কাগজের নৌকো। পর্ব ২১। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর

0

কংকালীতলার মাঠ পার হয়ে ভৈরবের থান।মাটির ঢিপির ওপর পোঁতা সিঁদুর আর তেলে লেপা লোহার ত্রিশূল। পাশে একখানা খোড়ো চালের মাটির দাওয়া।

বাবা কালিকানন্দের সাধনপীঠ। প্রৌঢ়া ভৈরবী উমা মায়ের সঙ্গে তার সংসার। চালের ওপর শীতের কচি লাউয়ের মাচা। দুপুর গড়ালে দাওয়ার সামনে কাঠের উনোন জ্বেলে রান্না বসায় ভৈরবী। যেদিন যেমন সিধে দিয়ে যায় গাঁয়ের লোক। ঘরের কুমড়ো, আলু, নরম ডাঁটো বেগুন, পাঁচ মেশালি মোটা চাল, খেসারির ডাল।শনি মঙ্গলবারে হয়তো কারোর পুকুরের একখান বোয়াল বা রুই। ভৈরবের থানে ভোগ চড়ে।

বাঁজা মেয়েমানুষকে তাবিজ মাদুলি দেয় কালিকানন্দ। ক্ষেতে ফসল না হলে ভূমি পুজো করে। অশৈলী কাণ্ড ঘটলে কারোর ভদ্রাসনে বাড়ি বেঁধে দিয়ে আসে। সোমত্ত মেয়েছেলে এলোচুলে পুকুরে নাইতে গিয়ে ভর উঠলে ঝেড়ে দেয়। সে মেয়ের তখন গায়ে অসুরের বল, সাতমণ ভারী লোহার বালতি দাঁতে করে টেনে নিয়ে যেতে পারে। মুড়ে ঝাঁটা আর সর্ষেপোড়া ওষুধ। আঁতুরে বাচ্চা ককিয়ে কেঁদে উঠলে রাতবিরেতে গাঁয়ের লোক ছুটে আসে। জলপড়া নিয়ে ফিরে যায়। সেরেও যায় তারপর। সান্নিপাতিক, ‘মায়ের দয়া’র গুহ্য ওষুধ আছে কালিকানন্দের কাছে। হাত দেখা, কোষ্ঠী বিচার, মাঙ্গলিক কাটানোর মাদুলি, শনির সাড়েসাতি দশার পাথর-সেসবও আছে। এই করেই কটা টাকা আসে ঘরে। নুন তেলের খরচ ওঠে। ভৈরবীর দুখান বছরে শাড়ি হয়, মোটা সুতোর লালপেড়ে শাড়ি। নিজের ধুতি, ফতুয়া। বাংলা মদের বোতল। দু পুরিয়া গাঁজা। ভৈরবী ঝাল ঝাল করে ছোলা সেদ্ধ করে দেয়। সূয্যি পাটে বসলে সেসব তখন বাবার প্রসাদ।

কিন্তু এসবের পসার আর খুব বেশিদিন নেই, জানে কালিকানন্দ। খাঁ খাঁ দুপুরে কোনও কোনওদিন দাওয়ায় বসে সে কথাই ভাবে। এলোঝেলো বাতাস ধেয়ে আসে শূন্য চরাচর থেকে। চোখের তলে কালি। বয়স থাবা বসিয়েছে চামড়ায়। কপালে বলিরেখা। বংশী মণ্ডল নামটা কবেই যেন চাপা পড়ে গিয়েছে কালিকানন্দের আড়ালে। দুবার ফেল করে সেই কোন কিশোর বয়সে ঘর ছেড়েছিল। তারপর নানা ঘাটের জল। শ্মশানে মশানে গাঁজার ঠেকে সাধুদের সঙ্গে লেগে থাকত। মলুটি গাঁয়ের কাছে দেখা মেলে একদিন বাবা সনাতন অবধূতের। তখন বংশীর যৌবনকাল। দেহে অসুরের বল। তা অবধূত দিয়েছিল মহাবীজমন্ত্র কানে। নিশুত রাতে চক্রে নিয়েও বসেছিল একদিন। দুজন সাধু আর তাদের দুজন ভৈরবী। প্রৌঢ় শরীরে অবধূতের জোর দেখে হাঁ হয়ে গেছিল বংশী। সোমত্ত ডাঁটো ন্যাংটা যুবতিকে কোলে তুলে একই আসনে চার পাঁচ ঘন্টা। তাও নাকি রেতঃপাত হয় না! বংশী দেখছিল শুধু ওই যুবতির ন্যাংটা শরীর। উঁচু উঁচু বুক। কালো পাথর কাটা কোমর। শরীরের খাঁজ। মৃদু প্রদীপের আলোয় ঘামে ভেজা দেহ। একরাশ কালো ঘন খরস্রোতা নদীর মতো চুল। কপালে গলে যাওয়া সিঁদুরের ফোঁটা। শীৎকার ধ্বনিতে মুখরিত রাত্রি। শক্ত হয়ে গেছিল বংশীর নিজের যন্ত্র।

সেই মেয়ের নাম ছিল শঙ্করী। বাগদিদের মেয়ে। কোথা থেকে ফুঁসলে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল অবধূত। তাকে নিয়ে একদিন ভেসে পড়ল বংশী। আশনাই হল। আজকের উমা নামের তলে চাপা পড়ে গেল শঙ্করী। এদিক ওদিক সাতঘাটের জল খেয়ে আজ এই ভৈরবের থানে ঘর বাঁধা। শঙ্করীর শরীরের বাঁধন নষ্ট হল। কাল থাবা বসাল দেহে। তবুও আশনাই কী মরে! আজও যখন চান সেরে গলা তুলে সুর তোলে, মাঠ থেকে ছুটে আসে বিবাগী বাতাস, “বড় ধূম লেগেছে হৃদিকমলে”, বংশী জেগে ওঠে। শিরশির করে ওঠে শরীর। রাইকিশোরির মতো লাগে বাগদিদের শঙ্করীকে। বীজমন্ত্র কবেই ভুলে গেছে। জপেও বসেনা কতকাল। শুধু প্রেম সম্বল করেই কেটে যায় দিন। সেও কি একরকমের পুজো নয় ? শুধু ভাবে সে মনে গেলে কী হবে শঙ্করীর। পুকুর ঘাটে একদিন বুকে চাপ ধরে অজ্ঞান হয়ে গেছিল। বলেনি কাউকে। ভৈরবকে মনে মনে বলে, ‘কিছুই তো পারিনি সারাজীবন। তুমি শঙ্করীকে দেখো বাবা’।

দুপুর গড়িয়ে আসে। পৌষ মাসের হলদে আলো চরাচরে।প্রকাণ্ড এক অশ্বত্থ গাছ ছায়া ফেলে দাঁড়িয়ে আছে দাওয়ার পাশে।অনেকদিনের পুরনো ঝুড়ি নেমেছে গা বেয়ে। রোদ্দুর পাতার ফাঁকফোকর গলে নেমে এসে আলোর জাফরি তৈরি করছে ধুলো মাটির ওপর। উদাসী বাতাস বয়ে আসে কোথা থেকে। কে যেন বলে যায়, বড় ধূম লেগেছে হৃদিকমলে!

বংশী আর শঙ্করীই হয়তো একদিন স্বাভাবিক মানুষের সংসারে ফিরে আসবে, অল্প বয়স তাদের, দেখা যাবে হয়তো তারা দু’জনে, অর্থাৎ ছেলেটি আর মেয়েটি হাঁটছে। পরস্পরের হাত মুঠোয় ধরা।সন্ধে নেমে এসেছে তখন। এক এক করে আলো জ্বলে উঠেছে সব দোকানের। মহাত্মা গান্ধি মার্গ সরগরম মানুষের ভিড়ে। পিছনে আবছা দাঁড়িয়ে আছে তুষারাবৃত কাঞ্চনজঙ্ঘা। দু একটা তারা ফুটে উঠছে নির্মেঘ রাতের আকাশে। আরেকটু পর বোধহয় চাঁদ উঠবে আজ।

বোঝা যায় তারা বেড়াতেই এসেছে। রাতের খাবার কিনতে বেরিয়েছে দুজনে।লাল ওয়াইন কিনবে। স্থানীয় স্যানিও ওয়াইন ভারী পছন্দ মেয়েটির। আর পছন্দ ঝালঝাল করে পেঁয়াজ ক্যাপসিকাম লাল লঙ্কা দিয়ে রাঁধা চর্বিওলা শুয়োরের মাংস। কিন্তু বড় রেঁস্তোরা ওদের দুজনেরই দু চোখের বিষ এই বেড়াতে এসে। মহাত্মা গান্ধি মার্গের ঝলমলে আলো পার হয়ে ওরা ঢালু রাস্তা বেয়ে নীচে নেমে যাচ্ছে। চারপাশটা বদলে যাচ্ছে একটু একটু করে। সারাদিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে মানুষজন। লেপচা ভুটিয়া গোর্খা নেপালি কত ভিন্নজাতির লোকজন। আমরা সবাইকেই এক ভাবি! ছোট ছোট চোখ, ফর্সা গায়ের রঙ, সিল্কের মতো সমান চুল সব মেয়েদের। ঘিঞ্জি বাজার বসেছে। ডাল্লে লঙ্কা, ছোট ছোট টকটকে লাল রঙ আর বিষতুল্য ঝাল, কাঠের ঝুড়িতে বিক্রি করছে এক লেপচা তরুণী।

মেয়েটি ছেলেটিকে দেখিয়ে বলছে

—ডাল্লে লঙ্কা কিনব হ্যাঁ? ফেরার সময় !

ছেলেটি হেসে উত্তর দিল

—বেশ তো! কিনে নিও!

স্কোয়াশ পেঁয়াজ ক্যাপসিকাম কত জিনিসের হাট। একটু দূরেই শুয়োর আর মুরগীর মাংস বিক্রি হচ্ছে। পাশে ছোট ছোট ঘুপচি রেঁস্তোরা,মদের দোকান। কেবিন আছে পর্দা ঢাকা। গোপন প্রেমের কত গল্প ওই বন্ধ কেবিনে! মেয়েটি হেসে বলছে

—আমরা কোনওদিন কেবিনে বসলাম না বলো?

—যাবে নাকি?

দুজনেই হেসে উঠছে এবারে খিলখিল করে। উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটছে। কখনও চড়াই কখনও উৎরাই। কোনও গলি বেয়ে একটু এগিয়ে বুঝতে পারছে কানা গলি! ফিরে আসছে আবার যাওয়ার পথ ধরে। কালো পুলওভার পরেছে মেয়েটি। দীর্ঘ চুলের গোছা এলানো পিঠের ওপর। গলায় একটা সুতির কাজ করা স্কার্ফ। ছেলেটারও সাদা জামার ওপর কালো সোয়েটার। চাপা জিন্স দুজনের পরনেই।

কোথাও দাঁড়িয়ে পড়ছে মেয়েটি।

—তোমার জন্য একটা টুপি কিনতে হবে তো? গ্লাভস নিয়েও তো এলে না! কিনতে হবে! লাচেনে কিন্তু ভীষণ ঠাণ্ডা!

তারপর দরদাম করে কিনছে সেসব। টুপিটা একবার পরে দেখতে বলছে ছেলেটাকে, মানায় কিনা! ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে উঠছে

—শেষমেষ টুপি পরালে আমাকে?!

—বোকা বোকা বলদের মতো কথা বলো না তো! দ্যাখো পরে শিগগির!

তারপর আবার হাঁটা। একটা ছোট রেঁস্তোরার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন। কিন্তু প্রায় তিরিশটা খাড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হবে সেখানে।

—পারবে গো তুমি উঠতে? কষ্ট হবে না ?

মেয়েটির গলায় উৎকণ্ঠা।

—ঠিক পারব! মনে হচ্ছে এদের পর্ক বেশ হবে!

—কষ্ট হবে না তোমার? প্রেশারের ওষুধটা খেয়েছ আজ ?

—চলো তো দেখি!

অল্প শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ছেলেটির। কিন্তু বুঝতে পেরেছে মেয়েটির ইচ্ছে। আস্তে আস্তে উঠছে। হাঁফ ধরছে। বলছে

—সাবধানে ওঠো। আমার হাতটা ধরো, পড়ে যেও না আবার!

শেষমেশ রেঁস্তোরার দরজায় পৌঁছে বিজয়ীর মতো বলে উঠল

—দেখলে তো পারলাম!

একেবারেই ছোট দোকান। একটা নেপালি ছেলে বেরিয়ে আসতেই মেয়েটি বলে উঠল

—পর্ক মিলেগা ভাইসাব?

—জরুর মিলেগা জি! কেয়া সাহিয়ে বলিয়ে ! সিলি পর্ক হোগা

—ওউর মোমো ?

—মোমো ভি হোগা

—দো প্লেট চিলি পর্ক ওউর দো প্লেট নাহি এক প্লেট চিকেন মোমো এক প্লেট পর্ক মোমো

—পার্সেল হোগা জি?

—হাঁ পার্সেল।

ডানপাশে সার সার কেবিন। ওদেরকে কেবিনে বসতে বলে ভেতরে যায় দোকানের নেপালি ছেলেটি।

ময়লা অপরিচ্ছন্ন কেবিন। কবে যেন দেওয়ালে হলুদ রঙ করা হয়েছিল। অপটু কারোর হাতে আঁকা কাঞ্চনজঙ্ঘা সেখানে। টেবিলে পুরনো পলিথিনের একটা চাদর পাতা।  ছোট সাদা আলো মাথার ওপর।

—তাহলে সেই কেবিনেই এলাম!

মেয়েটি একটু হেসে বলে ছেলেটিকে।

—কত গল্প আছে বলো এখানে? এই টেবিলটাতেই হয়তো!

—হ্যাঁ গো! কত প্রেম প্রোপোজাল কত ব্রেকাপ কত চোখের জল

—অল্পবয়সী পাহাড়ি ভালবাসার মতো!

দুজনেই চুপ করে গেল। বন্ধ কেবিনে নেমে এল নীরবতা। কিছুক্ষণ পর মেয়েটি নিজের মনেই নীচু স্বরে বলে উঠল

—জানো, আমার মনে হয় গতজন্মের কোন সম্পর্ক আছে এই পাহাড়ে!

—হয়তো ছিলে এখানেই কোথাও!

—হ্যাঁ গো! হয়তো কাউকে ফিরে আসার কথা দিয়েছিলাম। নাহলে এত কষ্ট করে টাকাপয়সা জোগাড় করে সেই কবে থেকে… কীভাবে যে করেছি, আমিই জানি।

—অনেকটা টাকা তোমার… আমি বুঝি, আমি যে হেল্প করব সে সামর্থ্য…

—থাক না প্লিজ! টাকাপয়সার কথা এখানে। তোমার সঙ্গে আসতে পারাটাই বড় কথা আমার। আর কিচ্ছু না। দেখো ফিরেই তুমি লিখতে পারবে আবার। সারাজীবন যদি এভাবে থাকতে পারতাম! একসঙ্গে!

ছেলেটি আর কিছুই বলে না। মেয়েটিও চুপ করে যায়।দুজনেই অপলক তাকিয়ে থাকে পরস্পরের দিকে। বাইরে ঘন হয়ে আসে অন্ধকার। চাঁদের অপার্থিব আলোয় ভেসে যাচ্ছে তুষারাবৃত মৌন কাঞ্চনজঙ্ঘা। চরাচর জুড়ে এক অলৌকিক রাত্রি রচিত হয়েছে যেন কোন অদৃশ্য জাদুকরের ইশারায়। খাবার নিয়ে ফিরে যাবে ওরা হোটেলের ঘরে।

যেমন আগেও কতবার ফিরতে হয়েছে। এক জন্ম থেকে আরেক জন্মে। আজও হবে। ফিরে যেতেই হয় দুজনকে। আসার পথ ধরে। তারই মাঝে এসব টুকরো টুকরো দৃশ্য, চকিত দৃষ্টি বিনিময়, হাতের ওপর হাত রাখা, আঙুলে আঙুল।

(ক্রমশ)

Author

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *