অক্ষর-চরিত্র ও জ্ঞাপন-বাণিজ্য : এক অন্তহীন এপিটাফ। পর্ব ৩। অনন্ত জানা

0

(গত পর্বের পর)

ছোটোবেলায় তিনি আর সুধাময় এখানকার নির্জন বিকেলবেলায় পাশের ব্রিজ-কালভার্টে দাঁড়িয়ে কু-ঝিক-ঝিক রেলগাড়ি দেখতে আসতেন।

রাজ্য-সড়কে পৌঁছে আর নিজের ছেলেবেলার গঞ্জটিকে চিনতে পারলেন না তিনি।

রাজ্য-সড়ক এখানে দোকানে-পাটে, মানুষের ভিড়ে বেশ সংকীর্ণ।

সামনেই একটা মাঝারি মাপের দুটি মিষ্টির দোকান। পাশাপাশি নটকনা, স্টেশনারি, জুতো, তেলেভাজা, কাপড়জামা, চা, ফল-ফলারি, রুমাল-মোজা ইত্যাদির দোকান। সবই খোলা। সব দোকানেরই বাইরে ক্রেতা আকর্ষণের জন্য সাজানো পশরা দোকান ছাপিয়ে রাজ্য সড়কে এসে রাস্তাটাকে সংকীর্ণ করে তুলেছে। মিষ্টির দোকানের নোনতা-ভাজার উনান আবশ্যিকভাবে দোকানের বাইরে, দু-চারটে টেবিল রেখে তার ওপরে পাঁউরুটি, গজা, জিলিপির বারকোষ ইত্যাদি সাজানো। এখানেই সদর ও মহকুমাগামী বাস, ট্রেকার থামে, যাত্রী ওঠা-নামা করে। সেই যাত্রীরা গোগ্রাসে সিঙারা-জিলিপি-কচুরি খায়।

পাশেই চপ-ঘুগনির দোকান। স্টিলের কাঁধা উঁচু কাসিতে মুড়ির স্তূপ নিয়ে কেউ কেউ চপ চটকে বা ঘুগনি দিয়ে মেখে খাচ্ছে।

মিষ্টির দোকানদারকে সুধাময়ের আনুপূর্বিক বর্ণনা দিয়ে হদিশ জিজ্ঞাসা করলেন তিনি।

কোনো লাভ হলো না।

তিন-চারটি দোকান ঘুরেই বুঝলেন সুধার ঠিকানায় পৌঁছানো, সুধার খোঁজ পাওয়া অতটা সহজ কাজ নয় !

বাসরাস্তা দিয়ে কিছুটা এগোবার পর বাসযাত্রীদের ভিড় পাতলা হয়ে এসেছে।

সেখানেই একটা বড়ো মুদি দোকান। এখানকার ভাষায় নটকনা ভাণ্ডার।

নটকনার দোকানি সব বর্ণনা শুনে চোখ-কুঁচকে মিনিট-খানেক ভাবলেন তার পর বললেন―‘আপনি যা বলছেন সেই রকম এক ভদ্রলোক, সিড়িকোড্ডে বাজারে তার দোকান, আপনার বন্ধুই হবেন―আমার এই মোকাম থেকেই মাঝেমধ্যে পাইকারি মাল নেন। এভাবে তো খুঁজে পাবেন না দাদা। গত দশ বছরে একশো গুণ লোক বেড়েছে। কে কোথায় থাকছে, কে কোথায় যাচ্ছে সে-হদিশ পাওয়া মুশকিল! আপনি আরও এমন কিছু বলুন যাতে আর একটু কাছাকাছি পৌঁছানো যায়।’

তাঁর খেয়াল হলো, সুধা বলেছিল―সন্ধ্যেবেলা সিড়িকোড্ডে থেকে ফিরে সে রাধাকৃষ্ণ টেলার্স বলে একটা দর্জির আড্ডা দেয়। এ-কথা বলতে নটকনার দোকানদার হেসে ফেললেন, বললেন―‘রাধাকৃষ্ণ টেলার্স বললে এখানে কেউ চিনতে পারবে না। দোকানদারের নাম বলতে হবে। এই দেখুন না কেন, আমার এতবড়ো দোকান, আমাদের তিন পুরুষের ব্যবসা। দোকানের পোশাকি নাম মেসার্স পোদ্দার ব্রাদার্স অ্যাণ্ড সন্স। সে শুধু পঞ্চায়েতের ট্রেড লাইসেন্সে। কাউকে বলুন তো, সে চিনতেই পারবে না। কিন্তু একটিবার বলুন বাবু লালার দোকানে যাব―সদর পর্যন্ত সক্কলে এক-ডাকে চিনে যাবে ! আমার ঠাকুরদারকে সবাই বাবু লালা বলতো, ব্যস, ওটাই টিকে আাছে। এই যে আপনি সিড়িকোড্ডের নাম করলেন, ঐ জায়গাটার নাম আসলে সিড়িকড়িধ্যা ! কড়িধ্যা থেকে কোড্ডে হয়েছে। সিড়িকড়িধ্যা কিংবা সিড়িকোড্ডে বললেও লোকে সহজে চিনতে পারবে না, বলতে হবে সিডেকোড্ডে !’

দোকানির কথায় তিনি চারপাশে তাকিয়ে দেখলেন, এই দোকানসহ কোনো দোকানের সামনেই কোনো সাইনবোর্ড নেই !

সুধা টেলারের নামটাও নির্ঘাৎ বলেছিল। কিন্তু রাধাকৃষ্ণ টেলার্সটুকুই তিনি খেয়াল করতে পারলেন।

নটকনার দোকানদার বললেন―‘এখন তো এখানে অলিতেগলিতে টেলারিং-এর দোকান। খান-পঁচিশ-তিরিশ তো হবেই, বাড়ির সামনের ঘরেই লোকে রোজগারের আশায় মেশিন নিয়ে বসে পড়েছে। এখানে খলিফার নাম করতে হবে। পঞ্চায়েতের খাতায় যা-ই থাকুক না কেন সে নাম কেউ জানে না। আপনি ভাই এক কাজ করুন, এই রাস্তার ডানদিক ধরে সিধা চলে যান, হাটতলার আগে পর্যন্ত খান-দশেক দর্জির দোকান পেয়ে যাবেন। সেখান থেকে রাস্তার ডানদিক ধরে ঘুরে আসুন, আরও খান-পাঁচেক পেয়ে যাবেন। প্রত্যেক দোকানে আপনার বন্ধুর নাম বলে খোঁজ করুন, তাতেও যদি না পান তো অন্য ব্যবস্থা দেখতে হবে।’

কথা বলতে বলতে সন্ধ্যে নেমে এল।

বাবু লালার নাতিকে নমস্কার জানিয়ে মানুষটি এক অদ্ভুত কাজে পথে নেমে এলেন।

খান-আষ্টেক দোকানে খোঁজ করার পর, হাটতলার ঠিক আগে একটা পুরোনো, ক্ষয়াটে, রাস্তার সঙ্গে লেগে থাকা বাড়ির বহির্ভাগে একটা টেলারিং দোকানে খোঁজ পাওয়া গেল সুধাময়ের।

―‘এটা কি রাধাকৃষ্ণ টেলার্স ?’

মেশিনের সামনের টুলে বসে থাকা মধ্যবয়সী মানুষটা চোখ তুলে তাকালেন। তাঁর চোখে রাজ্যের বিস্ময়―‘এ নাম আপনি জানলেন কী করে?’

―‘সুধাময় কি আপনার এখানেই বসে ?’

 

 

সুধালাভ

দোকানি বললেন―‘সুধাময় মানে সুধো ? বসে বৈকি ! আপনার পরিচয়?’

পরিচয় দিলেন মানুষটি। সুধাময়ের বন্ধু ছাড়া এখানে তাঁর আর তো কোনো পরিচয় নেই ! একটু বিস্তারিত পরিচয়ই দিতে হলো। সামান্য সময়ের মধ্যেই সে পরিচয় আলাপ হয়ে জমে উঠলো।

ভদ্রলোকের নাম গোপাল বাড়ুজ্যে, খাস রাঢ়ী বামুন। বললেন―‘রাধাকৃষ্ণ টেলার্স নামটা আমিই তো ভুলে গিইছি, এখেনে বলতি হবে গোপাল বাড়ুজ্যের দোকান। তবে লোকে হদিশ দেবে!’ গোপাল বাড়ুজ্যে  বার বার বলতে লাগলেন―‘একটু বসেন কেনে, সুধোর ভটভটির পুষ্পক রথ এলো বলে !’

সুধাময় একটু পরেই এলো, ভটভটিটা রাস্তার পাশে রেখে দোকানে উঠে এলো।

তাঁকে দেখেও প্রথমটায় সুধাময় বিশ্বাসই করতে পারেনি তার সেই মহার্ঘ বাল্যবন্ধু এতদূরে তার কাছে এসেছে। সে যে কী করবে ভেবে উঠতে পারছিল না। আনন্দের আতিশয্যে শীতল পাটি-বিছানো ঘরের মেঝেতেই খানিক গড়াগড়ি দিয়ে দিল সে। আড্ডাড়ুরা একে একে এসে পড়ছিলেন।

একটু ধাতস্থ হবার পর সুধাময়ের ব্যবস্থাপনায় চপ এলো, মুড়ি এলো, চা-বিস্কুট এলো।

বন্ধুর এত আপ্যায়নে মানুষটির চোখে জল এলো।

বাবার নিষ্ক্রমণের পর থেকেই তিনি এতকাল ঘরে-সংসারে, ছবি-আঁকিয়েদের গোষ্ঠীতে-লবিতে নিজেকে অপাংক্তেয় বলে মনে করে এসেছেন। এমন-কী দাদা বউদিদের চাপে আর বিরাগের ভয়ে মা পর্যন্ত তাঁর শিল্পপাগল ছোটো ছেলের খোঁজ বা যত্ন নিতে পারতেন না। বরং অন্যদের সকলকে দেখিয়ে দেখিয়ে ঔদাসীন্য প্রদর্শন করতেন যেন।

সংসারে বুদ্ধিবল বা চরিত্রবল অপেক্ষা লোকবল বা অর্থবলের জোর অনেক বেশি!

বন্ধুকে খোঁজার রোমহর্ষক অভিযানের কথা শুনে সকলেই খুব হাসছিলেন। গোপালবাবু বললেন―‘আরে মশাই, সুধাকে পেতে তো এইটুস কষ্ট করতেই হবে !’

এঁদের ব্যবহারে তাঁরও মুখ খুলে গেল, বললেন―‘কিন্তু তা-বলে রাধাকৃষ্ণ টেলার্সে বসেও প্রশ্ন করতে হবে আসলে রাধাকৃষ্ণ টেলার্সটা কোথায় বলুন তো! ঘরটায় আবার হাসির গররা দেখা দিল!’

গোপালবাবু হাসি থামিয়ে বললেন―‘সেটা ঠিক, গোপাল বাড়ুজ্যের দোকান না বললে পাশের ইলেকট্রিকের দোকানওয়ালা বুধু পর্যন্ত বলতে পারবে না সেটা আবার কোন দোকান। তা আপনে শিল্পী মানুষ, আপনের উপযুক্ত কাজ না-হলেও নিজির লোকের জন্য দিন না ফাঁকিয়ে একটা বোর্ড ‘রাধাকৃষ্ণ টেলার্স’, দিই বাইরে লটকে।’

সুধা তড়িঘড়ি আপত্তি জানালো―‘বলো কী গোপালদা ! সুমন কত বড়ো আর্টিস্ট তা জানো, ও ফুল লতা পাতা, টেবিল চেয়ার আঁকে নাকি ! ও কি তোমার সাইনবোর্ড লিখিয়ে!’

সুধাময় যখন গভীর আস্থাভরে তাঁকে ‘কত বড়ো আর্টিস্ট’ বলল তখন সুমনের মনে হলো শুনলেন সুধাময় বলছে ‘কত হেরো আর্টিস্ট’―তাঁর প্রকৃত হাল যদি সুধা জানতো!’

সুমন তাড়াতাড়ি গোপাল বাড়ুজ্যেকে বললেন―‘আমি কখনও সাইনবোর্ড লিখিনি, কিন্তু আপনারটা দিয়েই চেষ্টা করে দেখতে পারি।’

বন্ধুরা বললেন―‘এখেনে তো কেউ সাইন বোর্ড বা বিজ্ঞাপনের ধার ধারে না, দিন লিখে। আমাদের রাধাকিষ্ট টেলার্সের নাম এই মাঠেল অঞ্চলে একেবারে ফেটে যাবে!’

রাত্রে সুধাময়ের তিন কামরার বাড়ির বাইরের দিকের ঘরের চৌকিতে দুই বন্ধুর আড্ডায়-শয়নে সব কথা শুনে সুধাময় বলল―‘তায় আর কী, তোর তো কুনো পাছুটানই রইল না। তুই এখেনেই ’র। কিছু-মিছু কর আর ছবি আঁক। ইচ্ছে মতন হাত-পা-ছড়িয়ে বাঁচ। হিসেব মতন দেখতে গেলে আমাদের বয়েসও তো কম হলো না। দুই বন্ধু জড়ান-প্যাঁচান দিয়ি থাকি।’

দিন-কয়েক পর থেকেই অদ্ভুত এক যাত্রা শুরু হলো সুমনের। দু-দিন আগেই এমন জীবনের কোনো প্রকল্পনা তাঁর নিরালম্ব-শূন্যতায় বেপথু হাওয়া হয়েও প্রবেশ করেনি।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *