উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ১১। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
ব্রাহ্মবাড়ির ভোজন বিলাস
শ্রাদ্ধবাড়ির নেমন্তন্ন রক্ষা করতে করতে হেদিয়ে গেছি। হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান তিন ধর্মের বাড়িতেই এইসব শ্রাদ্ধ-শান্তির দিনে খাওয়া-দাওয়ার বিষয়টা জানা আছে। কিন্তু জানা ছিল না ব্রাহ্মবাড়ির আচার-অনুষ্ঠান। সে অভিজ্ঞতা হল একদিন। এবং বড় করুণ!
তখন ইত্যাদি প্রকাশনীর নবম-দশম পত্রিকায় আছি। সম্পাদক নীরদ হাজরা। দীর্ঘদেহী মানুষটা ছিলেন ভোজনবিলাসী। অফিসে নিজের খুপরিতে বসে বাটি সাজিয়ে দ্বিপ্রাহরিক ভোজন সারতেন। সেই মানুষটাও যে কী বিব্রত হয়েছিলেন বলার নয়। সেই টুকরো ঘটনাটাই বলা যাক।
একদিন খবর পাওয়া গেল লেখিকা লীলা মজুমদার দেহ রেখেছেন। নীরদবাবু তাঁর পূর্ব পরিচিত, শিশু সাহিত্যিক কার্তিক ঘোষও। নীরদবাবু আর কার্তিকদা গেলেন লীলা মজুমদারের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে। এগিয়ে এলো শ্রাদ্ধের দিন। নীরদ বাবু বোধহয় নিজের ভিতরে দিন গুনতেন। একদিন পারলৌকিক ক্রিয়ার আমন্ত্রণ এলো। নীরদবাবু আর কার্তিকদা তো যাবেনই। আর কেউ যেতে চায় কি না জিজ্ঞাসা করতেই রাজি হয়ে গেলাম। ব্রাহ্মবাড়ির শ্রাদ্ধ তো দেখিনি কোনদিন।
নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে যাওয়া হল। বহু মানুষের সমাগম। উপাসনা চলছে। আমরা একপাশে আসন পেলাম। শান্ত, বিষাদদীর্ণ পরিবেশ। সবই চলে নিয়ম মতে। শেষ হল উপাসনা। কয়েকজন সুবেশী পুরুষ-মহিলা হাসি মুখে কয়েক থালা সন্দেশ নিয়ে এলেন। সঙ্গে জলের গ্লাস। সকলেই একটা করে সন্দেশ তুলে নিচ্ছে। দু’ তিন রকমের সন্দেশ এলো ঘুরেফিরে। সন্দেশ আর জল পান করে বসে আছি। ক্রমশ উপাসনা স্থল ফাঁকা হচ্ছে। আমরা বসেই আছি, কখন দ্বিপ্রাহরিক ভোজনের ডাক পড়বে। শ্রাদ্ধ বাড়িতে দুপুরে খাওয়াবে না, তা কি হয় !
সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। ডাক পাচ্ছিনে। ভিতরে ভিতরে অধৈর্য আমরা। নীরদবাবু মুখ খুললেন, ও কার্তিক একবার দ্যাখো তো, কতদূর কি হল। কিছুই তো বুঝতে পারছিনে।
কার্তিকদা উঠে ভিতরে গেলেন। কিছুক্ষণ পর ঘুরে এসে বললেন, চলুন বাইরে গিয়ে বলছি।
রাস্তায় বেরিয়ে কার্তিকদা জানালেন, ওই সন্দেশেই শেষ। হিন্দুদের মতো ব্রাহ্মদের খাওয়ানোর কোনও পাট নেই। ওদের উপাসনাটাই আসল।
পেটে ছুঁচোয় ডন দিচ্ছে। শেষ পর্যন্ত একটি হোটেলে ঢুকে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে তবে তৃপ্তি। এই অভিজ্ঞতা দশক-দশক ধরে স্মৃতিতে আছে। আর এই অভিজ্ঞতা পরে অন্য অভিজ্ঞতার সঙ্গে কাটাকুটি খেলেছিল। তিনিও ব্রাহ্ম ছিলেন। উচ্চতা তেমন ছিল না। ফর্সা। এক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ছিলেন ইংরেজি ভাষার। বামপন্থী এই ভদ্রলোক এক সময়ে গল্প লিখতেন। পরিচয়, নন্দন পত্রিকায় কয়েকটি গল্প ছাপা হয়েছিল। একটা গল্পের বইও তিনি বের করেছিলেন ষাটের দশকে। অনুবাদ করতেন। মৃদুভাষী, সজ্জন এই মানুষটির প্রয়াণ সংবাদ পাওয়া গেল একদিন। পেলাম পারলৌকিক অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণও। দক্ষিণ কলকাতার একটি মঠে আয়োজিত হয়েছিল সেই অনুষ্ঠান। হাজির হয়ে দেখি হিন্দু মতে শ্রদ্ধানুষ্ঠান চলছে। মনে পড়ল রবীন্দ্রনাথের কথা, তিনি চেয়েছিলেন যেন হিন্দু মতে তাঁর শ্রাদ্ধাদি হয়। ব্রাহ্মধর্মাবলম্বী হলেও অধ্যাপক হয়তো তেমন ইচ্ছাই প্রকাশ করেছিলেন। আর একেশ্বরবাদী ব্রাহ্মরা তো হিন্দুধর্মের ভিতরেই গড়ে ওঠা একটা মতবাদ। মৃত্যুর পর যেমন তাদের দাহ করা হয়, তেমনই শ্রাদ্ধকর্ম-করতে বাধা কোথায়। সম্ভবত তারা হিন্দুধর্মের জটিলতা থেকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন পারলৌকিক ক্রিয়াকে। লীলা মজুমদারের মৃত্যু এবং এই অধ্যাপকের মৃত্যুর মধ্যে ব্যবধান ছিল প্রায় কুড়ি বছর। কিন্তু তাতে কি নিয়ম বা মতের বদল হয়? হয় না তো। কিন্তু ব্রাহ্ম ধর্মের এই দুই নিয়ম আমাকে বেশ ধন্দে ফেলেছিল। প্রথমবার ভোজনের প্রস্তুতি নিয়ে গিয়ে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে সন্দেশের স্বাদ গ্রহণ করে, দ্বিতীয়বার পেট ভর্তি করে গিয়ে ফিরেছিলেম একবাক্স খাবার নিয়ে। আসলে মঠে বসিয়ে খাওয়ার নিয়ম নেই। তাই অভ্যাগতদের হাতে খাবার প্যাকেটজাত করে তুলে দিতে হয়।
এই দুই নিয়মের ঠেলাঠেলিতে এই বয়সেও ধন্দে আছি, আবার যদি কোনও ব্রাহ্ম পরিবার থেকে নিমন্ত্রণ আসে, তাহলে তৃতীয় কোনও অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবো না তো !
তবে ব্রাহ্মবাড়িতে যে অতিথিকে সন্দেশ দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়, এটা আরও একবার টের পেয়েছিলাম বিশ্বখ্যাত চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের বাড়িতে। সে আরেক গল্প।
(ক্রমশ)