সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৭। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
….প্রত্যেক রোববার আমরা পাইন হিলের ছোট্ট বাড়িটায় যেতাম। এইটুকুনি বসার ঘর আমরা ভিড় করে আছি, চারপাশে চা, চা বাগানের জীবনের নানান চিহ্ন, স্মরণিকা। হাঁ করে দেখতাম। লর্নার বাবা, ইগার্টন পিটার্স, কেতাদুরস্ত পোশাকে তাঁর ফোটো, পোলো খেলায় জেতা একটা ট্রোফি, তাতে লেখা বিজেতা কাছাড় দলের অধিনায়ক ই জি পিটার্সকে প্রদত্ত, যুদ্ধের নানান মেডেল, রীতিমতো ভয় পাইয়ে দেওয়া বিরাট বিরাট সব হরিণের শিং, তাঁর শিকারি জীবনের অভিজ্ঞান। লর্নাকে মনে ছিলো, কিন্তু তাঁর ঘরের এই সব নানান জিনিস সম্পর্কে আমার কৌতুহল জন্মায় আরো পরে, ততদিনে তিনি চলে গেছেন। জিনিসগুলো যতটা প্রত্যক্ষ, বাস্তব, তাদের ঘিরে থাকা যাবতীয় গল্পকাহিনী ততটাই নীরব। না জানা, অজ্ঞেয়, রহস্যময় ও গোলমেলে সে সব কাহিনীর উৎসে জমে থাকা ভীষণ নীরবতাকে অতিক্রম করা যায় না, ফলে আমি মেডেলগুলো নামিয়ে, বারবার ছুঁয়ে দেখতাম, বুঝতে চেষ্টা করতাম কি গল্প তারা বলতে চাইছে।…ডনের বড় ভাই, আমার জেঠু বিল মারা গেলেন ১৯৯৯-এ, আমরাও পাইন হিলের বাড়িতে উঠে এলাম। বাড়ির সামনের পাইনের জঙ্গল পাতলা করা হলো, নিচের শহর, বন্দর দেখা যাচ্ছে তখন, বাড়ির ভিতরেও ঝাড়পোছ সাফসুতরো করা হলো। ক্রমে জমে থাকা পুরোনো জিনিসপত্রে হাত পড়লো। তাঁর মৃত্যুর পর থেকে লর্নার পোশাকআশাক দেরাজবন্দী হয়ে সেই একভাবে পড়ে ছিলো কুড়ি বছর ধরে, অন্যান্য আলমারি, সিন্দুক, আসবাব, সব পুরোনো, চলে যাওয়া জীবনে ভর্তি। কাগজের টুকরো, পুরোনো খাম, ফোটোর পিছন দিকটা, যেখানে যা পেতেন সেখানে কিছু না কিছু লিখে রাখতেন লর্না, লিখে দেরাজে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখতেন।
…বাবা কিছু টুকরোটাকরা খুঁজে পেলেন। তার ভিতরে লর্নার বিয়ের শংসাপত্র, তাতে লর্নার মায়ের নাম লেখা, মেরি ফ্লেচার। কি মন খারাপ হলো আমার–হায়, তাহলে কোন ভারতীয় মা নেই–তবে সামলে উঠলাম। লর্নার গায়ের রং, চেহারার গড়ন, যা উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর ছেলেরা, নাতনিনাতিরাও পেয়েছে, তা থেকে দিব্যি বোঝা যায়, আমাদের ‘মিশ্র’ বংশ। এরও বেশ কিছুকাল পরে, আসল ব্যাপারটা ঘটলো। আমি ভারতবর্ষ ঘোরার পরিকল্পনা করছিলাম, সে প্রসঙ্গে পাইন হিলের বাড়িটায় গিয়ে বাবার সঙ্গে আর একবার দেখা করলাম, লর্নার কথা আবার জিজ্ঞেস করা, পোলো ট্রফিটা আর একবার দেখা, এটা ওটা করা আর কি, যদি নতুন কিছুর খোঁজ মেলে। নিজের শোবার ঘর থেকে বাবা এক গোছা ফোটো বার করে নিয়ে এলো। এই ছবিগুলোকে আমি আগে কখনো দেখিনি। বাবা দেখেছে, ছোটবেলায়। তরুণ ইগার্টনের ছবি, ইংল্যান্ডে, আসামের চা বাগিচায়, লর্নার ভাইবোনদের ছবি, নিউজিল্যান্ডে। ছবির বড় খামের ভিতরে আর একটা ছোট বাদামি রঙের খাম, তার ওপরে লেখা, ‘কালিম্পং ইস্কুল’। ওদিকে আমার চোখ যাচ্ছে দেখে, বাবা বললো, কি জানি কি! ওই স্কুল টুল কিছু একটা হবে, আগে দেখিনি। তেমন দরকারি কিছু নয় নিশ্চয়। খামের ভিতরে দুটো ছবি। গ্রুপ ছবি। একসঙ্গে জনা তিরিশ মেয়ে, গুড়গুড়ি থেকে কিশোরী বয়সের, সাদা জামা পরে অমসৃণ দেয়ালের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে। ছবির তলায় সবার নাম লেখা। একদম কোণায় লর্না, পিছনে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে, সামনে উবু হয়ে বসে তাঁর ছোট্ট বোন, অ্যালিস।
সেই শুরু। লোনলি প্ল্যানেট গাইডবইতে কালিম্পং-এর উল্লেখ ছিল, সেখানকার দ্রষ্টব্য জায়গার মধ্যে গ্রাহামস হোমের কথাও। মাস কয় পর, জেন ম্যাকেব এবং তাঁর বন্ধু চীন, রাশ্যা ও পশ্চিম য়ুরোপ ঘুরে দিল্লি পৌঁছলেন। আরো ঘোরাঘুরির পর, তাঁরা কালিম্পং এলেন ২রা অক্টোবর। গান্ধী জয়ন্তীর ছুটি, হোম বন্ধ। কোনরকমে সে দিন কাটলো। পরের দিন, দুরু দুরু বুকে হোমের মধ্যে ঢোকা, জেনের হাতে লর্নার স্কুলজীবনের ছবি। সেসময় যিনি ইস্কুলের প্রধান শিক্ষক, সবে এসেছেন, বিশেষ কিছু বলতে পারলেন না। কিন্তু ছবিটা যে হোমেরই, তিনি নিশ্চিত, যে বাড়িটা ছবিতে দেখা যাচ্ছে সেটা হোমের একটা কটেজ। অতঃপর:
কেউ একজন এসে আমাকে হোমের মিউজিয়ামে নিয়ে গেলো। খুব পুরোনো, আসল ভর্তিখাতাটা দেখতে দিয়ে আমাকে বলা হলো, লর্নার নাম সেখানেই থাকার কথা। ছিলোও। খাতাবন্দি নামের তালিকায় হাত বোলাতে বোলাতে আবিষ্কার করলাম(এতদিন ধরে কিচ্ছু জানতাম না): লর্নার মা ‘নেপালি’(‘ভারতীয়’ নন?), তাঁদের ভর্তির সময় তিনি জীবিত, পুরো পনেরো পনেরো বছর লর্না ও তাঁর ভাইবোনেরা হোমে কাটিয়েছেন।
জেন অবাক হয়ে দেখলেন, হোমের প্রত্যেক আবাসিকের নামে নামে আলাদা ফাইল আছে, সেখানে ভর্তির সময় থেকে ইস্কুল ছাড়া অবধি যাবতীয় নথিপত্র(যার ভিতর আবাসিকদের বাবা এবং অভিভাবকদের লেখা চিঠিচাপাটিও আছে) মজুত। সে সব ফাইল শুধুমাত্র পরিবারের লোকজনকে দেখতে দেওয়া হয়, বাইরের কাউকে নয়। যেমন, লর্নার ফাইলটা জেনকে দেখতে দেওয়া হয়, এমনকি, সে ফাইলের কাগজপত্রের প্রতিলিপি নিয়ে যেতেও দেওয়া হয়। সেই চিঠিপত্র নথির মধ্যে ডুবে গেলেন জেন, ঘুরে বেড়ালেন হোমের বাড়িঘরে, যে কটেজে তাঁর ঠাকুমা লর্না জীবনের পনেরো বছর, অর্থাৎ নিজের গোটা ছোটবেলা কাটিয়েছেন, সেই বাড়িতেও গেলেন।
(ক্রমশ)