কাগজের নৌকো। পর্ব ২২। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
ঝলমলে রেঁস্তোরার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন যুবক যুবতি। হাতে সিগারেট। হয়তো রেঁস্তোরার ভেতর ধূমপান করা যায় না, তাই বাইরে বেরিয়ে এসেছে ওরা।অপরূপ লাবণ্য ওই যুবতির।ঘন নীল শাড়ি,গাঢ় কাজলে গভীর দুটি আঁখি,প্রায় মুছে যাওয়া রঙের লিপস্টিক-সেসব বাহ্য, তারও পরে কী যেন এক অলৌকিক নির্জনতা আর আনন্দ যুগপৎ ঘিরে আছে তার শরীর। চোখ ফেরানো যায় না ওই রূপের মায়ায় ।দ্রুত সন্ধে নেমে আসছে চারপাশে। ব্যস্ত রাস্তা, লোকজন, গাড়ির উদ্যত হর্ন, আলোর মালা দিয়ে সাজানো কলকাতা সব ম্লান হয়ে যাচ্ছে সে-যুবতির নিকটে। নীচু স্বরে কথা বলছে তারা দুজন।
—আজকাল তুমি ছাড়া আমার তেমন কারোর সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছে করে না, জানো!
আনমনা স্বরে উত্তর দেয় যুবকটি
—জানি তো! আমারও ইচ্ছে করে না!
—কেন যে একা থাকলাম না! এইসব মেনস্ট্রিম ঘর-সংসারে জড়িয়ে পড়লাম। আর কোনও উপায়ও নেই পিছনে তাকানোর।
—নাহ! উপায় নেই আর।
—আমার অবশ্য তেমন কিছু যায় আসেও না, তুমি থাকলেই হল!
একটু ফ্যাকাশে হেসে যুবকটি বলে
—কিন্তু সে আর কতদিন। তোমার ঘর, সংসার, বিয়ের পর ব্যস্ততা…যেমন ভাবছো, দিন যাবে না এমন!
—শুধু বাজে কথা তোমার! সব একই থাকবে।
—মানে এভাবেই আমাদের দিন যাবে ? আসলে তুমি বালিকাই রয়ে গেলে !
ঘন চোখের পাতা তুলে তাকায় যুবতি। কোন সুদূর এক অপরাহ্নের মতো ম্লান সে দৃষ্টি। ইতস্তত গলায় বলে
—কী যে করব আমি, তাই ভাবি।
শেষ ডিসেম্বরের বাতাস বইছে।ধুলো আর কুয়াশায় ভরা ঠাণ্ডা বাতাস। মাথার ওপর ঘোলাটে আকাশ।হাতের সিগারেট ফেলে যুবকটি বলে ওঠে
—চলো ভিতরে যাই।
—এখানে খাওয়া শেষ করে যাবে আজ একবার কুইনস এভিনিউ ?
—যেতে ইচ্ছে করছে ?
—গেলেই তো হয়। একটা ওলা রেন্টাল নিয়ে!
—তা হয়, কিন্তু তোমার সেই বিকেল তো আর নেই! সন্ধে নেমে এল!
—তা হোক! তবুও..
রেঁস্তোরায় ঢুকতে যেতেই ওদের পিছন থেকে ভেসে এল একটা মলিন কণ্ঠস্বর
—বাবু ভাত খাব, কিছু দিয়ে যান
রাস্তায় তখন জ্বলে উঠেছে লাল নীল আলো। ভাঙা পুরনো শহর চিকমিক করছে তার আভায়। বৃদ্ধ এক মানুষ। একটা পা অকেজো। ছেঁড়া লাল সোয়েটার পরনে।মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তোবড়ানো গাল।সামনের দুটো দাঁত ভাঙা।ডাক শুনে পিছন ফিরল যুবকটি। অন্যদিন এসব ডাক কতবার অগ্রাহ্য করে যায় সে, আজ কী যেন একটা হল। পকেট থেকে একটা দু টাকার কয়েন বের করে রেখে দিল লোকটার হাতে ধরা অ্যালুমিনিয়ামের বাটিতে।
—আর কিছু দিন বাবু
আবারও না করতে পারল না আশ্চর্যজনক ভাবে যুবকটি। দশ টাকার একটি নোট রেখে দিল বাটিতে।যুবতিও সরে এসে দাঁড়িয়েছে যুবকের পাশে।
ফোকলা হাসি একগাল হেসে কাঁপা কাঁপা হাত যুবকটির মাথায় রেখে লোকটি বলে উঠল
—ভগবান তোমায় দেখবেন!
তারপর যুবতির মাথায় আলতো হাত ছুঁয়ে জিজ্ঞেস করল
—এই বাবু কে হয় তোমার মা ?
কাঁচের ওপারে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে দামী খাবার।ঘন শীত সন্ধেয়, একরাশ আলোর নীচে এই প্রশ্ন শুনে বিহ্বল দেখায় ওই নীল শাড়ির অপরূপ যুবতীকে। কিছুই বলতে পারে না। আড়চোখে সলজ্জ তাকায় শুধু যুবকটির দিকে। দ্বিধা ভেঙে যুবকটি উত্তর দেয়
—আমার বন্ধু!
লোকটি নাছোড়বান্দা। ফের বলে যুবতির দিকে তাকিয়ে
—বিয়ে করে নাও মা! নাহলে বন্ধু হয়ে ছেড়ে চলে গেলে কী হবে বাবুর ।
যুবকটি অস্বস্তি এড়াতে জিজ্ঞেস করে
—তুমি খুশি হয়েছ তো ? ভাত পাবে এখন ?
দুহাত নেড়ে মানুষটি বলে
—খুব খুশি হয়েছি বাবা। বিয়ে করে নাও দুজন। খারাপ কিছু বলেছি আমি বলো ? এমন দেবীর মতো মেয়ে, ছেড়ে যেও না, যেও না…
আরও কী সব বলে যেতে থাকে বুড়ো লোকটি। কলকাতায় জমে ওঠে শীতের সন্ধে। যুবতির দেখতে চাওয়া কুইনস এভিনিউ থেকে ছুটে আসে দামাল বাতাস। আপনমনে ঘুরে চলে ভিক্টোরিয়ার পরী। দু একটা পাতা খসে পড়ে রেঁস্তোরার সামনের ছাতিম গাছ থেকে।
দুজন উজ্জ্বল যুবক যুবতি, তাদের কিছু শুনে ফেলা ভালবাসার গল্প পার হয়ে আমি এগিয়ে যাই সামনে। অকারণে খুশি হয়ে উঠি। গরীব রুটির দোকান, দেহাতি মানুষের দিনান্তের খাওয়া, ঝলমলে সব খাবারের দামী রেঁস্তোরা পার হয়ে এগিয়ে যাই। দুপাশে টানা রিক্সার সারি, মুখে রং মাখা সস্তার বেশ্যা, মদের দোকান।উদ্দেশ্যহীনভাবে সিগারেট ধরাই। পিছনে পড়ে থাকে একটা কবেকার গল্প।
তাও হয়ে গেল আজ উনিশ কুড়ি বছর, হালিশহর থেকে রাস্তাটা চলে গেছে চৈতন্যডোবার দিকে, হাঁটছিলাম আপন মনে। তখন মন কাঁচের মতো স্বচ্ছ, যা দেখি তাতেই উথলে ওঠে খুশি। যৌবনবেলার এমনই নিয়ম! একপাশে গঙ্গা, লাজুক শীতকাল আসব আসব করেও থমকে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের চৌকাঠে। ইচ্ছে ছিল চৈতন্যডোবায় নিমাই সন্ন্যাসীর গুরু ঈশ্বরপুরীর আশ্রম দেখে ফিরব।
কার্ত্তিক মাসের বিকেল, এখনই ঝপ করে মরে যাবে আর নেমে আসবে সন্ধে। কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া চারপাশ। নাক টানলে ভেজা গন্ধ পাওয়া যায় বাতাসে। মলিন মধ্যবিত্ত পাড়ায় খেলা সাঙ্গ করে বাড়ি ফিরছে ছেলেপিলের দল, শঙ্খ বেজে উঠছে কারোর তুলসীতলায়। কত পুরোনো মন্দির, গায়ে ভাঙা পোড়া মাটির কাজ। এই যুবতি সন্ধেবেলায় কেউ সেখানে আর দীপ জ্বালে না, কতদিন হল হারিয়ে গেছে দেববিগ্রহ ! চামচিকে আর বাদুড়ের আস্তানা, আরেকটু পরেই অন্ধকারে পাখা মেলে তারা উড়ে যাবে খাবারের খোঁজে।
রাস্তার একপাশে দু চারটে ছোট তাঁবু পেতেছে বেদের দল। গাঁ গঞ্জে তখন প্রায়ই দেখা যেত তাদের। তাঁবুর বাইরে বসে আছে এক বেদেনী। একঢাল রুক্ষ চুল মাথায়, পরনে ঘাঘড়া আর ব্লাউজ, কটা চোখ। তামাটে শরীরের গড়নটি ভারী সুন্দর। কাঠ কুটো জুটিয়ে আগুন জ্বেলেছে, তিনটে ইঁটের মাটির হাঁড়ি চাপানো, গুবগুব করে কী যেন ফুটছে। পাশে রঙবেরঙের তাপ্পি মারা একটা বিশাল ঝোলা। বিচিত্র সব জিনিস থাকে ওই ঝোলায়। কলাবাদুড়ের নখ, শাঁখামুটে সাপের বিষদাঁত, ঘোড়ার নাল, মানুষের করোটি আরও কত কী! সাপের বিষ নামায়,গাঁয়ে অজান্তে মেয়েদের গর্ভ হলে গর্ভ খসাতেও ডাক পড়ে বেদেনীদের ! ডাইনে ধরলে জলপড়া দেয়!
সেই ছোটবেলায়, কতই বা বয়স তখন আমার, নয় দশ বছর হবে, এমনই এক শীতের অপরাহ্নে বাড়ি ফেরার পথে আলাপ হয়েছিল এক বেদেনীর সঙ্গে। তার ঝোলা খুলে রূপকথার রাজ্য দেখিয়েছিল আমাকে! গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিল, কী বোঁটকা গন্ধ হাতে। বড় বড় নখে কিরকির শব্দ, কেমন গা শিরশির করেছিল আমার, ঠি ক অরুণ-বরুণ-কিরণমালার ডাইনি বুড়ি, সেই যে হাড়ের পাহাড়ে থাকত! ফেরার রাস্তায় যতবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেছিলাম, স্থির চোখে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে! মরা মরা দুটো চোখ। কীই বা বুঝতাম আর সেই বালকবয়সে!
দুপুরে খেতে বেরিয়েছিলাম, অফিসপাড়ার ছায়াচ্ছন্ন সস্তার হোটেল। ঠা ঠা দ্বিপ্রহরে যেন আগুন গলে গলে পড়ছে আকাশ থেকে। রাস্তার ধারে পাতা নড়বড়ে প্লাস্টিকের টেবিল চেয়ার, এখানে বাবুরা ঠি ক খায় না। আশেপাশের অফিসের দারোয়ান উর্দি পরা এটিমএম রক্ষী হকার ইলিক ঝিলিক মানুষেরা খেতে আসে। পেরেকের মতো ভাত, জোলো মুসুর ডাল, পুঁইশাক কুমড়োর ঘন্ট এককুচি লেবু লঙ্কা কাঁচা পেঁয়াজ এইসব সামান্য আয়োজন !
একটা বুড়ো রাধাচূড়া গাছের ছায়ায় সামান্য মানুষের দল পেট ভরে খেতে বসেছে আর বাতাসে উড়ে উড়ে তাদের মাথায় শরীরে খিদের থালায় নেমে আসছে রাধাচূড়ার হলুদ রেণু।
মুখে ভাতের গরাস তুলেই চোখে পড়ল, দুটি বেদেনী এসে বসেছে আমার উল্টোদিকের চেয়ারে। সেই একরকম ঝোলা নিচে পায়ের কাছে রাখা। টান করে বাঁধা রুক্ষ চুল, বড় বড় হাতের নখ, কটা চোখ। একটু অবাকই হলাম, ভালোও লাগল, এখনও এই ফসিল হয়ে যাওয়া প্রেতশহরে দু একজন জ্যান্ত মানুষ আসে তাহলে !
খাওয়া শেষ করে দাম মিটিয়ে উঠে আসছি, সিগারেট ধরিয়ে কী মনে হল, পিছনে তাকালাম।
খাওয়া থামিয়ে একজন দেখি ঠায় চেয়ে রয়েছে আমার দিকে। সেইরকম মরা চোখ।
এবার চোখে চোখ রেখে একটু হাসলাম। ছোটবেলায় বুঝিনি, আজ জানি ওইরকম সব দৃষ্টির মায়াই সারাজীবন আমাকে থিতু হতে দিল না! একটু আরাম করে দাওয়ায় বসলেই তাড়া দিতে থাকে নিরন্তর, চলো চলো।
কোথায় যে যাব, কে জানে!
(ক্রমশ)