অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামীর ‘হাফ প্যাডেলের কাল’। পড়লেন প্রদীপ রায়গুপ্ত

0
আমি সাইকেল চালাতে শিখেছিলাম ক্লাস টেনে উঠে। তখন সাইকেলে উঠে বসলে আমার পা মাটি ছোঁয়। কাজেই আমার কোনও হাফ প্যাডেলের কাল ছিল না। কিন্তু ওই বয়সটা তো আমারও ছিল একসময়ে। ছিমছাম এক গোছানো মফস্‌সল শহরে শৈশব-কৈশোর কাটানো মানুষ আমি, প্রথম থেকে শেষ অবধি একই স্কুলে পড়েছি, স্কুল-স্কুলান্তর করতে হয়নি, আমার অভিজ্ঞতায় গ্ৰামজীবনও প্রায় অনুপস্থিত। তাই আমার সমবয়সী ও সমসাময়িক এক গ্ৰাম্য বালকের বৈচিত্র্যপূর্ণ ‘হাফ প্যাডেলের কাল’ পড়ে উঠলাম এক গভীর মুগ্ধতায়। একটি বালকের ক্লাস ফাইভ থেকে ক্লাস টেন অবধি পাঁচ-ছ বছরের জীবনকালের একটানা কালানুক্রমিক স্মৃতি — এবং সেটাও উত্তম পুরুষে লেখা নয়, প্রথম পুরুষে লেখা— আমার চোখে ঝলমল করে উঠল তার সামগ্র্যের বিভা নিয়ে। স্মৃতিকথা নয়, যেন একটি ট্র্যাজিক উপন্যাস শেষ করে উঠলাম এইমাত্র, দশ মিনিট আগে।
মেহগনি কাঠের মতো গায়ের রঙ, বংশানুক্রমে কয়েক হাজার শিষ্যের দীক্ষাগুরু, সংস্কৃতজ্ঞ যুবক রঘুনাথ গোস্বামীর বিয়ে হয়েছিল অসামান্যা রূপসী জমিদার-তনয়া গোপেশ্বরীর সঙ্গে। ব্যক্তিত্বসম্পন্না, কর্তৃত্বময়ী ও রক্ষণশীলা গোপেশ্বরী সংসারটিকে আগলে রেখেছিলেন, তৃতীয় প্রজন্মের কাছে তিনি দিদিগোঁসাই। তাঁর পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিন ছেলের কথা বইয়ে পাই। জ্যেষ্ঠপুত্র রামব্রহ্ম যৌবনেই বজ্রপাতে মারা যান। তিনটি মৃত সন্তান প্রসব করার পর পাঁচ বছরের একটি পুত্রসন্তান নিয়ে তাঁর স্ত্রী যখন বিধবা হলেন তখন তাঁর চব্বিশ বছর বয়স। ইনি দেবরদের ছেলেমেয়েদের কাছে পরে ‘ছা’ ডাকে অভিহিত হবেন। তবে রামব্রহ্মের পুত্র হরিশঙ্কর তাঁদের প্রজন্মের বড় ছেলে হলেন না, কারণ তার আগেই গোপেশ্বরীর মধ্যম পুত্র রামপ্রসন্নর ঘরে ছেলে জন্মেছে। এঁর নাম চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখর লেখাপড়া বেশি করেননি, পলিটিক্স করে বেড়ান। হরিশঙ্কর ম্যাট্রিক পাস করে সংস্কৃতের আদ্য-মধ্য-অন্ত পড়ে কৌলিক বৃত্তি গুরুগিরি শুরু করলেন। আশপাশের গ্ৰামগুলিতে তাঁর প্রবল প্রতিপত্তি। এই প্রজন্মের তৃতীয় ও চতুর্থ ভাই হলেন পরিবারের দুই রত্ন। তৃতীয় জন গৌরীশঙ্কর গোপেশ্বরীর কনিষ্ঠ পুত্র রামনিধির বড় ছেলে, আর চতুর্থ জন হিমাংশুশেখর রামপ্রসন্নের দ্বিতীয় পুত্র। এঁরা দুজনেই ডিস্টিংশনে বিএসসি পাশ করে প্রথমে স্কুলশিক্ষকের কাজ নিয়ে গ্ৰামান্তরে যান, পরে গৌরীশঙ্কর নন্দীগ্ৰামে কলেজের অধ্যাপক হন, আর হিমাংশুশেখর ডিভিসিতে চাকরি নিয়ে সংসার পাতেন দুর্গাপুরে।
দশ বছরের বালক তার প্রজন্মে কনিষ্ঠ, তার আট দাদা, ছয় দিদি। চার দাদার কথা আগেই বলেছি। বাকি চার দাদার কথা খুব বেশি নেই বইয়ে। পঞ্চম সম্ভবত অহিভূষণ, তিনি কাকা রামনিধির মেজো ছেলে। রামনিধির আরও দুই ছেলের নাম অমরশঙ্কর ও দুর্গাশঙ্কর, তারা গড়বেতা স্কুলে পড়ে। দুর্গাশঙ্কর পরে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়। বাকি রইল বালকের সহোদর দাদা সুধাংশুশেখর ওরফে খোকন, যার পড়াশোনায় মন নেই। দিদিদের মধ্যে দুজন খুড়তুতো, চারজন সহোদরা। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বড় সরযূবালা ও সবচেয়ে ছোট সবিতা ছাড়া আর কারও কথা বইয়ে আছে কি না মনে করতে পারছি না।
সেকালের গ্ৰামীণ যৌথপরিবারের অসাধারণ সব চিত্র আছে বইটিতে। বড়ভাই উপার্জনক্ষম হলে তাকেই নিতে হবে সহোদর অনুজদের শিক্ষার দায়। গৌরীশঙ্কর গড়বেতায় টাকা পাঠান অমরশঙ্কর ও দুর্গাশঙ্করের পড়া ও মেসের খরচ চালাতে। আর বালককে হিমাংশুশেখর নিয়ে যান দুর্গাপুরে, সেখানে ভিরিঙ্গি স্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি করেন তাকে। পঁচিশ বছরের স্বাস্থ্যবান যুবকের আছে তরুণী স্ত্রী, যাঁর নাম আশালতা, ও কয়েক মাসের এক শিশুকন্যা। দুর্গাপুরে এক কামরার কোয়ার্টার্সে তাঁদের সংসার। সেখানে দশ বছরের অনুজকে নিয়ে যাওয়া খুব সহজ কথা নয়। হিমাংশু কিন্তু এ নিয়ে দুবার ভাবেননি। আশালতা প্রথমে একটু মনঃক্ষুণ্ণ হলেও খুব তাড়াতাড়ি বালকদেবরের প্রতি প্রসন্ন হয়ে উঠলেন। কিছুদিন পরে অবশ্য দু-কামরার একটি কোয়ার্টার্স জুটল। এ-পরিবারে বাবা, কাকা, দাদাদের সবাইকেই পদবির কারণে গোস্বামীবাবু বলা চলে, কিন্তু এই বইয়ের একমাত্র গোস্বামীবাবু হিমাংশুশেখর। দুর্গাপুরে তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে ওই নামে ডাকে। বালকের মনোজগতেও তিনিই গোস্বামীবাবু। ছোটভাইয়ের পড়াশোনা নিয়ে তাঁর উদ্বেগ ও চিন্তা, ভাইকে ইংরেজি ও অঙ্কে পারদর্শী করে তোলার জন্য অবসর-সময়ে তাঁর অক্লান্ত উৎসাহ ও পরিশ্রম এই বইয়ের যে-কোনও পাঠককে মুগ্ধ করবে। দুর্গাপুরে এসেই দাদার সেনর্যালে সাইকেলে বালক হাফ প্যাডেল করতে করতে সাইকেল চড়া শিখল।
পাড়াগেঁয়ে বালকের কাছে বাইরের পৃথিবী একটু একটু করে ধরা দিচ্ছে, নতুন নতুন পরিস্থিতির সম্মুখীন হচ্ছে সে, নতুন নতুন মানুষের সংস্পর্শে আসছে। দাদার সহকর্মী প্রতিবেশীরা, স্কুলের মাস্টারমশাইরা, ক্লাসের সহপাঠীরা সবাই যেন এক-একটি বিশেষ চরিত্র। নতুন নতুন শব্দ শিখছে সে, নতুন নতুন বিষয় জানছে। তার পর্যবেক্ষণের চোখ অসামান্য। প্রত্যেকটি মানুষের চেহারার বর্ণনা দিচ্ছে সে ছবির মতন, এমন-কি চেহারা দেখে ব্যক্তিত্বের আন্দাজ পর্যন্ত করছে। দাদা-বউদির সংসারে, দাদার অভিভাবকত্বে, পড়াশোনার আনন্দে ভালোই কাটছে তার দিন। ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছে সে, প্রায় একাই, দুর্গাপুর থেকে পশ্চিম মেদিনীপুরের এক গ্ৰামে। সেখানে মা-জেঠির আদরে, নদীতে মাঠে গাছে বন্ধুদের সঙ্গে হুটোপুটি করে সময় কাটছে তার, দাদার দেওয়া হোমটাস্কের কথা মাথায় থাকছে না। তাদের দেশ-গাঁয়ের বাড়ির চমৎকার ছবির মতো বর্ণনা আছে বইয়ে। বাড়ির বর্ণনা প্রসঙ্গে কয়েকটি নতুন শব্দও পেলাম আমি— পিড়া, বাখুলে, হামারচালা। পর্যবেক্ষণের কথা তো আগেই বলেছি, স্মৃতিশক্তির কথাও বলতে হয়। নিজেদের বাড়ির বর্ণনা হয়তো অনেকেই দিতে পারবে, কিন্তু পরবর্তী কালে শ্যামলদের গড়বেতার যে-বাড়িতে বিশেষ এক পরিস্থিতিতে মাসখানেক থাকতে বাধ্য হয়েছিল বালক সে-বাড়ির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ এত বছর পরেও এমন বিস্তারিতভাবে দিতে পারা কম কৃতিত্বের কথা নয়।
সুখ বেশিদিন কপালে সয় না। গোস্বামীবাবুর এক অদ্ভুত অসুখ শুরু হল। কারখানায় একদিন অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হাসপাতালে ভর্তি করতে হল তাঁকে। জ্ঞান ফিরল, কিন্তু রোগনির্ণয় হল না। তারপর থেকে মাঝে মাঝেই হতে লাগল তাঁর ফিটের ব্যামো। আশালতা দিশেহারা। এ-অবস্থায় আর বালক দুর্গাপুরে থেকে পড়াশোনা করে কী করে! তাকে বাড়িতে চলে আসতে হল। দু-মাস পরে সে ক্লাস সিক্সে ভর্তি হল গড়বেতা স্কুলে, থাকার ব্যবস্থা হল কাকার বেয়াই উকিলবাবুর মেসে। সেখানে দুর্গাশঙ্করও থাকে। এখানে এসেও উকিলবাবু, বিভিন্ন মাস্টারমশাই, বিভিন্ন সহপাঠীর কথা সে এমনভাবে স্মৃতিচর্চায় এনেছে যে পড়তে পড়তে মনে হচ্ছিল একটা পুরোনো অ্যালবামের পাতা পরপর উলটে ছবি দেখছি। লাইব্রেরি থেকে লুকিয়ে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ এনে পড়তে গিয়ে উকিলবাবুর হাতে ধরা পড়ে কী নাকালটাই না হতে হয়েছিল! পরে অবশ্য সে চলে গিয়েছিল স্কুলের বোর্ডিঙে। সেখানেও নানা কাণ্ড, নানা অভিজ্ঞতা। নিষিদ্ধ হলুদ-কাগজে-মোড়া বইও সে পড়েছে, ধীরে ধীরে যৌনচেতনার উন্মেষ ঘটছে তার, ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে সমবয়সী এক কিশোরীর সঙ্গে তার দেহ-সংরাগও ঘটেছে। এই অকপটতা খুবই সাহসী ও বিস্ময়কর। কিশোরকালের এক আশ্চর্য দলিল এই বইটি।
আমি আর বিস্তারিত বিবরণে যাব না। গোড়াতেই বলেছি, একটি বালকের আত্মবিকাশের ইতিহাস হয়েও এই স্মৃতিকথা যেন একটি ট্র্যাজিক উপন্যাস। সে-উপন্যাসের নায়ক হিমাংশুশেখর। মেধাবী ছাত্র, ভালো চাকুরে, ক্রীড়াপ্রিয়, ভ্রাতৃবৎসল, কর্তব্যপরায়ণ, যুবজানি ও নিজেও যৌবনদীপ্ত, সুখী হিমাংশুশেখর এ বইয়ের প্রথম এক-তৃতীয়াংশ জুড়ে উজ্জ্বলভাবে বিরাজমান। দ্বিতীয় এক-তৃতীয়াংশে তিনি নেই। শেষের এক-তৃতীয়াংশে আবার তাঁকে দেখি। তাঁর মাথায় টিউমার হয়েছিল, পিজি হাসপাতালে অপারেশন করে সেটিকে বাদ দেওয়া হয়, কিন্তু টিউমারের ধরনটি ছিল খারাপ। চিকিৎসায় শীর্ণ ও ভগ্নস্বাস্থ্য হয়ে, চাকরি খুইয়ে, তিনি গ্ৰামের বাড়িতে সপরিবারে ফিরে এসেছেন। তাঁর মাথার সব চুল উঠে গেছে, দৃষ্টিশক্তি সম্পূর্ণ হারিয়েছেন তিনি, ছুটিতে গড়বেতা থেকে বাড়ি ফিরে বালক তাঁর সেই মূর্তি দেখে মর্মাহত। তবু অন্ধ হিমাংশুশেখর পরম স্নেহে ভাইকে কাছে বসিয়ে মুখে মুখে ট্রিগনোমেট্রি বোঝান। কিন্তু ধীরে ধীরে খারাপ হবে তাঁর অবস্থা, আশালতা চার মাইল দূরের জাগ্ৰত শিবের মন্দিরে দণ্ডি কেটে গিয়ে নিজেকে রক্তাক্ত করে ফিরে এসেও স্বামীকে বাঁচাতে পারবেন না। শেষের দিকের এই পাতাগুলি পড়তে পড়তে চোখের পাতা ভিজে ওঠে।
এই বালকের নাম শ্রীঅর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী। তিনি নিজের নামের বানান ছেলেবেলা থেকে এরকমই লেখেন। তাঁকে আমার জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হয়, আশালতা বাকি জীবন কীভাবে কাটিয়েছেন, বুবুবুড়ি এখন কোথায়, সুধাংশুশেখর-দুর্গাশঙ্কররা কে কোথায় কেমন আছেন। এ-বইয়ের তো দ্বিতীয় একটি পর্বও হতে পারে।

বইয়ের নাম : হাফ প্যাডেলের কাল
লেখক : অর্দ্ধেন্দুশেখর গোস্বামী
প্রচ্ছদ : সুলিপ্ত মণ্ডল
অলংকরণ : অদ্বয় দত্ত
মুদ্রিত মূল্য : ৩৫০ টাকা
প্রকাশক : সুপ্রকাশ

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *