অক্সিজেন। পর্ব ৩৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

1

গত পর্বের পর

কান পেতে রই

“তুমি কখন আসবে?তোমার জন্য এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করব?”

সন্ধে নামব নামব করছে।আজ ও সে এলোনা। হোয়াটস্‌ অ্যাপে ম্যাসেজটা লিখে আবার মুছে দিয়ে পাশ ফিরে শুল বিলু।

এখন ও পাশ ফিরতে পারে। ফোন ধরতে, করতে পারে।যদিও বেশি কথা বলা বারণ।বসিয়ে দিলে ঠেস দিয়ে বসতে পারে। কিন্তু ডাক্তার বাড়ি যাবার পারমিশান দেননি।

ওর ফোনটা বালিশের নীচেই রাখা আছে। সকালে ঠিক এগারোটায় মা আসে। আয়াদিদি মাথা ধুইয়ে গা মুছিয়ে দিলে, মা নিত্যপুজোর বেলপাতা ফুল মাথায় ঠেকায়। যেমন বাড়িতে ঠেকাত।তারপর নিজের হাতে বানানো মাছের তরকারি, কখনো বা মাংসের পাতলা হলুদ ঝোল দিয়ে ভাত মেখে ওকে খাইয়ে যায়। মাঝেমাঝে ওর খুব অবাক লাগে। মা নিজে নিরামিষ খায়,এভাবে ওকে খাওয়াতে মায়ের অসুবিধা হবার কথা তো।

বাবা, ঘুরে যায় অফিসফেরত, নিয়ম করে । ছোটে প্রায়ই আসে টিফিনের ছোট ছোট বাটি ভর্তি নানারকম মুখরোচক খাবার নিয়ে। “বাড়ির তৈরি কম তেলমশলার সব খাবার খাওয়া যাবে,” ডাক্তারের এহেন ঘোষণার পর ছোটের উৎসাহ বেড়েছে। ও বোঝে, এসব খেয়ে যাতে ওর মন একটু ভাল থাকে, ছোটের সেটাই সাধনা।

আর কখনও আসে কখনও আসেনা সে। যার জন্য ঘুম থেকে উঠেই প্রতীক্ষা শুরু হয় বিলুর। বিকেল হবার পর থেকেই প্রতিটি পায়ের শব্দ গোনে ও।এলো, এলো না,….. । অনন্তকাল ধরে সে গণনা চলতেই থাকে।

এই নার্সিংহোমে মোটামুটি একুশ দিন কাটল। জ্ঞান আসার পর প্রথম কয়েকদিন  আচ্ছন্ন ভাবেই কেটেছে।সারা গায়ে কাটাকুটি, হাত পায়ের ভাঙা হাড়, মাথার স্টিচের জায়গার ব্যথা বেদনা,কথা বলার কোন ইচ্ছে ছিলনা বিলুর। ডাক্তাররাও বেশিরভাগ সময়েই ঘুম পাড়িয়ে রাখত। হাসপাতালেও প্রথম দুদিন ছিল তো। তবে হাসপাতালের কথা ও শুনেছে শুধু। নিজের কিছুই খেয়াল নেই।ডঃ ত্রিপাঠী মাকে সেদিন ওর সামনেই বলছিলেন, “আপনাকে বলি ম্যাডাম, ওই মেয়েটি ঠিকসময়ে আপনার ছেলেকে হাসপাতালে না নিয়ে গেলে, ওকে বাঁচানো যেত না।

একটা রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনেছিল ও।তীব্র মূর্ছনায় কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায় গাইছিলেন, “না বাঁচাবে আমায়,যদি মারবে কেন তবে?/কিসের তরে এই আয়োজন এমন কলরবে?”

ওর এখনকার অবস্থায় গানটা একেবারে ফিট করে যায়।ওই একটা মেয়ের জন্য ওর সারা দিনের প্রতীক্ষা ওকে আধমরা করে দিচ্ছে তো।

আবার মাঝেমাঝে ওর উল্টোটা মনে হয়।ও তো মরেই যেত।ওকে ওই দুটো হাতে বাঁচার অমৃত পাঠিয়ে দিল কে?যদি দিলই তবে সে অমৃতভাণ্ড পরিপূর্ণ করে দিল না কেন?

সেদিন ওর কী হয়েছিল সবার মুখে শুনেছে ও।কিন্তু বিলু নিজে যা জানে তা আর কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়।তখন রাত আটটা হবে, ও জি টি রোড ধরে বাড়ি ফিরছিল।ওই পুরনো তেলকলের কাছে একটু অন্ধকার থাকে।গাড়ি তেমন স্পীডে ছিলনা।ও যেতে যেতেই লক্ষ করে সামনে বিরাট বড় একটা খোঁদল। মটরবাইকটা একটু বাঁ পাশে সরিয়ে নিয়েছিল ও। খেয়ালে ছিলনা ঠিক পেছনেই আসা লরিটার কথা।তারপরেই বিরাট একটা ধাক্কা। মোটরবাইক সমেত উড়ে যাওয়াটা মনে আছে শুধু । আর যেটুকু মনে আছে তাতে কোন দৃশ্য নেই, আছে ঘনিয়ে আসা কালো অন্ধকারে একেবারে চোখ বন্ধ করে ডুবে যাওয়া।

অন্ধকারের জগতেই ওর স্থায়ী নির্বাসন হত। যদিনা ওই পরীর ম্যাজিক ওকে ছুঁয়ে যেত। জ্ঞান আসার দিন একেবারেই অন্য অনুভূতি। যেন আলোর ভাঙা ভাঙা রেখা ছিটকে এসে চোখেমুখে লাগছে। আর জল কেটে সাঁতার দেওয়ার মত ও একবার ডুবছে আর একবার ভাসছে । সেসময় দুটো মুখ ঝুঁকে আসত মুখের ওপর। ও দেখতে পেত উদ্বেগে ব্যাকুল ওর মার মুখ। আর একটা মুখেও আশঙ্কা আর মমতা এক অদ্ভূত ছবি এঁকেছে। সে মুখ ওই পরীর।কুহু যার নাম।

এই কদিনেই ও বুঝেছে একটা মানুষের হৃদয়ে অন্য মানুষের জন্য ঠিক কতটা স্বার্থহীন আকুতি থাকতে পারে। জ্ঞান আসার পর বাবা মা আত্মীয় পরিজনেরা একজন দু’জন করে ঘরে আসতেন। পিন্টু বা ছোটের সঙ্গে, কখনও বা একেবারেই একা এসে, বিছানা থেকে বেশ খানিকটা দূরে,একপাশে চুপ করে দাঁড়াত সে। সাধারণ সুশ্রী একটা মুখ। কাঁচের মত স্বচ্ছ একজোড়া কাজল কালো  চোখ। কপালের ওপর ঘামে লেপটে থাকা একগুচ্ছ চুল। একেবারেই সাদাসিধে পোশাক।তবু ফিরে যাবার সময় নজর কাড়ত ছন্দিত দেহের কোমল হিল্লোল। তাতে সঙ্গত করত পিঠের ওপর পড়ে থাকা দীর্ঘ বেণী। তখন ওর মনে হয়েছে ওইরকম একটা পাতলা হাল্কা শরীর নিয়ে ওই মেয়ে পাহাড়ে ওঠার মত দুঃসাধ্য কাজ করে কিকরে?

বিলু নিজে কম কথা বলে।ওর বেশিরভাগ কথাই চলে মনেমনে।কিন্তু ওই মেয়ের একেবারে দু’একটা বাক্য বলার প্রবণতাটা ওর অসহ্য লাগে মাঝেমাঝে।এতও কম ও বলে কেন?ওর কি বিলুকে দেখলেই সব কথা ফুরিয়ে যায়।

শুধু “আজ আর একটু ভালো তো?” তার বেশি একটা শব্দ নয়। কতদিন দরজার কাছেই সঙ্কোচে চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকেছে। আর অন্যদের কাছে খবরাখবর নিয়ে চলেও গিয়েছে টুক্‌ করে। বিলুর ভাল করে জ্ঞান আসার পর ছোটে একদিন হাত ধরে হিড় হিড় করে টেনে নিয়ে এসেছিল একেবারে সামনে।

বলেছিল, “দ্যাখ, এই মেয়েই তোর জীবন বাঁচিয়েছে। ও তোকে তুলে হাসপাতালে ভর্তি না করলে, ওখানে ওভাবে পড়ে থাকলে, আমরা তোকে কী অবস্থায় পেতাম কে জানে?”

“পড়ে থাকতে যাবেন কেন? কেউ না কেউ ঠিক তুলে হাসপাতালে নিয়ে যেত।” কুহু গভীর বিশ্বাসে বলেছিল।

ছোটে কথাটা নস্যাৎ করে দিয়ে বলে, “ছাই যেত! তারা আগে পুলিস কেসের কথা ভাবত। নিজের নিরাপত্তার কথা ভাবত। কিংবা হয়ত শুধুশুধু ওইসব করে নিজের সময় নষ্ট করতেও চাইত না।”

“তাই কী? সবাই তা করত বলে আমার মনে হয়না।” কুহু প্রতিবাদ করেছিল আবার।

কুহুর হাত ধরে ছোটে বলেছিল, “তোমার যোগ্য কথা। এইজন্য বোধহয় তুমি পাহাড়ে উঠছ,আর আমরা ঘরের চৌহদ্দির মধ্যেই আটকে আছি।

সেই একদিন ছোটের হাত ধরে একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছিল ওই পরী।তবে তখন বিলু মোটে ভাল ছিলনা। ও শুধু টের পেয়েছিল সে এসে দাঁড়িয়েছে কাছে।  এখন তো আর কাছে আসেনা। ওকে ভাল করে দেখার বড় সাধ জাগে যে। সেকথা ও কাকে বলবে? ছোটেকে? না না ছিঃ! ছোটে হেসেই গড়িয়ে পড়বে হয়ত।

শুয়ে শুয়ে ওই পাহাড়ে চাপা মেয়েটার কথাই ভাবছিল বিলু। বাবা ঘরে ঢুকতেই নিজেকে সজাগ করে নিল ও।

“কেমন লাগছে? ডঃ দত্ত তো বলছেন এই শনিবার ছেড়ে দেবেন। তোর কী মনে হয়?”

“কী আবার?বাড়ি ফিরব,তার থেকে ভাল আর কী হতে পারে।”

“ওদিকে ইন্দু তো তোর জন্য কান্নাকাটি করছিল।তুই বাড়ি ফিরবি শুনে খুব খুশি।কী যে হল…! আমাদের বংশে কারোর কখনও …।”

বিলুর খুব হাসি পায়।বাবা আবার বংশের কথা বলছে।ও তাড়াতাড়ি বলে আয়া  দিদিকে একবার ডাকো তো। আমাকে একবার বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে। দেখো ওই বারান্দাতেই বসে আছে মনে হয়।”

বাবা বাড়ি ফিরে গিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ। আজ আর কুহু আসেনি। বিলুর রাতের খাওয়া, ওষুধ খাওয়া, সব আজকের মত শেষ । ডাক্তারের রাতের চেকআপও হয়ে গিয়েছে। ফোনটা  হাতে তুলে নেয় ও। না এভাবে চুপচাপ থাকার কোন মানে হয়না। কুহুকে দিনের শেষ ম্যাসেজটা করে ও।

“আজ, এলেন না কেন?”

কথাটা লিখে ফোনের স্কিনের আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে। ম্যাসেজটা সেন্ট দেখিয়েছে। আলোটা নিভে যায়।একটু পরেই ফোনটা আবার খোলে ও। দুটো নীল  রাইট চিহ্ন। তাহলে কুহু পড়েছে ওটা। উত্তর দেবেনা হয়ত। যা মেয়ে, আসা না বন্ধ করে দেয়। সাতপাঁচ ভাবছিল ও।

টিং করে একটা আওয়াজ হতেই ফোনটা আবার খোলে বিলু । এসেছে, কুহুর ম্যাসেজ। কুহু লিখেছে, “আজ একটু আটকে গেসলাম। কাল ঠিক যাবো।”

প্রথমে বেশ আনন্দ হয় বিলুর। তারপরেই মুষড়ে পড়ে। মনে হয় ওই লেখাটা নিছকই ভদ্রতা। কুহু কিছুই বোঝেনি। বুঝতে না পারার মতই মনে হচ্ছে। যাই হোক তবু আসবে বলেছে তো।

চাপা দেওয়া গ্লাস থেকে হাত বাড়িয়ে জল খায় একবার। তারপরেই পা অবধি চাদর টেনে চোখ বোজে। এখন আর ঘুমের ওষুধ দেয় না ওরা।কিন্তু আজ ঘুম আসবে কি?

(ক্রমশ)

 

Author

1 thought on “অক্সিজেন। পর্ব ৩৬। লিখছেন সর্বাণী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *