সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২৫। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ

0

গত পর্বের পর

কালিম্পংয়ের হোম থেকে যে বা যাঁরা দেশান্তরী হয়ে সাম্রাজ্যসেবা করছিলেন, তাঁরা সবাই নিশ্চয় ডলির মতো দুর্ভাগা নন, ভেবে নিয়ে আশ্বস্ত হওয়া যায়। কালিম্পংয়ের সুন্দর সবুজ ঠান্ডায়, হবহু স্কটল্যান্ডিয় কায়দায় তৈরি কটেজবাড়িতে, ড্যাডি গ্রাহামের ছত্রছায়ায়, ও খাঁটি প্রেসবাইটারিয়ান শৃঙ্খলায় বড় হয়ে ওঠা ডলির জীবনকাহিনীতে নিরন্ধ্র যন্ত্রণা ভিন্ন অন্য কিছুর সন্ধান পাওয়া যাবে না, তথাপি। ওজিবিদের কথা বলেছি।তাঁদের নিজস্ব ফেসবুক পাতা আছে, গ্রাহামস হোমের সরকারি(প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে) পাতাতেও তাঁরা বিশেষ সক্রিয়, দেখা গেলো। ফেসবুক ব্যবহার করি না দীর্ঘকাল, গুগল খুলে পাতা খোঁজার বিস্তর ঝামেলা। তাও খুঁজলাম, এবং ফলে অপ্রত্যাশিত প্রাপ্তি হলো। ডলি হিগিন্সকে নিয়ে বইটার সন্ধান পাওয়া গেলো ওজিবিদের পাতায়। সন্ধান দিয়েছেন স্কটল্যান্ড থেকে নোরা ইয়াং। ফেসবুকে যেমন হয়, কেউ কিছু লিখলে তাতে নানা রকম মন্তব্য হয়, সেই মন্তব্যের ওপরও মন্তব্য থাকে। সেই রকম মন্তব্যের মন্তব্যের মধ্যে গিয়ে দেখলাম, ডলিকে নিয়ে নোরার নাতিদীর্ঘ চিঠি। একেবারেই হালের লেখা চিঠিটা তুলে দেওয়া যাক:

 

আমার ঠাকুমা ডলি হিগিন্স(জন্ম ১৮৯২, ডরোথি রজার্স নামে) কলকাতার সেন্ট মেরিজ হোম থেকে কালিম্পংয়ে আসেন ১৯০১ সালে।…আমার নিউজিল্যান্ড নিবাসী বাবা ডলির এক ছেলে। ডলির ছয় সন্তান। দুজনকে দত্তক নেবার জন্য দিয়ে দেওয়া হয়, আমার বাবা তাদের একজন। একজন আগুনে পুড়ে মারা যায়, একজন বাড়ি ছেড়ে চলে যায়, আরেকজন তার বাবার কাছে ‘পালিয়ে’ যায়। সবচেয়ে ছোটজন মেয়ে, ডলির মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর মায়ের সঙ্গে ছিলেন। ক্রাইস্টচর্চের রুরু লন সমাধিক্ষেত্রে ডলি শায়িত, ডরিস ইথেল স্মিথ নামে। সারাজীবন তিনি নাম বদলাতে থেকেছেন।

 

নোরা যে তাঁর ঠাকুমার জীবনের নানান টুকরোগুলোকে খুঁজে বার করতে চাইছেন, বোঝাই যায়। নোরা একা নন। হোম থেকে বহুদিন আগে চলে যাওয়া, বহুক্ষেত্রেই একেবারে হারিয়ে যাওয়া সব মানুষ, আত্মীয় পরিজনরা অনেকেই তাঁদের নিরন্তর খুঁজে চলেছেন। যে ফেসবুক পাতা থেকে নোরার চিঠিটা তোলা, সেখানেই দেখা যাচ্ছে, নিউজিল্যান্ড থেকে ওয়েন্ডি ডেভিস তাঁর আত্মীয়দের খোঁজ করছেন। তাঁর অনেকগুলো প্রশ্ন/মন্তব্য ইত্যাদি আছে, যে প্রসঙ্গে নোরার চিঠি, মন্তব্য। ওয়েন্ডি-র কথাও শোনা যাক:

 

কারুর কাছে কী ১৯০১-এর ভর্তি-খাতাটার একটা ছবি পাওয়া যেতে পারে? আমাদের আত্মীয় ইভলিন ও নোরা ফুলারটন ১৯০১ এ কালিম্পং আসেন, থাকেন ১৯১২ ও ১৯১৫ অবধি। নার্সের কাজ নিয়ে ইভলিন তাঁর পর নিউজিল্যান্ডে চলে যান, নোরাও ওই একই কাজে প্রথমে কলকাতায় আসেন, সেখান থেকে ইংল্যান্ড। এঁদের সম্পর্কে আরো কিছু জানতে পারলে খুব ভালো লাগবে।

 

এগারো

অনির্বাণ ভট্টাচার্য জানাচ্ছেন, বিভিন্ন সূত্র থেকে সংগ্রহ করে পুরোনো ছবির একটা অ্যালবাম তিনি বানিয়ে ফেলেছেন, ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে পরের বছরগুলোর, প্রথম যে দলটা নিউ জিল্যান্ড পৌঁছোয়, তাদের, এমন কী গ্রাহামবাবা যখন নিউজিল্যান্ড যাচ্ছেন ১৯৩৭-এ, সে ছবিও। সেই ভ্রমণকালে গ্রাহামের সঙ্গে পুরোনো হোমবাসিন্দাদের একটা ছবি অনির্বাণ দিয়েছেন। অন্য ছবিগুলো পাওয়া গেলো না।

 

এই প্রসঙ্গে ওয়েন্ডি বলছেন:

 

ইভলিন ফুলারটন ছিলেন আমার দিদিমার(নাকি ঠাকুমা?) মা। তাঁর বোনের নাম ছিলো নোরা ফুলারটন। তাঁর চিঠি থেকে জানা যায়, তাঁরা কালিম্পং পৌঁছেছিলেন ১৯০১এ(বেশি বয়সে লেখা চিঠি, সুতরাং হতেই পারে আসলে ওটা হবে ১৯০২), কী আর বলি, কোন কটেজে ওঁরা ছিলেন সেটা জানি না ভেবে এত খারাপ লাগছে।…ওঁদের ভর্তির সময়কার একটা ছবি পাওয়া গেলে এত ভালো লাগতো। ওঁদের বাবা ছিলেন ব্রিটিশ সৈনিক, ১৯০০ নাগাদ বুয়র যুদ্ধে গিয়ে মারা যান, তাঁর প্রথম নামটা অবধি জানি না, হয়তো থমাস(বুয়র যুদ্ধে মৃতদের তালিকা থেকে নামটা পেলাম)।

 

ডেভিড, অধুনা ইংল্যান্ড নিবাসী এক প্রাক্তন হোমবাসিন্দা আর এক প্রাক্তনীর মাধ্যমে জানান, নোরাকে তিনি চিনতেন। দীর্ঘদিন লন্ডনের উপকন্ঠে ক্রয়ডনে এক দাতব্য প্রতিষ্ঠানে কাটাবার পর, ওখানে থাকতে থাকতেই তাঁর দেহান্ত হয়। ডেভিড বলছেন:

 

আমি এবং আমার স্ত্রী সম্ভবত শেষ ওজিবি, ক্রয়ডন মে ডে হাসপাতালে নোরা মারা যাবার আগে, যাদের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছিলো। হাসপাতালের কাছের একটা বড় গীর্জায় তাঁর পারলৌকিক কাজ সম্পন্ন হয়, আমরা ছাড়াও সেখানে আরো বেশ কয়েকজন ওজিবি ছিলেন।…তাঁর মৃত্যুতারিখ ১৯৮৩-র ১৩ই জুলাই। আমার কাছে একটা পুরোনো ফাইল আছে, ব্রিটেনের কালিম্পং অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম রেজিস্টার, সেখানে সবার ঠিকানা লেখা ছিলো। ওই ফাইলেই বলা আছে নোরা হোম ছাড়েন ১৯১৩ কিম্বা ১৯১৮-য়…একটা গল্প বলি শুনুন। আমাদের চাইতে অনেক বড় একজন ওজিবিকে নিয়ে। হোমে এসেছিলেন ১৯২৯-এ, ছ’মাস বয়সে। তাঁকে কেউ একটা দত্তক নিয়েছিলো। ইনিও ক্রয়ডনে থাকতেন, মারাও গিয়েছিলেন এখানেই, ১৯৮০-তে। বিয়েথা করেননি, চমৎকার কথা বলতেন…একবার একটা পুনর্মিলন অনুষ্ঠানে আমাকে পেড়ে ফেললেন, একটু কথা বলেই কানে কানে ফিসফিস করে বললেন, ‘হবে নাকি একটা পাঁচ পাত্তি?’সেসময় সেটা এখনকার ২৫ পাউন্ড প্রায়। কী আর করি, হাসি হাসি মুখ করে টাকাটা বার করে দিলাম। এর বছরখানেক বাদেই তিনি মারা যাবেন…সাজপোশাকে বরাবর খুব কেতাদুরস্ত থাকতেন….

 

ফেসবুক পাতায় দেখলাম, ওয়েন্ডি দুটো ছবি দিয়েছেন। হলদে হয়ে আসা আবছা ছোট ছবিতে দেখা যাচ্ছে, দুটি মেয়ে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে, একজন একটু ছোট, মোটাসোটা, অন্যজন বড়। ইভলিন এবং নোরা। ছবি পরিষ্কার নয় বলে অন্য আর একটা ছবিতে রঙ চাপানো হয়েছে। রঙ থেকে কী ওঁদের জীবন রঙীন হয়ে উঠবে আবার?

 

ওই পাতার অন্য একটা জায়গায় দেখলাম, ইসোবেল গেস্ট তাঁর পালিকা মা ফ্লোরেন্স গেস্টের খোঁজ নিচ্ছেন। তিনি থাকতেন ম্যান্সফিল্ড কটেজে, তাঁর বোনের নামও ছিলো ইসোবেল। ডেরিক ওডহাউস জানাচ্ছেন, ফ্লোরেন্স গত হয়েছেন বছর দশেক আগে। ফ্লোরেন্সের পালিত পুত্র অ্যান্ডি সম্ভবত দিল্লিতে থাকেন এখন।

 

ডলি, ইভলিন, নোরা, ফ্লোরেন্স। নোরা ইয়াং, ওয়েন্ডি ডেভিস, ইসোবেল গেস্ট। নিউজিল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, ইংল্যান্ড। দেশান্তরী হওয়া হোমের পুরোনো বাসিন্দারা কে কোথায় গেছেন, কিভাবে জীবন কাটিয়েছেন, কীভাবেই বা তাঁদের খোঁজ পাওয়া যায়, জানা নেই। ওজিবি হিসেবে হাতে গোনা যে কয়েকজন হোমের সঙ্গে সংযোগ রেখেছেন, তাঁদের বাদ দিলে বাকিদের, বিশেষ করে মেয়েদের, কী গতি হয়েছে? দু দুটো বিশ্বযুদ্ধ গিয়েছে মাঝখানে, সাম্রাজ্য ভেঙে চৌচির, চেনা পৃথিবী দুমড়ে মুচড়ে একসা, সেই ধুন্ধুমার অনিশ্চয়তার মধ্যে খোঁজ চলছে, কারুর দিদিমা ঠাকুমা, কারুর মা, কারুর মাসি। কেমন ছিলেন তাঁরা? কোথায় ছিলেন? কেমন ছিলো কালিম্পংয়ের হোম, গ্রাহাম সায়েবের তৈরি করা বাড়ি?

 

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *