের থেকে অন্তত পাঁচ-সাত বছরের বড়ো হবে। ঠিক কী পড়ে অনাথদা, কাকুরা কেউ জানে না। অনাথদা নিজেও কোনোদিন কিছু বলেনি এই নিয়ে।
–তোমরা দুজন মাত্র কেন? আর সব ফেরেনি – প্রদীপ, শচি, অভীক?
কাকু বলল, –শচি তো ছিল – এর মধ্যে কোন দিকে পালাল!
অনাথদা বলল, –ঠিক আছে, ঘরে চল। তোমাদের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা আছে।
ঘরে ঢুকে বিছানায় বসল দিনু আর কাকু। অনাথদা একটা চেয়ার টেনে বিছানার কাছে এনে তার উপরে বসে বলল, –এই যে তোমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে বেশ হইচই করে আনন্দে থাক একসঙ্গে, খুব ভালো লাগে আমার। যেন হরিহর আত্মা। অথচ, একতলা দোতলায় যারা আছে, সবাই কেমন ছাড়া ছাড়া থাকে। তারই মধ্যে কোনো দুজন হয়তো বেশি ঘনিষ্ঠ – যেমন ধর আগুয়ান আর সোমেশ্বর – কিন্তু সাত আটজনের – টিম যাকে বলে, সেটা কিন্তু এই তোমরাই আছো। আর তোমাদের প্রত্যেকেই খুব ভালো ছেলে। মেধাবী। কলকাতায় বেশিদিন তো আসোনি। একটু সাবধানে থাকাই ভালো।
কাকু বুঝতে পারছে, দিনু ভেতরে ভেতরে গরম হচ্ছে। ভাবটা এই – বুড়ো ভামটা এতো জ্ঞান দেয় কেন! অভীক ভাগ্যিস নেই। সে থাকলে অনাথদাকে এত কথা বলতেই দিত না, আগেই খিস্তি দিয়ে থামিয়ে দিত। কাকু বলল, – কিছু কী হয়েছে অনাথদা, একথা বলছেন যে!
অনাথদা বলল, –হয়েছে বলেই না – নিজের বন্ধুদের খবর কতটা রাখ তোমরা জানি না। আমি কিন্তু রাখি। অনুপম যে কিছুদিন ধরে সারা সন্ধে হস্টেলে থাকছে না, কলেজ থেকে ফিরেই বেরিয়ে যাচ্ছে, ফিরছে প্রায় দশটা বাজিয়ে – সেটা কি কেউ খেয়াল করেছ? জিজ্ঞেস করেছ কোথায় যায়, কী করতে যায়?
কাকু ভেবে দেখল, সত্যিই তো অনুপম গত বেশ কিছুদিন ধরে সন্ধেবেলায় হস্টেলে থাকছে না। ফলে প্রায়ই তাদের তাসের আসরে ব্রিজ খেলা হচ্ছে না। শচি তো তাসই খেলে না, অভীক দেরি করে ফিরলে দুলালকে টেনে এনে কল ব্রে খেলতে হয়। ওকে ব্রিজ খেলা শেখানো যায়নি। একদিন তো জিজ্ঞেসও করেছিল কাকু অনুপমকে, – রোজ রোজ কোথায় গিয়ে বসে থাকিস?
অনুপম বলেছিল সে নাকি কোন এক ছেলের কাছে মাউথ অর্গান শিখতে যায়। সেটাই বলল কাকু অনাথদাকে। অনাথদা বলল, – কী-জানি। আমার যথেষ্ট সন্দেহ হচ্ছে ঠিক বলেছে কি-না। আমি নীচে থাকি তো। মাঝে মাঝেই এমন কিছু ছেলে অনুপমের খোঁজ করতে আসে, তাদের দেখলেই ভয় করে। মার্কামারা অ্যান্টিসোশ্যাল। তোমরা সব ভালো ছেলে। বন্ধু যাতে কোনো বিপদে না পড়ে যায় সেজন্যেই তোমাদের জানিয়ে গেলাম। একটু খেয়াল রেখো।
নেমে গেল অনাথদা। কী ইঙ্গিত করে গেল? কাদের সঙ্গে মিশছে অনুপম?
(ক্রমশ)