অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৬। অনন্ত জানা

1

(গত পর্বের পর)

এখন প্রায় পেশাদারি লিখনচর্চার প্রয়োজনের সময় তাঁর সেইসব আঁকিবুকি-কাটা কাগজগুলোর কথা মনে পড়ল। সেখানে অনেক অভিনব অক্ষরলিপির মক়়শো-করার নিদর্শন ছিল!

গোপাল বাড়ুজ্যের দোকানে বসে, রাতে ঘরে বসে সুমন আবার কাগজ নিয়ে ইচ্ছামতো অক্ষর ডিজাইন করতে শুরু করলেন। এমন-কী সাম্প্রতিককালে ছাপা পুরোনো মাপের বর্ণপরিচয় কিনে টাইপের ধাঁচ বোঝার চেষ্টা করলেন। বিভিন্ন খবরের কাগজের, পত্র-পত্রিকায় ব্যবহৃত হরফের চেহারা লক্ষ্য করলেন। তাঁর করা ডিজাইনে কলকাতার সাইনবোর্ডে দেখা বিচিত্র হরফরাজির প্রভাব অনুভব করে সুমন নিজের প্রতিই বিরক্তি বোধ করলেন।

ভিন্নতর শিল্প অক্ষর ব্যবহারে বৈচিত্র্যের জোয়ার দেখা গেল ক্রমবর্ধমান কাজের চাপ সামলানোর জন্য সুমনের দুটি সহকারী জুটে যাবার পর।

শিবেন আর যতীশ।

এরা ভালো অক্ষরশিল্পী, ভোটের সময় বা জনগণকে সভা-সমাবেশ, আন্দোলনের খবর দিতে মাটির হাঁড়িতে গুঁড়ো শিরীষের আঠা দিয়ে ব্লু, এলা মাটি, কিংবা ইদানিংকালে ফ্লুরোসেন্ট রঙ গুলে দেওয়াল লিখে এসেছে। ভোটের সময় দেওয়াল লেখায় এই দু-জনকে সদর কিংবা বড়ো বা মেজো মহকুমায় পর্যন্ত হায়ার করে নিয়ে যায়।

সুমন একদা আর্ট কলেজে পড়াকালীন কলেজ ইউনিয়নের যাবতীয় প্রচারকাজ করেছেন, দেওয়াল লেখাও। সে-সময় সাদা ডিমাই বা ক্রাউন কাগজে বিচিত্র পোস্টার লেখা হতো। আর্ট কলেজের ছাত্র বলে সেই পোস্টারে হরফ-বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গে বিবিধ স্কেচ ও ছবি থাকাটাও ছিল অবশ্যম্ভাবী। সেখানে রঙের কম্বিনেশন ও পোস্টারের ভাষাও ছিল বিচিত্র।

ভোটের সময় তাঁরও দেওয়াল লেখার ডাক আসতো। দিন-কয় ভীষণ উত্তেজনার মধ্যে কাটত। তখন দক্ষিণপন্থী দলগুলির হয়ে ওয়ালিং করতেন পেশাদার লিখিয়েরা, আর বামপন্থী দলগুলির হয়ে সুমনের মতো মতাদর্শগতভাবে ঘনিষ্ঠ শিল্পী ও তাঁদের সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত করবার জন্য দেওয়াল-লিখিয়ে কর্মীদল। দক্ষিণপন্থী দলগুলির দেওয়াল লিখিয়ে পেশাদারেরা দামি রঙ পেতেন, চাহিদামাফিক হরেকরকমের তুলি, সঙ্গে দৈনিক মজুরি।

কিন্তু সুমনের মতো ওয়ালিংওয়ালাদের পরিচয় ছিল বামদলের কর্মী হিসেবে! সুতরাং সাধারণ রঙ, শিরীষের আঠা, ক্ষয়ে-যাওয়া ভোঁতা তুলি, বার বার ডগা-ছাঁটা ব্রাশ দিয়েই তাঁর কাজ চালাতে হতো। কালো ভুষো, সস্তার ব্লু, এলা মাটির হলুদ, আর ঈষৎ দামি ফ্লুরোসেন্ট লাল ও কাঁচা হলুদ ভিন্ন আর রঙের ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না। পুরোপুরি ও নিয়মিত সক্রিয় রাজনৈতিক কর্মী না-হলেও তাঁর বামপন্থায় মতাদর্শগত সমর্থন ও হরফশিল্পের প্রতি স্বাভাবিক আগ্রহের সূত্রে দেওয়াল লেখার কাজে তাঁর উৎসাহ ও আনন্দ ছিল যথেষ্ট। প্রায়শই রাত্রি জেগে দেওয়াল লেখার কাজ চলত। কেননা দিনের বেলাটায় সকলেরই নিজের নিজের পেশাগত কাজ বা স্কুল-কলেজ-অফিস ছিল। সেসব সেরে, বাড়ি ও পরিবারের সব দাবি মিটিয়ে তবে দেওয়াল লেখা!

তবু এই কাজে সুমনের উৎসাহ ছিল। কয়েকদিনের জন্য অচেনা বা স্বল্পচেনা ‘ঘরের খেয়ে বনের মোষ-তাড়ানো’ কিছু মানুষ ও ছেলের সঙ্গে সময়-কাটানো, সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থে কাজ করা, আগে থেকে চুনকাম করে রাখা দেওয়ালে রঙ-ধরানো, অক্ষরে অক্ষরে দেওয়াল সাজিয়ে তোলা, সারা রাত ধরে আশপাশের কোনো-না-কোনো বাড়ি থেকে কেটলি ভরে চা আসা, পাড়ার কোনো দাদার পয়সায় পাড়ার কোনো মিষ্টির দোকান থেকে আনা গরম কিং-সাইজের রসগোল্লার উপহার, চারপাশে দেওয়াল লেখার যোগানদার ছেলেদের ত্রস্ত ব্যস্ততা, বড়ো বড়ো অক্ষরে রঙ ভরাট করার সতর্ক-প্রয়াস, নানা-ধরনের মন্তব্য―এসবের মধ্যে আলাদা উৎসাহময় উত্তেজনা ছিল। ছিল ভালো-লাগার কবোষ্ণ-অনুভব।

কিন্তু সবটাই ছিল একেবারেই অ্যামেচার।

আজ একথা ভাবলে সুমন আশ্চর্য হয়ে যান যে, যে মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠার জন্য কর্মীদের পেশাদার বিপ্লবী হওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা বলা হয়ে এসেছে, সেখানে কেন প্রচার আন্দোলনের সক্রিয় ও দক্ষ-কর্মীদের দিনের-পর-দিন বেগার-খাটা মজুর হিসেবে দেখা হবে! দলের বিশেষ কেউ না হলেও সেদিনও এতটা পয়সার অভাব ছিল বলে কখনও মনে হয়নি সুমনের। আসলে নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের দলের ফিক্স ডিপোজিট বা স্থায়ী আমানত হিসেবে দেখার প্রবণতা ছিল। যে-সব কর্মী নিয়মিত কাজেকর্মে অংশ নিতেন তাঁদের প্রতি, ব্যক্তি-মানুষের প্রতি যত্ন ছিল কম। অযত্ন ও অমূলক ভয়, ব্যক্তিতান্ত্রিকতার বিপদ সম্পর্কে অর্থহীন মন্ত্রের মতো পৌনপুনিক, ক্লিশে অভ্যন্তর প্রচার খুব গেরেম্ভারি চালে যত্রতত্র, অজায়গায়-কুজায়গায় উচ্চারিত হতো।

কাজে-কর্মে অপেশাদারিত্ব সুমনকে পীড়া দিত। যাঁরা শুধু দেওয়াল লিখে বা প্রচার আন্দোলনের লিখনের দিকটিতেই দক্ষ তাঁরা খাবেন কী, কিংবা যাঁরা শুধু লেখক হিসেবে জীবিকা পালন করতে চান তাঁরাই বা কী খাবেন, একচেটিয়া পুঁজি-নিয়ন্ত্রিত পত্র-পত্রিকা, বৃহৎ লগ্নিকারী প্রকাশনা সংস্থা বা অমিত ক্ষমতাধর প্রকাশ ও প্রচারমাধ্যমের আগ্রাসনের হাত থেকে মতাদর্শলালিত লেখকেরা কীভাবে আত্মরক্ষা করবেন, কীভাবে বিকশিত হবেন, কীভাবে পাঠক-শ্রোতা বা উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছাবেন সে-সম্পর্কে কারও স্বতন্ত্র কোনো ভাবনা বা মানুষগুলির প্রতি কোনোরকম যত্ন ছিল বলে মনে হয়নি সুমনের। দলীয় মুখপত্রগুলিতে স্থান পাওয়ার জন্য যোগ্যতা-দক্ষতা ও আনুগত্যের কোনো মাপকাঠি বা প্যারামিটার ছিল বলেও টের পাননি সুমন। তিনি লক্ষ্য করেছিলেন―প্রায়শই দক্ষতার ধারণাকে অতিক্রম করে যেতো আনুগত্যের প্রাবল্য। সেই আনুগত্য মতাদর্শের প্রতি নাকি পদাধিকারী নেতৃত্বের প্রতি―সেই ধন্ধও সহজে কাটতে চাইতো না!

দলের ঘনিষ্ঠ পত্র-পত্রিকায় গল্পের ইলাস্ট্রেশন ও পৃষ্ঠার অলংকরণ করতে গিয়ে তিনি তাজ্জব হয়ে দেখেছেন যে, তাঁর ছবি আঁকার সরঞ্জাম, দামি চাইনিজ কালি, দামি দামি জ়েলপেন কেনার পয়সা কোথা থেকে আসবে সেকথাও কেউ কখনও ভাবেননি।

সব দেখে অনিন্দিতার মুখে বিদ্রূপের বঙ্কিমরেখা দেখা দিয়েছিল।

নিজের ভালোবাসা সম্পর্কে যত সংশয় ছিল অনিন্দিতার তার চেয়ে বেশি আস্থা ছিল সুমনের অপদার্থতায়। যেমন সুমনের ভুতুড়ে চিত্ররচনার বিষয়, তেমন অদ্ভুতুড়ে জীবনযাপনের তরিকা!

কথাগুলো আজ মনে হলো যতীশ আর শিবেনকে সাইনবোর্ড নির্মাণের সহযোগী হিসেবে পেয়ে।

সুমন দেখলেন―লিখনের স্থান নির্বাচনে এবং অক্ষরবৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে শিবেন আর যতীশের দক্ষতা প্রশ্নাতীত। অক্ষরের ছাঁদের বৈচিত্র্য-সম্পর্কে এই জুটির ফলিত জ্ঞানের বিস্তৃতিও বহুদূর।

দেওয়াল লিখনের প্রথম ধাপ দেওয়াল নির্বাচন এবং তাতে অধিকার কায়েম করা। প্রথম অংশে প্রয়োজন রুচি, লিখন-জ্ঞান, পছন্দের বিশিষ্টতা, এলাকার চরিত্র বিচারের ক্ষমতা এবং দ্বিতীয় অংশে প্রয়োজন সাহস, আর ডাকাবুকো থাকার ক্ষমতা। যে-সব কর্মী ‘দেওয়াল দখল’-এর দায়িত্ব পালন করতেন তাদের প্রায়শই প্রথমাংশের গুণাবলী থাকে না। ভোট এগিয়ে এলে তাদের শুধু ব্লু গুলে একটা যেমন-তেমন তুলি দিয়ে দেওয়ালের এক কোণায় নিজের দলের নাম, দখলিস্বত্বের সাল-তারিখ লিখে দিতে হয়।

এইসব দখলি দেওয়ালের সর্বত্র যে লেখা হবে বা লেখা যাবে তা নয়―প্রথমত সব দেওয়াল অবস্থার কারণে লেখার উপযুক্ত নয়, দ্বিতীয়ত সব দেওয়ালের অবস্থান লেখার মতো নয়, তৃতীয়ত সব দেওয়াল লেখার প্রয়োজন নেই, এগুলিতে অন্য দল যাতে লিখতে না-পারে সে-জন্য দখল করে রাখা হয়! সবকিছু দখল করে রাখা, একবগ্গা মনোভাবের দ্বারা ধর্ম-অর্থ-কাম-ক্ষমতা-আত্মপ্রসাদজনিত মোক্ষলাভের আগ্রাসী মনোভাব তথাকথিত বহুদলীয় ভারতীয় গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য।

দখল-করা দেওয়ালের মধ্যে সেইগুলোই সেরা, যেগুলো আয়তকার, প্লাস্টার-করা, উপরিভাগ মসৃণ। যেসব দেওয়াল রাস্তার সঙ্গে সমান্তরাল নয়, পাঁচিল বা বাড়ির দেওয়াল রাস্তার সঙ্গে কৌণিকভাবে মুখোমুখি―যাকে বলা যায়  ফ্রন্ট-ওয়াল সেই দেওয়ালই উপযোগিতার দিক থেকে সর্বশ্রেষ্ঠ। যেসব দেওয়ালে সিমেন্ট-বালির প্লাস্টার দেওয়া হয়নি, ইটগুলো জয়েন্টে জয়েন্টে পয়েন্টিং করা আছে, গাঁথনি সোজা ও ইটের দাগ মিলিয়ে করা সেসব দেওয়ালও লেখার ক্ষেত্রে খুবই সুবিধাজনক ও উপযোগী।

ড্যাম্প-লাগা, সোঁতা বা স্যাঁতস্যাঁতে, নোনা-লাগা দেওয়াল সব লিপিকারেরই অপছন্দের।

রাস্তার সঙ্গে সমান্তরাল কিংবা পথচলতি মানুষের দৃষ্টিসীমার উর্ধ্বের দেওয়ালে লেখা কষ্টকর এবং উপযোগিতার দিক থেকে অকার্যকারী।

দেওয়াল লেখার কার্যক্রমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পর্ব দেওয়ালে সাদা রং করে লিখনের জমি প্রস্তুত করা। সাধারণভাবে এই কাজে চুন ব্যবহার করা হয়। একবেলা চুন ভিজিয়ে রেখে তাতে জল আর আঠা দিয়ে, উজ্জ্বল সাদা দেখাবার জন্য সাদা কাপড়ে দেবার মতো সামান্য ব্লু মিশিয়ে চুনকামের গোলা প্রস্তুত করার ক্ষেত্রেও বিশেষ দক্ষতা প্রয়োজন। বালতির তলায় পড়ে-থাকা ময়লা বা গাদ বাদ দিয়ে এই গোলা তৈরি করতে হয়। দেওয়ালের তাগবাগ বুঝে ডবল কোট বা তিন কোট গোলা লাগিয়ে তা রঙ-চড়ানোর উপযুক্ত বলে বিবেচিত হতে পারে।

চুনকাম করার জন্য দরকার পাটের তৈরি গোল ব্রাশ। রাজমিস্ত্রি বা রংমিস্ত্রিরা ঘরবাড়িতে গোলা লাগাবার কাজে এই ধরনের তুলি ব্যবহার করে থাকেন। দেওয়াল লেখার সমস্ত সরঞ্জাম, শক্ত-পোক্ত, মোটা-সরু, চ্যাপ্টা-গোল তুলি, শিরীষের গুঁড়ো আঠা, ব্লু, এলামাটি, ফ্লুরোসেন্ট ডাস্ট রং―সবকিছু মেলে হার্ডওয়ারের দোকানে। যাঁরা ভালো বা দামি তুলি ব্যবহার করেন, যাঁরা দেওয়াল লেখার ব্যাপারে বেশ সৌখিন―তাঁদের যেতে হয় রংয়ের দোকানে!

দেওয়াল নির্বাচন ও চুন গোলার মতোই রঙ নির্বাচন ও রঙ গোলাটাও সহজ কাজ নয়। আঠা বেশি দিলে রঙ শুকোলে দিন কয়েকের মধ্যেই চটা উঠে একসা হবে। চুন লাগানো ঠিক না হলে হু হু করে রঙ টেনে নেবে, হিসেবকষা বাজেটের দফারফা! রঙে কতটা জল মেশানো হবে সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও দক্ষতার ব্যাপার। বেশি জল দিলে পাতলা রঙ শুকোলেই ফ্যাকাশে, এক রোদেই ফরসা। কম জল দিলে তুলি টানতে অসুবিধা, রঙের বেশি খরচা, বড়ো মাপের অক্ষর ভরাট করতে চারবার রঙগোলার সমস্যা। একই ওয়ালিংয়ে একাধিকবার রঙ গোলার সমস্যা এই যে, দ্বিতীয়বার রঙ গোলার সময় এমন সম্ভাবনা যথেষ্টই থাকে যে, প্রথমবারের রংয়ের সঙ্গে দ্বিতীয়বার গোলা রংয়ের শেড কিছুতেই মিলতে চায় না।

 

(ক্রমশ)

Author

1 thought on “অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৬। অনন্ত জানা

  1. অভিজ্ঞতার রক্ত ঘামের রঙে, আপন মনের মাধুরী তুলির টানে লেখা অনন্ত জানার এই উপন্যাসের প্রশংসা ভাষায় ব্যক্ত করা যায় না । কলম চলুক …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *