সময় ভ্রমণে দার্জিলিঙ : পাহাড় ও সমতল। পর্ব ২১। লিখছেন সৌমিত্র ঘোষ
পাঁচ
মোদ্দা বিষয়, ব্রিটিশ শাসকরা চাইছিলেন ‘ইউরেশিয় সমস্যা’র সমাধান। অথচ, সেই সমাধানের মধ্যেই একাধিক সমস্যা ঢুকে ছিলো। ঔপনিবেশিক সায়েবদের মানবপ্রেম ও সমাজকল্যাণের যে প্রকল্পের কথাই ভাবা যাক, একদিকে সাম্রাজ্যবাদ, অন্যদিকে চোরা ও প্রকাশ্য বর্ণবাদ সে প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রিত করেছে প্রথমাবধি। একটা চালু সায়েবি প্রবাদ আছে না, পুরোনো পাপের লম্বা ছায়া, ওল্ড সিনস কাস্ট লঙ শ্যাডোজ, আদি সায়েবি উপনিবেশ ও আধা-উপনিবেশে ভরা এই পৃথিবীতে সেই ছায়া, ছায়াবৃত বিভিন্ন ছোটবড়ো রোগামোটা পাপ আজ অবধি কিলবিল করছে। কানাডার কথা ভাবুন। সেখানকার নেটিভ বাসিন্দাদের বাচ্চাদের ধরে পাকড়ে সরকারি ইস্কুলে ভর্তি করা হচ্ছে, সে ইস্কুলে তাদের নিজেদের ভাষা, গল্প, জাতি, ইতিহাস, গানবাজনা সব বারণ, ঠেসেঠুসে চেপেচুপে সায়েবি ভাবনা তাদের আকন্ঠ গিলতে বাধ্য করা হচ্ছে, চেনা বাইরের জগৎ অর্থাৎ আত্মীয় পরিজন স্বজন ইত্যাদি থেকে জবরদস্তি বিচ্ছিন্ন করে রেখে। অসুখ বিসুখে বাচ্চারা মরে গেলে বাড়ির পরিবারের কাছে খবরটি পৌঁছোতো না। উনিশ শতকের শেষ থেকে ১৯৯০ অবধি এই ব্যবস্থা বাহাল, এখনো অবধি ইস্কুলের জমি থেকে শিশুদের মরা শরীর বেরুচ্ছে। কানাডার পুরোনো বাসিন্দাদের করা মামলার ফলে এই সেদিন, ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে সে দেশের সরকার মেনে নেয়, শিশুশিক্ষার ইস্কুলের নামে সাংস্কৃতিক গণহত্যা বা কলচারাল জেনোসাইড চলেছে। ক্ষতিপূরণ বাবদ দু বিলিয়ন মার্কিনি ডলার বরাদ্দ হয়। সাম্প্রতিককালের গল্প, যে কেউ খুঁজে দেখতে পারেন, পৃথিবী জুড়ে মেলা হাল্লা হয়েছে এ নিয়ে। কালিম্পং-এর গ্রাহাম সায়েব এবং তাঁর পাহাড়ি ইস্কুলের ছায়াভেজা মাটিতে সমতুল অবিচার ও পাপ জমা হয়ে আছে, অদ্যাবধি এ অপবাদ কেউ দেননি, কিন্তু জবরদস্তি সাদা বানানোর(কেতাবি ভাষায়, উপনিবেশিকরণ বা কোলোনাইজেশান), সে উদ্দেশ্যে ‘শুদ্ধ’ য়ুরোপীয় মতে শিক্ষাদানের গোটা ব্যাপারটাই সমূহ গোলমেলে ছিলো, সন্দেহ নেই।
মিজুতানি ও লিডিয়া মর্ডক দেখাচ্ছেন, স্কটল্যান্ড থেকে যে সব গরীব শিশুদের উপনিবেশচালান করা হয়, তাদের সঙ্গে গ্রাহামের হোম থেকে যাওয়া ইউরেশিয় ছানাদের মূলভূত পার্থক্য ছিলো, অন্তত বিলেত কিম্বা বিলিতি উপনিবেশকর্তাদের কাছে। স্কটল্যান্ড থেকে আসা বাচ্চারা গরীব শ্রমজীবী পরিবারের হতে পারে, কিম্বা অনাথ ভিখিরি ভবঘুরে। কিন্তু তাদের রক্তের এবং জন্মের দোষ ছিলো না। ওদিকে, গ্রাহাম তাঁর হোমের বাচ্চাদের সম্যক শিখিয়ে পড়িয়ে ভালো কর্মঠ শ্রমিক বানাতে পারেন, তাদের রক্তের বা জন্মের দোষ কাটাতে পারেন না। যাদের জন্মের গভীরে বিভিন্ন নেটিভ(অর্থে ভারতীয়) নোংরা জমে আছে, তারা সায়েব হতে পারে না। শিক্ষক হিসেবে গ্রাহাম রক্তে বা জন্মে নয়, পরিবেশে বিশ্বাস করতেন। যে সায়েবসমাজে তিনি তাঁর ছাত্রদের পাঠাতে চাইছিলেন, তার বিশ্বাস ছিলো অন্যরকম, তদনুযায়ী, সায়েব হয়ে জন্মাতে হয়, সায়েব হওয়া যায় না, (যেমন, বামুন হওয়াও যায় না, গ্রহতারা কর্মফল এসবের ব্যাপার থাকে)। ফলে, গ্রাহামের আন্তরিক চেষ্টা সত্বেও, তাঁর প্রকল্প পুরো সফল হলো না। দিশি মেয়েদের কাছ থেকে, বস্তির দুর্গন্ধ অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ইউরেশিয় বাচ্চাদের কালিম্পং পাঠানো হলো, তাদের শিক্ষাদীক্ষার কাজে কোন কার্পণ্য বা অবহেলা করা হলো না। কিন্তু, এখানে থামলে তো চলবে না। ভারত বা ওইজাতীয় অ-শ্বেত সমাজ থেকে দূরে বহু দূরে, তাদের পাঠাতে হবে দেশের চৌহদ্দির বাইরে, বিলেতে না হোক, অন্য কোথাও, আদত য়ুরোপীয় উপনিবেশে।
হোমের ইউরেশিয় আবাসিকদের মধ্যে ঠিক কতজন কোন কোন উপনিবেশে থিতু হয়েছিলো, যথাযথ হিসেব নেই। আমৃত্যু গ্রাহাম চেষ্টা চালিয়ে গেছেন, যাতে তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা উপনিবেশে যেতে পারে। হোম থেকে প্রথম দলটা নিউজিল্যান্ডে পৌঁছোয় ১৯০৭-এ, সেই থেকে প্রতি বছর এই স্থানান্তর অব্যাহত থাকে। অথচ, ১৯০৬ থেকে চেষ্টা চালিয়েও, হোমের আবাসিকদের অষ্ট্রেলিয়া পাঠানো যায় না, ১৯১২ নাগাদ ও দেশের সরকার সরাসরি বলে দেয়, অ-শ্বেতদের ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ১৯৩৭ সালে, সাদা অস্ট্রেলিয়া নীতির বিরোধিতা গ্রাহাম করছেন খোদ অস্ট্রেলিয়া গিয়ে। স্কটল্যান্ডের জাতীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত অপ্রকাশিত ডায়েরির পাণ্ডুলিপি থেকে অ্যান্ড্রু মে উদ্ধৃত করেছেন গ্রাহামের কথা:
১৯০৯ সনে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী গ্রুম সাহেব ও তাঁহার সচিবের সহিত সাক্ষাতের কথা মনে পড়িলো। উহাদের মত ছিলো, যে ইউরেশিয়রা (অস্ট্রেলিয়া) আসিবার জন্য আবেদন করিয়াছে, উহাদের (শরীরে) যদি শতকরা ৫০ ভাগ য়ুরোপীয় রক্ত থাকে, উহাদিগে লওয়া যাইতে পারে…পরবর্তী অনুসন্ধানে আমাদের বলা হইলো, অন্তত ৭৫ ভাগ লাগিবে। মেঞ্জিস(অস্ট্রেলিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল) বলিলেন, এখন ওই হিসাবটি একশত ভাগ!
আর একটি পাণ্ডুলিপি উদ্ধৃত করে অ্যান্ড্রু বলছেন, জীবনের শেষপ্রান্তে পৌঁছে গ্রাহাম বুঝেছিলেন বর্ণবাদ একটি সামাজিক ব্যাধি, বিভিন্ন জাতির মধ্যে মেলামেশা এবং তথাকথিত ‘বর্ণসঙ্করতা’ আসলে দুর্বলতা নয়, শক্তির পরিচয়:
বিশুদ্ধ জাত বলিয়া কিছু হয় না। প্রতি জাতের কিছু না কিছু দিবার থাকে, যাহা নিজের পরিবেশ হইতে সে আহরণ করে। অতীতে ভারতবর্ষ বহু ভিন্ন ভিন্ন জাতের রক্ত ও সংস্কৃতি গ্রহণ করিয়াছে, যদ্বারা সে আরো ধনী হইয়াছে।
অ্যান্ড্রুর মন্তব্য, হোমের আবাসিকদের যে বাস্তব দুনিয়ায় গিয়ে পড়তে হলো, তার সঙ্গে গ্রাহাম-কল্পিত আদর্শ ‘বর্ণান্ধ’ দুনিয়ার বিস্তর ফারাক। স্কটল্যান্ডের মহাফেজখানায় রাখা অসংখ্য চিঠিপত্রের উল্লেখ করছেন অ্যান্ড্রু। মুখ্যত হোমের প্রশাসক জেমস পার্ডি-কে লেখা এই সব চিঠির মূল সুর, পত্রলেখকদের এমন শংসাপত্র দেওয়া হোক, যেখানে তাদের য়ুরোপীয় বাপমায়ের উল্লেখ থাকে বেশি। নাম না করে, বিভিন্ন আর্তির টুকরো জুড়ে জুড়ে একটি ছোট বয়ান তুলে দিয়েছেন অ্যান্ড্রু। হোম নিয়ে আমাদের গল্পের ক্ষেত্রে সে বয়ান বিশেষ কাজে লাগবে।
(ক্রমশ)