উড়নচণ্ডীর পাঁচালি। পর্ব ৮। লিখছেন সমরেন্দ্র মণ্ডল
শহরের পথে নুড়ির খোঁজে
ওই দ্যাখো, কখন যে ঘুরতে ঘুরতে আবার কেষ্টনগরে চলে এলাম, কে জানে। আর হবে নাই বা কেন, ছড়ানো ছেটানো জীবনের আদ্ধেকটাই তো এই শহরময়। তাই তো অবসর চুরি করে পা মেলাতে হয় এই শহরের পথে। এমনি ভাবেই হাজির হলেম এক বিকেলে রবীন্দ্র ভবনের দরজায়। না, ভিতরে নয় বাহিরে। আমাদের বন্ধু শ্যামা, মানে রামানন্দ সেন নামে যে কবিতা লেখে, ওখানে একটা চায়ের দোকান দিয়েছিল। দোকানের সামনে টেবিল-চেয়ার। ফাঁকা। ওখানেই বসে শ্যামার সঙ্গে গপ্প করছি। ভিতরে কী একটা অনুষ্ঠান হচ্ছে। শুনছি আর ভাবছি, এই রবীন্দ্রভবন থেকেই তো নাটকের সঙ্গে আমার গাঁঠবন্ধন। এবার তাহলে সেসব কথাই দু’পাত্তর বলে দেওয়া যাক।
সেও ছিল এমনি বিকেল। সদ্য গোঁফ গজানো বয়েস। ইস্কুল পাশ করে বাবার তারণায় স্থানীয় কারিগরী মহাবিদ্যালয়ে নাম লিখিয়েছি। পায়ে তখন ফুটবল, কলমে কবিতা। যখন তখন মন খারাপের বয়স। আর ওই বয়সেই এক ফিনফিনে বিকেলে, বোধ হয় রোববার ছিল সেদিন, হাঁটতে হাঁটতে রবীন্দ্র ভবনের সামনে। দরজা হাঁ। দু’ একজন ঢুকছে-বোরচ্ছে। নিছক কৌতূহলে ভিতরে প্রবেশ। মঞ্চে নাটক চলছে। সারি সারি শুন্য চেয়ার ডাকছে – আয়, আয়। অন্ধকারের মধ্যেই বসে পড়লুম একটা আসন দখল করে। কাদের নাটক, কারা অভিনয় করছেন, সেসব জানিনে। জানার কথাও নয়। তবে বেশ লাগছিল। অনেক, অনেক পরে এইসব কুশীলবদের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। সুনীল সরকার, হরিপদ দে, মলয় সরকার…। এঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন লেখক। সুনীলবাবু, মলয়বাবু তো তখনকার দৈনিক কাগজের সঙ্গে থাকা এক পাতার ছোটদের আনন্দমেলা বা ছোটদের পাততাড়িতে লিখতেন। হরিদা কবি হিসেবে যথেষ্ট পরিচিতি পেয়েছিলেন। নিয়মিত অভিনয় করতেন বিভিন্ন দলে।
স্কুলের বয়সে নাটকের সঙ্গে যে পরিচয়টা হয়ে গিয়েছিল এবং সেটা বোধহয় ফুটবল মাঠ চাপা দিয়ে রাখতে পারেনি। একটা অচেনা দলের নাটক দেখার পর, বোধহয় রবীন্দ্রভবন নামটার গুণেই ভিতরে লাথালাথি শুরু করল। অবরে সবরে চলে আসি এখানে। খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে যাই। একটা আসন দখল করে বসে থাকি। কাদের নাটক, কারা করছেন – জানা নেই। শুধু দেখি। রস গিলি। আমার মতো অনেকেই এভাবে নাটকে দেখতেন।
এভাবেই একদিন দেখে ফেললাম ‘নীচের মহল’। এই প্রথম দেখলাম প্রায় সব আসনেই দর্শক বসে আছেন। বাইরে নাটকের নাম টাঙানো। জানলাম, ‘কৃষ্টি সংসদ’ এই ‘নীচের মহল’ করছে। পরিচালক সুনির্মল সমাদ্দার।
তখনও কৃষ্ণনগরের লেখক-শিল্পীদের আড্ডায় ঢুকিনি। কিংবা তাদের আড্ডার ঠেক জজ কোর্টের মোড়ে লেখরাজার চায়ের দোকানে পা পড়েনি। সে আরও পরের কথা। কিন্তু ‘নীচের মহল’ দেখার পর কেমন একটা নাটক নাটক ভাব মনের মধ্যে জেগে উঠল। ওই জেগে ওঠাই সার। একদিকে কলেজ, অন্যদিকে ফুটবল মাঠ। সে মাঠও গেল একদিন হারিয়ে। বিদ্রোহ চারিদিকে, বিদ্রোহ। সত্তর দশক মুক্তির দশকের হাতছানিতে সব এলোমেলো করে দিল। কিভাবে যেন ফুটবল মাঠ ছেড়ে মিছিলের মাঠে চলে এলাম। এরই মধ্যে নমো নমো করে পড়াশুনোর পাট চুকলো। চাকরির আবেদন লিখি আর আশায় আশায় দিনগুনি। সে সবও গেল ঘর ছাড়া হয়ে। সেসব বৃত্তান্ত এখন নয়, পরে। এখন বরং সমাদ্দারদার কথাই বলি।
বছর দুয়েকের মধ্যে যখন লেখরাজদের দোকানে পা পড়ল, তখন কৃষ্টি সংসদ রমরম করছে। তাদের নাটক বেশ লোক টানে। দলের নাট্যগুরু সুনির্মল সমাদ্দার বেশ মানী লোক। তিনিও এই দোকানে আসেন, বসেন, দু-পাত্তর চা নিয়ে অন্য সদস্যদের সঙ্গে নাটক সম্পর্কিত আলোচনা করে, সাইকেল নিয়ে উধাও হয়ে যান। দীর্ঘকায় এই মানুষটি ধুতি আর শার্ট পরতেন। অবিবাহিত। পুরসভার কর বিভাগের কর্মী। বাড়ি বাড়ি গিয়ে কর আদায় করাই ছিল কাজ। সাধারণত রোববার ছুটির দিনে জর্জ কোর্টের মাঠে কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে চলত আড্ডা। কান পাতলে বোঝা যেতো, আড্ডায় নাটক ছাড়া আর কোনও বিষয় ছিল না। মাঝে মধ্যে ঢুকে পড়ত রাজনীতি। সমাদ্দারদার কথা শুনে বা নাটক নির্বাচন দেখে বেশ বোঝা যেত তিনি ছিলেন অঘোষিত বামপন্থী। আর তাঁর সঙ্গীদের কেউ কাশীকান্ত পন্থী, কেউ কংগ্রেস মনস্ক আবার কেউ কম্যুনিষ্ট মতাদর্শে বিশ্বাসী। কৃষ্টিসংসদের সম্পাদক বাচ্চুদা মানে নীহার বিশ্বাস, যিনি কোনও দিন মঞ্চে ওঠেননি, অভিনয়ের কোনও বাসনাই ছিল না, ছিল শুধু সংগঠনকে মজবুত করার অদম্য প্রয়াস, তিনি ছিলেন ঘোষিত বামপন্থী। বোধহয় সেকারণেই সমাদ্দারদা-বাচ্চুদা জুটি আগ্নেয়গিরি, বাইকেল, কল্লোল, নীল রক্ত ফেরারী ফৌজ, দানব এবং ইন্দ্রজিৎ, অঙ্গার এইসব নাটকের দিকে একটু বেশি নজর দিয়েছিলেন। সুনির্মল সমাদ্দার আলো, মঞ্চসজ্জা, অভিনয় সব একত্রিত করে এমন একটা মাত্রায় নাটককে নিয়ে যেতেন যে, বড় প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলের সঙ্গে সমানে পাল্লা দিতে পারত। তিনি জাঁক জমক পছন্দ করতেন নাটকে। ছিলেন উৎপল দত্তীয় ঘরানার মানুষ।
সমাদ্দারদার কাছেই শোনা, তিনি একদা কলকাতার টালিগঞ্জ অঞ্চলে থাকতেন। স্টুডিও পাড়ার গা ঘেঁসে। তার কাছেই পেতাম সিনেমা পাড়ার টুকরো কথা, তার অবস্থানকালীন সময়ের। মানুষটা নাটক সর্বস্ব ছিলেন। নাটকের সঙ্গে কোনও রকম সমঝোতা করতে রাজি ছিলেন না। বোধহয় সেই কারণেই দলে ক্রমশ মতভেদ বাড়তে লাগল। তিনি বেশ কয়েকজন অনুগামীকে নিয়ে দল ছাড়লেন। শহরের নাট্যমহলে সুনির্মল সমাদ্দারের দলত্যাগ আলোচনার একটা বিষয় হয়ে ওঠে। শোনা গিয়েছিল, দলের বেশ কিছু সদস্য শঙ্করের ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের নাট্যরূপ মঞ্চস্থ করবে। থাকবে ক্যাবারে। সমাদ্দাররা রাজি হননি। তিনি নিজের হাতে তৈরি করা দল ছাড়লেন। মনে পড়ে, দলের মধ্যে মত বিভেদের কারণেই একদিন শম্ভু মিত্র হাতে গড়া বহুরূপী ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিলেন। কন্যা শাঁওলিকে নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘পঞ্চম বৈদিক’। বাংলা নাট্যমঞ্চের গর্বিত অভিনেত্রী তৃপ্তি মিত্রও দল ছেড়ে এসে গড়ে ছিলেন ‘আরব্ধ নাট্য নিকেতন’। একদিন অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায় ‘নান্দীকার’ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গড়েছিলেন ‘নান্দীমুখ’। সমাদ্দারদাও গড়লেন নতুন দল ‘লিটল থিয়েটার অকাদেমি’। নতুন নাটক নির্বাচন করা হল। সত্তর দশকের সাড়া জাগানো নাটক ‘ইতিহাস কাঁদে’। রাধারমণ ঘোষের এই নাটক সারা বাংলায় অভিনীত হচ্ছিল। গ্রুপ থিয়েটারে সাদামাটা মঞ্চে অভিনয়োপযোগী এ নাটককে সমাদ্দারদা আলোক বিন্যাসে জাঁক এনে দিলেন। এই একটি নাটকই তিনি করেছিলেন। তারপর আবার ফিরে গিয়েছিলেন পুরনো দলে। তবে বেশিদিন আর সেখানে থাকেননি তিনি। শুনেছিলাম দলের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে তিনি স্বেচ্ছানির্বাসন নিয়েছিলেন নাটক থেকে।
সমাদ্দারদা অভিনয় করতেন কম। পরিচালনাতেই তিনি ছিলেন সচ্ছন্দ। তবে তিনি একবার যিশুর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। কৃষ্ণনগর ক্যাথলিক চার্চে, যাকে বলা হয় কৃষ্ণনগর ক্যাথেড্রাল, সেখানে প্রতিবছর ইস্টারের সময় ‘মানবত্রাতা’ নামে একটি প্যাশন প্লে অভিনীত হয়। চার্চেরই সদস্য শিক্ষক এবং লেখক রবীন বিশ্বাস এই নাটকটা লিখেছিলেন। গির্জার সামনের চাতাল, মাঠ, তার দু’পাশের জায়গা, সামনের লালদিঘীর পাড় সবটা জুড়ে অভিনয় হতো। ব্যবহার করা হত গির্জার ছাদও। সে এক এলাহী কাণ্ড। আগে সমস্ত নাটকটা রেকর্ডিং করে নেওয়া হয়, তারপর কুশীলবরা শব্দ অনুসরণে অভিনয় করে যান। দীর্ঘ কয়েক মাসের অনুশীলনে এই অসম্ভবকে সম্ভব করা হয়। নাটকের নির্দেশকও ছিলেন রবীন বিশ্বাস। তা একবার ঠিক হল শহরের বিশিষ্ট অভিনেতাদের নেওয়া হবে। সেবার বোধহয় নির্দেশনার কাজটা করেছিলেন সমরেন্দ্র লরেন্স বিশ্বাস। তিনি কৃষ্টি সংসদে অভিনয় করতেন, আবহ করতেন, মঞ্চ করতেন। তিনিই সমাদ্দারকে রাজি করালেন যিশু করতে। অপূর্ব অভিনয়। অবশ্য আগে যারা যিশু করতেন তারা একটু সমালোচনা করেছিলেন, সম্ভবত তারা সুযোগ পাননি বলে।
যা হোক, সমাদ্দারদা ছিলেন মনের দিক থেকে নির্মেদ। ভালবাসতেন আড্ডা দিতে। এমন একটা মানুষের শেষ জীবনটা নাকি খুব দুঃখে কেটেছে। নিঃসঙ্গ অবস্থায়।
সুনির্মল সমাদ্দার আবার কৃষ্টি সংসদে প্রত্যাবর্তনের সময়েই শহরে আরেকটা নাট্যদল মাথা তুলে দাঁড়ালো। নাট্যচক্র। নেতৃত্বে গৌরাঙ্গ দে। তিনি বিদ্যুৎ পর্ষদে চাকরি করতেন। হুগলির মানুষ। চাকরি এবং বিবাহ সূত্রে কৃষ্ণনগরের বাসিন্দা। বিদ্যুৎ পর্ষদে নাটক পরিচালনা করতে গিয়েই কয়েকজন নাট্যপ্রিয়কে পেলেন। তাদের নিয়েই শুরু হয়েছিল নাট্যচক্র। সঙ্গে ছিল নিশু মিত্তির বা নৃসিংহ মিত্র নামে এক যুবক। সুনির্মল সমাদ্দার কৃষ্টি সংসদে ফিরে গেলেও কয়েকজন বাইরে রয়ে গেলেন। তারা যোগ দিলেন নাট্যচক্রে। ছোট দল, নতুন দল। ভাবনা-চিন্তাও গ্রুপ থিয়েটারধর্মী। মিঠুদা মানে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়, সুবীর সিংহ রায় চলে গেল নাট্যচক্রে। সঙ্গে এই উড়নচণ্ডীও ভিড়ল। নাটকের খোলা আকাশ। নাটক পড়ো, নাটক করো। গৌরাঙ্গদা শ্লোগান তৈরি করলেন, ‘নাটক নিয়ে খেলা নয়/ খেলার নাটক কক্ষনো নয়’। শুরু হল সেই ‘ইতিহাস কাঁদে’ দিয়ে। সাদা-মাটা মঞ্চ, মঞ্চে কুশীলবরা মেক-আপ বিহীন, ন্যূনতম আলো, পথ নাটকের আঙ্গিকে অভিনীত হল রবীন্দ্রভবনে। শহরে নাটভাবনার ঝুঁটি ধরে নাড়িয়ে দিল নাট্যচক্র। দল গেল বিভিন্ন প্রতিযোগিতায়। অর্জন করল বেশ কয়েকটি পুরষ্কার। গৌরাঙ্গ দে ছিলেন মূলত কবিতার মানুষ। ‘দেশ’ পত্রিকা যখন কুলীন ছিল, তখন তিনি কবিতা লিখেছেন ওই পত্রিকায়। এবার কলম ধরলেন নাটকের জন্য। লিখলেন ‘অবসন্ন নিষাদ’। রূপকের মধ্যে সত্তর দশকের ফ্যাসিবাদী শক্তির স্বরূপ উন্মোচন। একই সঙ্গে চলল প্রকাশিত নাটকের মঞ্চায়ন। সাতের দশকের দুটি নাট্য পত্রিকা ছিল থিয়েটার দলগুলোর প্রিয়। অভিনয় আর গ্রুপ থিয়েটার। প্রথমটি বামপন্থী, বিশেষত যাদের নকশালবাড়ি পন্থার প্রতি ঝোঁক ছিল, তাদের কাছে ‘অভিনয়’ ছিল প্রিয়। আর গ্রুপ থিয়েটার তো সি পি আই (এম) দলের ছাতার নীচে ছিল। নাট্যচক্র ‘অভিনয়’ পত্রিকার সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধল। ওই পত্রিকায় প্রকাশিত নাটকগুলোই মঞ্চস্থ করা হত। রাধারমণ ঘোষ, অমল রায়, শ্যামলতনু দাশগুপ্তর নাটক মঞ্চস্থ করার দিকেই বেশি মনোযোগ ছিল।
গৌরাঙ্গ দে ছোট নাটক করার পক্ষপাতি ছিলেন। তিনি চাইতেন দেড়ঘন্টার মধ্যে নাটক শেষ করো। শহরে একাঙ্ক নাটক মঞ্চস্থ করার জোয়ার সৃষ্টি করলেন তিনি। উদ্দেশ্য দুটো। এক, একাঙ্ক নাটকের মধ্যে দিয়ে বক্তব্য সরাসরি বলে দেওয়া যায়। ছোটগল্পের মতো। দুই, বিভিন্ন প্রতিযোগিতা মঞ্চে নিয়ে যাওয়া যায়। নাট্যচক্র ভারতের বিভিন্ন জায়গায়, যেমন, নাগপুর, লক্ষ্ণৌ, এলাহাবাদ গিয়েছে নাটক নিয়ে। প্রত্যেক জায়গা থেকে এক বা একাধিক পুরষ্কার নিয়ে ফিরেছে। একবার তো কলকাতার রেল মঞ্চ থেকে এগারোটা পুরষ্কার পেয়েছিল নানা বিভাগে।
গৌরাঙ্গ দা ছিলেন, যা জানতাম, সি পি আইদলের ঘনিষ্ঠ। নিজের হাতে পোস্টার লিখতেন। অন্যদেরও পোস্টার লেখা শেখাতেন। সেই হাতে লেখা পোস্টার নিয়ে মই আর আঠা সহযোগে সদস্যরা শহরের দেওয়াল বিজ্ঞাপিত করত। শিখিয়েছিলেন দলগত কাজ। প্রত্যেকে প্রত্যেকের রূপটান দিয়ে দিত। ছিল দলের মেক-আপ বাক্স। প্রত্যেকেই হাতে হাতে মঞ্চ করত। আর নাটকের ফাঁকে ফাঁকে চলত হালকা করে রাজনীতির আলোচনা। একটা রাজনৈতিক বোধ তৈরি করে দিয়েছিলেন তিনি। সে কারণেই ১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারির মধ্যেই অমল রায়ের বিতর্কিত নাটক ‘লাশ বিপণী’ মঞ্চস্থ করা হয়েছিল। চোখ রাঙানি ছিল, কিন্তু দল থামেনি।
আটের দশকে তিনি উদ্যোগ নিয়েছিলেন বিভিন্ন সমমনস্ক দলের কুশীলবদের নিয়ে সম্মিলিত ভাবে পথ নাটক করার। তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। কেবলমাত্র ‘সংস্কৃতি সংসদ’ উৎসাহ দেখিয়েছিল। টাউন হলের মাঠে অভিনীত হয়েছিল। ‘কলিকালের কড়চা’। সংস্কৃতি সংসদের পরিচালক চন্দন স্যা্ন্যাল ছিলেন কংসের ভূমিকায়। আরও কয়েকটি জায়গায় অভিনীত হয়েছিল। কিন্তু বেশীদিন আর তিনি কৃষ্ণনগরে কাজ করতে পারেননি। বদলি হয়ে চলে এলেন কলকাতায়। বেশ কিছুদিন নেতৃত্বহীন থাকার পর হাল ধরলেন মিঠুদা, মানে সুদীপ চট্টোপাধ্যায়। তিনি নিজে নাটক লিখে যেমন অভিনয় করতেন, একই সঙ্গে পুরানো নাটকগুলোকেও নতুন ভাবনায় উপস্থাপন করতেন। তাকেও কলকাতায় চলে আসতে হয়েছিল। স্বল্পকাল পরেই তিনি প্রয়াত হলেন। গৌরাঙ্গদাও প্রয়াত হয়েছেন বছর দুয়েক আগে। নাটকের কুশীলবরা এখন স্মৃতিযাপন করছে।
ওই যে, একটু আগে যে চন্দনদার কথা বললাম, তার সম্পর্কে দু-চার কথা বলে নেওয়া যাক। কৃষ্ণনগর পোষ্ট অফিসের মোড়ে বিখ্যাত স্যান্যাল বাড়ির সন্তান চন্দনদা। পেশায় ছিলেন ওষুধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধি। আমি মজা করে বলতাম ‘ফিরিওয়ালা’। ওই স্যান্যাল বাড়িতেই ‘সংস্কৃতি সংসদ’-এর মহলা হত। কালো দত্ত, রতন মোদক, নীরদ হাজরাদের কাল পেরিয়ে হাল তখন চন্দনদার হাতে। পেশার কারণেই সময় দিতে পারতেন না। আমাদের সঙ্গে ছিল দাদা-ভাইয়ের সম্পর্ক। চন্দনদার ভাই শুভ্রদার সঙ্গেও সত্তরের দিনগুলোতে ছিল সুসম্পক। শুনেছি তিনি এখন বহরমপুরে থাকেন। একদা বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরা যখন স্কুল পাশ করে কলেজের দরজায় পা রেখেছি, একই সঙ্গে রাজনীতির গন্ধ মাখছি গায়ে, তখনই শুনেছিলাম ছাত্ররাজনীতি করার জন্য শুভ্রদা নাকি কলেজের শেষ পরীক্ষা দিতেন না। তিনি কলকাতার কোনও এক কলেজে পরতেন। ওই বাড়ির কনিষ্ঠপুত্র অমলদা ছিলেন উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। ইংরেজিতে বলে ব্রাইট স্টুডেন্ট। তার সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলাপ তেমন হয়নি। দু-একবার সাক্ষাৎ হয়েছে দলের মধ্যে দাঁড়িয়ে। ছাত্রজীবনে একবার তাদের বাড়িতে এক বৈঠকেও ছিলাম। এখন তিনি থাকেন বিদেশে। এই বাড়ির মেয়ে ছিল ভাস্বতী। ভাল আবৃত্তি করত। শহরে আমরা হইহই করে আবৃত্তি করে বেড়াতাম।
হ্যাঁ, চন্দনদার কথাই বলি। সুদর্শন চন্দনদা বাচনে ছিলেন মধুর। আবার ভিতরে ছিলেন কঠোর। সংস্কৃতিপ্রাণ মানুষ। ছিলেন নাটকের মানুষ। কচি বয়সে কৃষ্ণনগর টাউন হল মাঠে খুব সংস্কৃতি উৎসবে ‘সংস্কৃতি সংসদ’ অভিনয় করেছিল রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’। ওই নাটকে কালো দত্ত সেজেছিলেন ‘রঘুপতি’, রতন মোদক হয়েছিলেন নক্ষত্র রায়। যতদূর মনে হচ্ছে, মানে স্মৃ্তি বলছে চন্দন সান্যাল করেছিলেন জয় সিংহ। ভুল বললাম কি? যারা জানেন, তারা স্মরণ করিয়ে দেবেন। সত্তরের দশকের শুরুতে, যখন নকশাল বাড়ি আন্দোলনের আঁচ শহরে এসে পড়ছে, সেই সময় দেখলাম ‘হাতুড়ি’, ‘চাকা’ নাটক। ‘হাতুড়ি’ নাটকটা লিখেছিলেন দেবদাস আচার্য। দুটি নাটকেই চন্দনদার অনবদ্য অভিনয় দেখেছি। ‘সংস্কৃতি সংসদ’ ক্রমশ ক্ষয়রোগে ধরল। অভিনয়ের সংখ্যা গেল কমে। চন্দনদার অভিনয়ও গেল কমে। সাতের দশকের প্রথম দিকে যখন অপসংস্কৃতিমূলক নাটকের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হল। চন্দনদা ছিলেন প্রথম সারিতে। পরে ‘গ্রাম-গ্রামান্তর’ সাপ্তাহিক সম্পাদনাও করেন কিছুদিন। এখন আর চন্দনদার অভিনয় দেখার সুযোগ নেই, কারণ তিনি নিজেই নেই হয়ে গেছেন। তাদের লালবাড়িও আর নেই, তিনিও নেই। তবে নিমুদা আছেন। ওই সান্যাল বংশেরই সন্তান। সুদর্শন নিমুদা, মানে নির্মল সান্যালও ছিলেন নাটকের মানুষ। বিয়ে করেছিলেন শিখাদিকে। পরে আমাদের শিখা বৌদি। নির্মল সান্যাল-শিখা সান্যাল হয়ে গেলেন নাটকের জুটি। তাদের ‘তাহার নামটি রঞ্জনা’ এখনও চোখ-কানকে তৃপ্তি দেয়। এই জুটি সাধারণত অভিনয় করতেন ‘শিল্পীবাণী’ নামে একটি নাট্যসংস্থায়। এছাড়া অন্যান্য দলেও অভিনয় করতেন। এখনও অভিনয় করে চলেছেন।
শহর কৃষ্ণনগরের নাট্যব্যক্তিত্বের সংখা আঙুলে গোনা যায় না। আর কত বিচিত্র মানুষ তারা। প্রত্যেকেই নিজস্ব ধারা নিয়ে এক একটা চরিত্র হয়ে উঠেছেন। এই অম্বুজ মৌলিকের কথাই ধরা যাক। সত্তর দশকেই তিনি ঠাঁয় নিলেন শহরে। তিনি নাকি উত্তরবঙ্গে চা বাগানের আধিকারিক ছিলেন। শহরে এসেই গড়ে তুললেন ‘শিল্পশ্রী’। ঐতিহাসিক বা পুরনো ধাঁচের নাটকের দিকেই টান ছিল। একটা ব্যবসাও শুরু করেছিলেন। জামাতা বিভূতিভূষণ-পুত্র লেখক তারদাস বন্দ্যোপাধ্যায় তার সম্পর্কে লিখেছিলেন ‘ব্যবসায়ী অথচ সৎ’। মানুষটা এমনই। নাটক খ্যাপা কাউকে পেলেই ব্যবসা ফেলে আড্ডায় জমে যেতেন। কিন্তু মহলা কক্ষে ছিলেন কঠোর মাষ্টারমশাই। ছিলেন শিশির ভাদুড়ীর অনুরাগী।
আবার তুহিন দত্তর কথাই ধরুন। পঞ্চাশ বছরেরও বেশি দলটাকে ধরে রেখেছেন। এক নাগাড়ে মঞ্চস্থ করে চলেছেন একের পর এক নাটক। এক সময়ে শিক্ষকতা করতেন। গড়ে পিঠে নিতেন ছাত্রদের। একই সঙ্গে নাটকের মহলাতে গড়তেন নাট্যকর্মী। তাঁর কাছে অভিনয় শিখেই পরবর্তী সময়ে কতজন পরিচালক হয়েছেন, নিজেদের দল গড়েছেন। আগে যে চিত্রপরিচালক বিষ্ণুর কথা বলেছি, তার হাতে খড়ি তো এই তুহিন দত্তর হাতেই।
এই তো সম্প্রতি নাটকের মঞ্চ ছেড়ে অন্য জগতে অন্য মঞ্চে চলে গেলেন অশোক ভাদুড়ী। দলের নাম ছিল ‘শিল্পীতীর্থ’। নিজে নাটক লিখতেন, পরিচালনা করতেন, অভিনয় করতেন। ছিলেন বামপন্থী মানুষ। পেশায় ছিলেন ইঞ্জিনীয়ার, নেশায় নাটক। তার একটু শ্বাসের দোষ ছিল। মাঝে মাঝে ঘড় ঘড় করত কথা বলার সময়। মাঝে মাঝেই কাঁধের ঝোলা থেকে যন্ত্র বের করে নাকে ওষুধ দিতেন। পরতেন ধুতি-পাঞ্জাবি। কাঁধে থাকত ঝোলা। তাঁর আগে কোনও ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত ইঞ্জিনীয়ারকে দেখিনি, যিনি ওই পোশাকে অফিস করতেন। মাঝে মাঝেই চলে আসতেন পাত্রবাজারে শোভন মুদ্রণীর আড্ডায়। ওই ‘শিল্পীতীর্থ’ দলেই ছিলেন প্রসূন ও গায়ত্রী লাহিড়ী দম্পতি। মতাদর্শে বামপন্থী। দুজনেই বিপ্লবী সমাজতান্ত্রিক দল, মানে আর এস পি-র সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অপূর্ব অভিনয় করতেন। আমরা কাকু-কাকিমা বলে ডাকতাম। গায়ত্রী কাকিমা এখনও, এই অতি বৃদ্ধ বয়সেও সচল। কলকাতার উপকণ্ঠে থাকেন, কন্যা পারমিতার সঙ্গে। পারমিতাও অভিনয় করতেন ওই দলে। গায়ত্রী কাকিমা ছিলেন ক্রান্তি শিল্পী দলের ছিলেন নিয়মিত গায়িকা। এখনও ভাঙা কণ্ঠে গেয়ে যান রবীন্দ্রনাথের গান।
(ক্রমশ)