দ্বিজেন্দ্রলাল রায় : এক অনাবিষ্কৃত ভুবন। শতঞ্জীব রাহার ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও বাংলার কৃষক’ পড়লেন অপরাজিতা মুখোপাধ্যায়
“মনিবরা আমাকে ফের বদলি করলেন— দেবই এবার চাকরি ছেড়ে। আমি কি একটা ফুটবল নাকি যে ওরা যখন যেখানে খুশি শুট করে পাঠাবেন?”
একটি চিঠির অংশ। এই অংশটি পড়েই বোঝা যাচ্ছে যে, এর আগেও বহু ‘শুট’ হজম করতে হয়েছে লেখককে। পত্রলেখক দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও প্রাপক তাঁর পুত্র দিলীপকুমার রায়। এর প্রেক্ষিতটি খুঁজতে আমাদের চলে যেতে হবে শতঞ্জীব রাহার ‘দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও বাংলার কৃষক’ বইটির কাছে।
নাতিদীর্ঘ প্রথম অধ্যায়েই লেখক এ বইয়ের মূল ধ্রুবপদটি তৈরি করে দেন এইভাবে—
দ্বিজেন্দ্রলালকে শুধুমাত্র স্বদেশপ্রেমের উদগাতা, কবি বা কুশলী নাট্যকার বলে মনে করলে তাঁর পরিচয় সম্পূর্ণ হয় না। বরং যুগের নিরিখে এ-সব প্রেক্ষিতে তাঁর কৃতিত্বকে ব্যতিক্রমী সাফল্যের নজির না বললেও চলে। কেননা তাঁর সমকালে সাধারণ বা পেশাদার মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ নাট্যকারই ইতিহাসের আধারে দেশাত্মবোধক নাটক রচনা করেছিলেন, সাধারণ রঙ্গালয়ে সেসব নাটক সাফল্যের সঙ্গে অভিনীতও হয়েছিল। বঙ্গভঙ্গরদ আন্দোলনের পূর্বে ও পরবর্তীকালে বাঙালির নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধকে তৎকালীন দর্শক রঙ্গমঞ্চে প্রতিফলিত দেখতে চাইছিল। তাই যুগস্বভাবের পথ ধরেই বঙ্গভঙ্গের উত্তেজনার দিনে তাঁর এই শ্রেণীর প্রথম নাটক ‘রাণা প্রতাপসিংহ’ রচিত ও অভিনীত হয়। নাট্য-আয়োজনের দিক দিয়ে ত্রুটিপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নাটকটি মঞ্চসাফল্য পায়। তথ্যগত এই সত্যতা সত্ত্বেও আমরা দেখতে পাই, স্বাদেশিক উত্তেজনা ও আবেগ তাঁর নাট্যকার-সত্তাকে দীর্ঘকাল তৃপ্ত রাখতে পারেনি। জাতীয় একদেশদর্শিতা, অনুদারতা ও সংকীর্ণতার প্রশ্নহীন অনুসরণ দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষে সম্ভব ছিল না। ‘মেবার পতন’ নাটকের বিশ্ববোধে উত্তরণ তাঁর পক্ষে অবশ্যম্ভাবীই ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশযাত্রা এবং বিলাত যাওয়ার কারণে সামন্ততান্ত্রিক সংস্কারের বিরূদ্ধে নিজের আধুনিক শিক্ষাকে প্রয়োগের সাহস। বলাই বাহুল্য যে, উনিশ শতকের বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও সমাজনেতাদের অনেকেই ঐতিহ্যের সঙ্গে শিক্ষার বিরোধে জীবনের শেষপর্যন্ত যুক্তিবাহিত ধ্রুবপথে স্থির থাকতে পারেননি। দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষে প্রত্যয়ী অবস্থানে স্থির থাকা সম্ভব হয়েছিল তাঁর মানসগঠন, শিক্ষা-মনন-চিন্তনের উচ্চতা, উন্নত ও আভিজাত্যপূর্ণ জীবনাদর্শের জন্যও বটে, সমাজবিজ্ঞানগত কারণেও বটে।
ভূমি-আইনের যুক্তিসম্মত ব্যাখ্যা হাজির করে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তগ্রস্ত বাংলার কৃষকদের পক্ষালম্বন করায় দ্বিজেন্দ্রলালের বিরোধ ঘটে ছোটোলাটের সঙ্গে। সেই বিরোধের ফলে বার বার বদলি করা হয়েছিল দ্বিজেন্দ্রলালকে তাঁর ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের চাকরি জীবনে এবং সেটা আক্ষরিক অর্থেই এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। প্রত্যাশিত পদোন্নতিও হয়নি তাঁর।
শুধু এইটুকু বললে যে বইটি সম্পর্কে সবটুকু বলা হয় না, তা বোঝা যাবে বইটির প্রসঙ্গক্রমের দিকে তাকালে। যদিও বইয়ে সূচীপত্র নেই, তবে বই এগিয়েছে এই প্রসঙ্গক্রম অনুযায়ী—
১. দ্বিজেন্দ্রলাল রায় : কক্ষ পরিক্রমা।
২. সবীজ অঙ্কুর।
৩. কর্মজীবনের সূচনা, বেদনারও।
৪. সুজামুটা পরগণা : বিরোধ ও বিরোধের ভিত্তি।
৫. সুজামুটায় বাংলার কৃষকের পক্ষে সংগ্রাম।
৬. ছোটোলাট বৃত্তান্ত।
৭. অন্য ধাতের মানুষ ফিন্যুকেন ও আইরিশ ভারতবন্ধুরা।
৮. বাংলার কৃষক : দ্বিজেন্দ্র-সাক্ষ্য।
৯. কুরুক্ষেত্র : স্বপ্ন ও নিষ্ক্রমণ।
১০. সম্প্রসারিত পাঠ ও সূত্র-পরিচয়।
বইটি সর্বমোট ১৬৪ পৃষ্ঠার। তার মধ্যে ৭৪ পৃষ্ঠা সূত্র-পরিচয়। এ বই বলছে ‘সম্প্রসারিত পাঠ ও সূত্র-পরিচয়’। লেখক ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন, “সূত্র-পরিচয়গুলি মূল রচনার পরিপূরক বলে সম্প্রসারিত পাঠরূপে এটিকে দেখতে হবে।” এই সম্প্রসারিত পাঠে একই সঙ্গে এসেছে তাত্ত্বিক-ভাষ্য ও প্রচুর তথ্য।
আমরা জানি যে, স্থানীয় ও কোনো দেশের জাতীয় সাহিত্যের গণ্ডি অতিক্রম করে বিশ্বসাহিত্যের উপাদানসমূহের জন্ম ও তার বিকাশের অন্যতম কারণ হলো শিল্পবিপ্লব পরবর্তী বৈষম্যমূলক উৎপাদন ব্যবস্থার আপাত বিশ্বজনীন চরিত্র। ফলে এ যুগের জাতীয় সাহিত্যের পক্ষেও জাতীয় একদেশদর্শিতার নিষেধরেখাকে মেনে চলা ক্রমেই অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফরাসি বিপ্লবোত্তর ভাব-বিপ্লবের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এক ধরনের আদর্শতাড়িত, বিবেক-দংশিত(ও কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্বার্থপীড়িত) বিশ্ববোধ। বিলেত ঘুরে আশা দ্বিজেন্দ্রলালের ঐতিহাসিক নাটকে বিধৃত বিশ্ববোধ এই ধরনেরই ইতিবাচক উদারতারই সমগোত্রীয় উৎস থেকে জাত হলেও বহুলাংশে স্বতন্ত্র। সেই সূত্রে সম্প্রসারিত পাঠ অংশে লেখক প্রায় দেড়-পৃষ্ঠা লিখেছেন উপনিবেশিক দেশগুলির নব্য-শিক্ষিত মধ্যশ্রেণীর সদ্য-জাগ্রত বিশ্ববোধের সঙ্গে ধনগরিমা-নিয়ন্ত্রিত বাস্তবতার পুনর্বিবেচনা-সাপেক্ষ সম্বন্ধটি নিয়ে। অংশটি তাত্ত্বিক হলেও দ্বিজেন্দ্র-মানসের খোঁজে এই অংশটির মূল্য যে অপরিসীম, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আবার বর্ধমান রাজ-এস্টেটের জয়েন্ট ম্যানেজার এইচ আর রেইলির সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রলালের দীর্ঘ পত্র-বাদানুবাদের পুরো অংশটিই লেখক উদ্ধৃত করেছেন সূত্র-পরিচয়ে। তাত্ত্বিক ও তাথ্যিক দু দিক থেকেই তাই এই সম্প্রসারিত পাঠ অংশটি অবশ্যপাঠ্য।
বইটিতে চিরস্থায়ী বন্দবস্তোত্তর বিকলাঙ্গ ভারতীয় কৃষি-ব্যবস্থার গলদটিকে লেখক বুঝতে চেয়েছেন চতুর্থ অংশে— ‘সুজামুটা পরগণা : বিরোধ ও বিরোধের ভিত্তি’—এই অংশে। দ্বিজেন্দ্রলালের চাকরিগত উপরওয়ালা এবং দ্বিজেন্দ্রলাল-ছোটোলাটের বিরোধে দ্বিজেন্দ্রলালকে সমর্থনকারী আইরিশ সিভিলিয়ান মাইকেল ফিন্যুকেনসহ অপরাপর আইরিশ ভারতবন্ধুরা এই বইয়ে একটি অধ্যায় অধিকার করেছেন। ফিন্যুকেনকে প্রায় পুনরাবিষ্কার করেছেন লেখক এই অধ্যায়ে। এই অংশটুুকুর জন্যও এই বইয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এই সূত্রেই লেখক উল্লেখ করেছেন ইংরেজ ও আইরিশদের জাতিগত বৈরিতার ইতিবৃত্ত। সেই ইতিবৃত্ত হয়ে এসে পড়ে ফিন্যুকেনেরও চাকুরিতে বঞ্চনা, সে-বিষয়ে ইংল্যান্ড পার্লামেন্টে দু-পক্ষের বাদানুবাদ। পার্লামেন্টে ভারত-সচিবের তথ্য উল্লেখে যে কৌশল ছিল, তা বিবরণও লেখক এখানে উল্লেখ করেছেন।
শিবনাথ শাস্ত্রীর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘রামতনু লাহিড়ী ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ’-এর মতো এই বইটিও যেন হয়ে উঠেছে— বাংলার কৃষকের পক্ষে দ্বিজেন্দ্রলালের ইতিবাচক ভূমিকাকে কেন্দ্র করে কলোনি-ভারতের ভূমি-সম্পর্কের ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শাসকদের ভূমিকার ইতিবৃত্ত। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়কে কেন্দ্র করে ঘটে চলা বহু ঘটনা নিয়েই প্রচলিত বিকলাঙ্গ ধারণাকে বদলে দিয়েছে এই বই।
চাকরির কুরুক্ষেত্রের ব্যূহ থেকে যে দ্বিজেন্দ্রলাল মুক্তি পেলেন না, সেসব নিয়েও যে ‘একঘরে’ দ্বিজেন্দ্রলালকে লিখে যেতে হলো— তার মধ্যে আমলাগিরির সঙ্গে রচক দ্বিজেন্দ্রলালের যে বিরোধটি ঘনিয়ে ওঠে, তারও হদিশ পেতে চান লেখক এ বইয়ে।
আসলে দ্বিজেন্দ্রলালের দেশপ্রেমের গভীরতা জাতীয়তাবোধ নামক আবেগের মধ্যেই নিহিত ছিল না। নিজের প্রতিবেশ, নিজের কর্মজীবন, জন্মগত বিবেকী-সংবেদনের কেন্দ্রে স্থিত থেকেই কৃষিপ্রধান বাংলার কৃষকের জীবন ও জীবিকার সমস্যার কেন্দ্রটিকে লক্ষ্যসীমার মধ্যে গ্রহণ করা ছিল দ্বিজেন্দ্রলালের পক্ষে অব্যবহিত প্রতিক্রিয়ার মতো।
…………………………………………..
বইয়ের নাম : দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ও বাংলার কৃষক
লেখক : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ : তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ
লেখক : শতঞ্জীব রাহা
প্রচ্ছদ : তিস্তান
মুদ্রিত মূল্য : ২৫০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ