কাগজের নৌকো। পর্ব ৮। ধারাবাহিক উপন্যাস। লিখছেন সায়ন্তন ঠাকুর
চালসা-পানঝোরা পথটি ভারি নির্জন, দুপাশে আঁধারে আলোর খই ফোটার মতো গাছপালা, লোক চলাচলও তেমন নেই। প্রায় প্রতি রবিবার বিকেলে চালসা হাসপাতাল লাগোয়া কোয়ার্টার থেকে সাইকেল চালিয়ে অবিনাশ এদিকে চলে আসে, মূর্তি নদীর তীরে টিনের চালার একফালি হোটেলে বসে জন ওঁরাওয়ের সঙ্গে গল্পগুজব হয়, দোকানের তরুণী মালকিন লামহা সারি ভুটানি-মুখখানি সর্বক্ষণ আনন্দে ঝলমল, অবিনাশকে দেখলেই চোখ দুটি এলোঝেলো নদী-বাতাসের মতো হাসিস্রোতে ভাসিয়ে জিজ্ঞাসা করে, ‘ডাকতার সাব, শরীরা রামরো ছা?’
এই কয়েকদিনে দু-একটি নেপালি বাক্য অবিনাশ শিখে নিয়েছে, বুঝতেও পারে বেশ, দোকানের বাইরে সাইকেল রেখে মুচকি হেসে বলে, ‘মা ধেরাই রামরো ছু, দিদি!’
এই অঞ্চলে দোকানপাট বিশেষ নেই, সেই কারণেই বোধহয় লামহার দোকান বেশ জমজমাট-চা-বাগানের কুলিরা নিয়মিত আসে, দু-চারজন পর্যটক এদিকে এলে মাঝেমধ্যে তারাও গাড়ি থামিয়ে চা-জল খায়, মোমো চাউমিন ছাড়াও দুপুরের দিকে ভাত, স্কোয়াশের তরকারি, রাইশাক, ডাল, ডিমের ঝোল, আটার মোটা মোটা চাপাটি, লঙ্কার আচার সবই পাওয়া যায় তবে প্রতি রবিবার লামহার হাতের অসম্ভব ঝাল শুয়োরের মাংস-কষা হল এই ছোট্ট দোকানটির প্রকৃত আকর্ষণ-একবার খেলে আজীবন স্বাদ মুখে লেগে থাকে! বাইরে সাধারণ হোটেল কিন্তু পরিচিত মানুষদের জন্য ভেতরে গোপনে সুরাপানের বন্দোবস্তও রয়েছে, দোতলায় লম্বা বারান্দা লাগোয়া এই ঘরটি যেন কোনও যুবতি মনের অন্তরমহল, দরজায় সুতির বিবর্ণ মলিন পর্দা, একফালি ঘরে কাঠের টেবিল-চেয়ার পাতা, পেছনে খোলা জানলার ওপারে মূর্তি নদীর পাথুরে বালিচর আর যতদূর চোখ যায় গহিন সমুদ্রের মতো অরণ্য, চঞ্চলা সোহাগি বাতাসের দোলায় অল্পক্ষণ বসে থাকলে মনে হয় লামহার এই সুরা-ঘর টলোমলো নৌকো হয়ে আকুল অরণ্যপাথারে ভেসে চলেছে!
রবিবার বিকেলে অবিনাশের কাছে কয়েকজন রোগীও আসে, লামহা দু-একদিন আগে থেকেই সবাইকে বলে রাখে, আজও এসেছে দশ-বারোজন নারী ও পুরুষ-সবাই চা-বস্তির কুলি কামিন, সঙ্গে দু-তিনটি বাচ্চাও রয়েছে।
প্রথম রোগী বছর চল্লিশের পুরুষ, কাশি আর ঘুনঘুনে শ্রাবণ ধারার মতো জ্বর কিছুতেই ছাড়ছে না, স্টেথো দিয়ে ভালো করে বুক-পিঠ পরীক্ষা করে অবিনাশ বলল, ‘কাল একবার হাসপাতালে এসো, বুকের ছবি তুলে থুতু পরীক্ষা করতে হবে।’
ক্লান্ত পীতবর্ণ দুটি চোখ তুলে লোকটি অবিনাশের দিকে তাকাল, ‘ইলাচকা পেয়সা নাহি হ্যে ডাকদার সাব!’
–আরে হাসপাতালে পয়সা লাগবে না, তুমি এসো।
ফাটা কাঁসির মতো শব্দ তুলে দুবার কাশল প্রায় প্রৌঢ় মানুষটি, শীর্ণ কঙ্কালসার দেহ, পরনে একখানি মলিন ধুতি আর গেঞ্জি, ফুটিফাটা পায়ে টায়ার কাটা চপ্পল, বিশ্বায়ন আর গ্যাট চুক্তির সামনে পথভ্রষ্ট ভারতবর্ষের মতো অসহায় কণ্ঠে বলল, ‘লেকিন দাবাই খরিদনেকে লিয়ে পেয়সা চাহিয়ে সাহাব, কাঁহা সে লায়ু! আপ কুছু ভি দাবায় দে দিজিয়ে গা তো থোড়া বহুত মেহেরবানি হোগা!’
চৈত্র মাসের অপরাহ্ন, দিনান্তের আলো ডানায় নিয়ে একসারি বক দূরে গোরুমারা অভয়ারণ্যের দিকে উড়ে চলেছে, গেরুয়াবসন আকাশ তার উদাসী উত্তরীয়খানি বিছিয়ে দিয়েছে চরাচরে, দোকানের পাশে সুপ্রাচীন শাল গাছের পাতায় প্রজাপতির মতো কুসুম আলোর ঝিরিঝিরি আলপনার মাঝে একটি কোকিল সহসা সুললিত স্বরে ডেকে উঠল, কান থেকে স্টেথো খুলে অপার ঐশ্বর্যময়ী জগতের পানে চেয়ে অবিনাশের মনে হল, কী বিচিত্র এই সংসার-একদিকে ব্যাধি, মানুষের যন্ত্রণা আর তারই পাশে ষোড়শী প্রকৃতির কী আশ্চর্য মধুর রূপবিলাস! নশ্বর মানুষের প্রতিদিনের ক্লান্ত ব্যাধিময় জীবন তাঁকে কখনও স্পর্শও করে না, আপন খেয়ালে বিভোর হয়ে তিনি নিত্য নিজেকে অপরূপ রূপসজ্জার মধ্য দিয়ে নতুন করে তোলেন। কয়েক মুহূর্ত পর সামনের মানুষটির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এখানে হবে না বাবা, তুমি হাসপাতালে এসো, আমি ওষুধের ব্যবস্থা করে দেব।’
ওষুধ থাকে যথেষ্ট কিন্তু কমপাউন্ডার আর বাকি স্টাফরা দিতে চায় না, দোকানে খোলা বাজারে সেই ওষুধ যে বিক্রি হয় সে-কথা অবিনাশ জানে, সুপার সত্যব্রতবাবুকে বলেও কোনও লাভ হয়নি কারণ প্রতিমাসে কিছু অর্থ তাঁর পকেটেও চলে যায়! এ এক আশ্চর্য মৃত্যুবৃত্ত, অবাক বিস্ময়ে অবিনাশ ইদানিং নিজেকেই প্রশ্ন করে-তবে কি শুধু পয়সা রোজগারের জন্যই চিকিৎসাবিদ্যা পড়তে হয়?
আগামীকাল এই মানুষটিরও ওষুধের ব্যবস্থা হবে না, জানে অবিনাশ! নিজের পকেট থেকে দিতে হবে আর এভাবেই মাস-মাহিনার প্রায় অর্ধেকই চলে যায়! যাক, আরোগ্য দানের থেকে বড়ো আনন্দ আর কিছুই নেই। মনে মনে অবিনাশ স্থির করল, যক্ষা ধরা পড়লে মানুষটিকে জলপাইগুড়ি যক্ষা হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দেবে-সেখানে একজন পরিচিত ডাক্তারবাবু রয়েছেন। মৃদু হেসে লোকটিকে ভরসা জোগানো গলায় বলল, ‘চিন্তা করো না, আমি আছি তো! একেবারে ভালো হয়ে যাবে!’
হঠাৎ মাঝবয়সী মানুষটি রুক্ষ মুঠির মধ্যে অবিনাশের হাতদুটি নিয়ে কপালে ঠেকিয়ে সাশ্রু নয়নে বলল, ‘আপ ডাকদার নেহি সাব, ভগবান্ হ্যে! আভিতক কোই মুঝসে অ্যায়সে বাত নেহি কিয়া।’
এমন মুহূর্তে বড়ো অসহায় বোধ করে অবিনাশ, শীর্ণা মূর্তি নদীর জলে অস্তগামী দিনমণির সহস্র প্রতিবিম্বের পানে চেয়ে ধীর স্বরে বলল, ‘আমি কেউ নই। তুমি ঠিক ভালো হয়ে যাবে।’
পরের তরুণী চার মাসের গর্ভবতী, মলিনবসনা শীর্ণা রমণীর চোখে জগতের সমস্ত ক্লান্তি এসে যেন বাসা বেঁধেছে, টলটলে ক্ষুদ্র প্রদীপের মতো মুখখানি দেখেই অবিনাশ বুঝতে পারল ওজন ভীষণ কম। প্রেসার মেপে কতগুলি আয়রন আর ভিটামিন ট্যাবলেটের পাতা হাতে দিয়ে বলল, ‘প্রতিদিন খাবে।’
একমুহূর্ত পর কী মনে হওয়ায় পুনরায় বলল, ‘দুধ, ডিম, কলা-এখন ক’দিন এসব ভালোমন্দ খেতে হবে।’
দুর্বল হাতের মুঠোয় ওষুধের পাতাগুলি শক্ত করে চেপে মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে তরুণী, কতদিন হয়তো ভালোমন্দ জোটেনি কপালে, গর্ভের মহাপ্রাণীটি এখন ক্ষুধার্ত-তার পুষ্টি দরকার, হতভাগ্যা জননীকে শোষণ করে সে ধীরে ধীরে বড়ো হয়ে উঠছে গর্ভে আর এই দরিদ্র শ্যামা মুখ বুজে ক্ষুধা ও যন্ত্রণা সহ্য করে চলেছে। শরীরে বিন্দুমাত্র লাবণ্য নেই, নিদ্রাদেবী যেন সর্বক্ষণ শিয়রে বসে রয়েছেন শুধু কাজলকৃষ্ণা হরিণীর চোখের মতো নিবিড় একরাশ চুল শ্যামাঙ্গী তরুণীর সকল মালিন্য মুছে যূথিকা কুসুম হয়ে ফুটে উঠেছে। তরুণীকে নিশ্চুপ দেখে লামহা অবিনাশের কাছে এসে নিচু গলায় বলল, ‘ডাকডার সাব, তিনিহারু ধিরাই গরীব চান। দু পতাকা রামরোসামগা খানা হুমদেইনা, জাহাম দুধা আন্ডা পাইবা!’
অবিনাশের সহসা মনে হল, এই হল তার দেশের মা, এত দারিদ্র তবুও মুখের হাসিটি মুছে যায়নি, শুধু ডাক্তারবাবু একবার দেখতে এসেছে বলেই চোখদুটি কৃতজ্ঞতায় দীঘির মতো টলোমলো হয়ে উঠেছে। এমন সুহাসিনী সহস্র অপরূপাদের জন্যই বোধহয় ভারতবর্ষ এখনও নষ্ট হয়ে যায়নি, মনে মনে হতদরিদ্র জননীর চরণে প্রণাম জানিয়ে লামহার হাতে দু’শো টাকা দিয়ে অবিনাশ বলল, ‘ওর জন্য তুমি প্রতিদিন দুধ আর ডিমের ব্যবস্থা করে দাও দিদি। খরচের চিন্তা করো না, টাকা আমি দেব।’
টাকা হাতে নিয়ে সামান্য অপ্রস্তুত দেখাল লামহাকে, ‘দুধালে আন্ডা সবাই ঘরে লিনছা!’
বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘ওর বাড়িতে কে কে আছে?’
–পতি রা দুই যোভন ছোরা!
–বর কাজকর্ম কিছু করে না?
বরের কথা শুনে মুখ ঝামটা দিল লামহা, ‘উসালে বাসা চালা’উমছা তারা সবাই পইসা নিলছে!সয়তানো একোটা!’
এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল অবিনাশ, ‘বেশ, বাড়িতেই নিয়ে যাক, তুমি বেশি করেই দিও। টাকার কথা ভেবো না।’
তরুণী অবিনাশের কথা শুনে চোখ তুলে তাকাল এবার, শোনা যায় স্বাতী নক্ষত্রের চোখের জল শুক্তির গর্ভে জমে মুক্তো তৈরি হয় অথচ সেই অলীক অশ্রুবিন্দু অরণ্যবাসিনী এই তরুণীর দুর্লভ প্রেমাশ্রুর তুলনায় কত অকিঞ্চিৎকর! অবিনাশ দৃষ্টি সরিয়ে নিল, স্নেহময়ী জননীর সম্মুখে সকল জগত নিমেষে মিথ্যা হয়ে যায়। এক মুহূর্ত পর ম্লান হেসে তরুণীকে বলল, ‘আমি প্রতি রবিবার আসি, তুমি এবার থেকে মনে করে এসে একবার দেখিয়ে যেও।’
রোগী দেখা শেষ করে প্রতিদিনের মতোই দোতলার ছোট ঘরে বসেছে অবিনাশ, লামহা কিছুক্ষণ আগে সাদা পরিষ্কার প্লেটে শুয়োরের মাংস, ডাল্লে লঙ্কার আচার আর পাতলা ফালি করে কাটা শশা পেঁয়াজ টম্যাটো গাজর নুন-লেবু-সামান্য চিনি-সরষের তেল কাঁচা শালপাতায় মেখে দিয়ে গেছে-এই স্যালাড অপ্রতিম, কাঁচা পাতায় মুড়ে রোদ্দুরে জারিয়ে নেওয়ার জন্যই বোধহয় স্বাদ বদলে ঝমঝমে হয়ে ওঠে! লণ্ঠনের নিভু আলোয় কাচের গেলাসে সস্তা ভুটানি রাম ঢেলে জনের দিকে তাকিয়ে অবিনাশ সামান্য হেসে জিজ্ঞাসা করল, ‘গাড়ি কেমন চলছে?’
জনের বয়স বেশি হলে কুড়ি-বাইশ হবে, সহজ সাধাসিধে ছেলে, সারাদিন ভাড়ার গাড়ি চালায়, ডুয়ার্সের জঙ্গল নখদর্পণে তাছাড়াও বনদপ্তরের সঙ্গে ভাব-ভালোবাসাও রয়েছে বলেই পর্যটকদের মধ্যে ওর গাড়ির চাহিদাও খুব বেশি! এদিকের ট্যুর ম্যানেজাররা বলে, ‘জনের হাতে টুরিস্ট দিলে তারা বারবার ফিরে আসবে!’
নিজের গেলাসে সামান্য জল মিশিয়ে চোখ বন্ধ করে কপালে আর বুকে ক্রুশ কাঠ এঁকে বিড়বিড় করে বলল, ‘কাম মাই লর্ড, বি আওয়ার গেস্ট এন্ড লেট দাই গিফটস টু আস বি ব্লেসড, আমেন!’, তারপর চোখ খুলে প্রায় একচুমুকে গেলাস শেষ অবিনাশের দিকে চেয়ে হাসল, ‘এখন তো তেমন সিজন না, ওই হচ্চে টুকটাক। অস্টেলিয়া থেকে এক পাগলাচোদা সায়েব এসচে, তা তাকে নিয়েই পাখি দেকাতে ঘুরে বেরাচ্চি, কাল বলচে আবার হাতিপোঁতা যাবে।’
–বাব্বা! সাহেব-পার্টি, তাহলে পয়সাকড়িও হচ্ছে বল! সব তো ডলার!
–ওসব মনে হয় গো দাদা! হেব্বি কঞ্জুস মাল, আমি খ্রেস্টান শুনে কাল একখান মদের বোতল দিছে, তাও দ্যাকো এইটুক পারা নিব!
প্লেট থেকে একটুকরো শুয়োরের মাংস মুখে ফেলে অবিনাশ শুধোল, ‘কেন? খ্রিস্টান শুনে মদ দিল কেন?’
–আরে মদ না, ওয়াইন। ফালতু মাল, সে বুড়ো বলচে, রোজ রাতে খেতে বসার আগে গেলাসে নিয়ে যীশুবাবার কাচে প্রাত্তনা করতে। তা ওইটুকুন মাল, বাবা খাবে না আমি খাব! পাগলা মাল বুঝলা, নাইলে অত দূর তেকে গুচ্চের পইসা খচ্চা করে একানে পাখি দ্যাকতে আসে!
–সে এসেছে, ভালো করেছে। তুই সব ভালো করে ঘুরিয়ে দেখিয়ে দে, ডুয়ার্স কি কম সুন্দর!
হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিমায় জন সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করে, ‘পরশু বলচে চাপড়ামারি বাংলোয় রাত কাটাবে, যাবা তুমি? তাইলে তোমাকে হাসপাতাল থেকে বিকালে গাড়িতে তুলে সোজা বেরিয়ে যাব!’
জনের ছেলেমানুষি আগ্রহে ভারি মজা পেল অবিনাশ, সামান্য হেসে বলল, ‘পরশু মানে মঙ্গলবার, একটা অপারেশন আছে, তারপর সুপার ছুটি নেবে-সব আমার ওপর! হবে না রে বাবা!’
সামান্য যেন মনক্ষুন্ন হল জন, বোতল থেকে গেলাসে বেশ খানিকটা রাম ঢেলে বলল, ‘তোমার কাজের আর শেষ নেই! বাকি ডাকতার রা তো এত করে না, তোমার খালি রোগ আর রোগী!’
আসন্ন সন্ধ্যায় পশ্চিমাকাশে দু-একটি নক্ষত্র রূপবতীর কপালে আলতো টিপের মতো ফুটে উঠেছে, দূরে অস্পষ্ট অরণ্য, শুচিস্মিতা চৈত্র বাতাস নূপুরে শব্দ তুলে নদী চরের দিক থেকে অলস চরণে ভেসে আসছে, কাছেই কোথাও তীক্ষ্ণস্বরে ময়ূর ডেকে উঠল-পরপর দুবার, আজ অল্পক্ষণ পরেই চাঁদ উঠবে, মূর্তি নদীর নিঃসঙ্গ বালুচর এখন স্মৃতির মতোই নির্জন-সেদিক পানে চেয়ে অবিনাশের মনে হল কোনও পূর্ণ যুবতি তার সন্ধ্যাকেশভার বিছিয়ে বসে রয়েছে, আলুলায়িত কুন্তলা সেই দিকবসনা নারীর চোখ দুটি যেন থিরিথিরি নদী স্রোত, ঝুমুর ঝুমুর মধুর কণ্ঠে জন ওঁরাওয়ের মতোই বলছে, ‘তোমার শুধু রোগী আর রোগী! আমার জন্য একটু সময়ও কি নাই অবিন?’
অবিনাশ আপন মনেই মৃদু হাসল, ওই অভিমানীনি কি শবনম্? কতকাল যে তার সঙ্গে দেখা হয়নি, শেষবার আলতো স্বরে এই কথাগুলিই হয়তো সে বলেছিল।
‘কী হল তোমার? যাবা না তাইলে?’
কোঁকড়া চুল আর ফুলছাপ জামা পরা উজ্জ্বল প্রায়-কিশোর জনের দিকে তাকিয়ে আলতো স্বরে অবিনাশ বলল, ‘না রে বাবা, এইবারটা বাদ দে, আমি আর তুই বরং এই মাসের শেষের দিকে একবার জয়ন্তী যাব!’
–শিওর যাবা? তাইলে আমি ছুটি নেব ক’দিন!
অল্প হাসল অবিনাশ, ‘একদম! পাক্কা! আমিও দু-তিনদিন ছুটি নেব তখন!’
গেলাসে একটা চুমুক দিয়ে কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর জন বলল, ‘তুমি লোকটা খুব ভালো! নাইলে আমার মতো ড্রাইভারকে কে পাত্তা দেয়!’
এই কথাটি প্রায় বলে জন, অবিনাশ কিছুটা আন্দাজ করতে পারলে জিজ্ঞাসা করেনি কখনও। খুব গরীব ঘরের ছেলে, নিজের চেষ্টায় রোজগার করে মোটামুটি স্বচ্ছলতা ফিরিয়েছে। একবার মালবাজারে ওর বাড়িও গেছে অবিনাশ, উঠান ঘেরা টিনের চালের বাড়ি, গাছপালা রয়েছে, ভারি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, বাবা আর বোনকে নিয়ে সংসার, ওই গৃহে পা দিয়ে অবিনাশের মনে হয়েছিল, বাড়ি শব্দটি প্রকৃতপক্ষে শ্রী এবং ভালোবাসা দিয়ে তৈরি হয়!
গেলাসে অল্প রাম আর জল ঢেলে অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা জন তোরা তো ওঁরাও, হঠাৎ খ্রীষ্টান হতে গেলি কেন?’
–আমি তকন খুব ছোট বুঝলা, মা মারা গেচে, বোন আরও ছোট। ধারে বাবার গলা ডুবে আচে, সে সময় আমাদের দেশের এক কাকা বাবাকে চার্চে ফাদারের কাচে নিয়ে গেছল, তা দ্যাখো, নে গেল বলেই তো আমার বারো কেলাস অবধি লেখাপড়া হল, খাবার জুটল, এই চাকরিখান পেলাম, ঘর করলাম! খালি প্যাটে আমাদের ধর্ম নিয়ে কী করব বলো দেকিন! মাতায় মাখব?
–দেশ মানে সেই নাগারকাটা? ওখানে কিছু সম্পত্তি আছে এখনও?
শুয়োরের মাংস আর একমুঠি শশা মুখে দিয়ে জন বলল, ‘সে সুদু জঙ্গল আর জঙ্গল! কত পাখি ছিল, রাতে হাতির ডাক, আমাদের নিকানো উটোনে বন মুরগি আসতো’, কথার মাঝেই অবিনাশ স্পষ্ট দেখতে পেল, প্রায়ান্ধকার সন্ধ্যায় এক কিশোরের কণ্ঠে দেশের বাড়ির বিষাদ মধুর ধ্বনি কোন্ সূক্ষ্ম ছন্দে বেজে উঠল, সেই জনহীন ভিটা এখন হয়তো জঙ্গলাকীর্ণ, ভগ্ন উঠানে ধামসা-ঢোল বাজে না কতকাল, পরবের নাচে, মহুয়া ফুল আর শালপাতার সুবাসে শোনা যায় না মানুষের বেদনা-আনন্দ-অশ্রুর আখ্যান, এমন চৈত্র সন্ধ্যায় অলীক কোন্ জগত থেকে সম্ভবত সত্যিই নেমে আসেন বনদেবী-তাঁর জ্যোৎস্না আঁচলখানি পেতে বসেন জনমানবশূন্য ভিটার দাওয়ায়, বাস্তুসর্প উঠে আসে দেবীর কোলে, মাথায় নক্ষত্রখচিত মুকুটের মতো পাখা মেলে দেয় ময়ূর, শিঙাল এসে মুখখানি পেতে সজল চোখে তাকায়, তখনই হয়তো জন নামের সেই অশ্রু টলোমলো বালককে স্নেহ স্পর্শে কাছে ডেকে নেন ঘটনঅঘটনপটিয়সী, একমুঠি বনকুসুমের রেণু মাথায় রেখে সহাস্যে বলেন, ‘তোমার গৃহ কেহ নষ্ট করে নাই, আমি আগালাইয়া রাখিয়াছি! চাহিয়া দেখ, তুমি আসিবে বলিয়া জ্যোৎস্নাকুসুমে ভরিয়াছি চরাচর, আইসো, আমার ক্রোড়ে আইসো, তোমার দুইটি দুধ নয়ানে নিদ্রা হইয়া আমি আসন পাতিয়া বসিব!’
কয়েক মুহূর্ত পর ছায়াচ্ছন্ন স্বরে জন বলল, ‘অল্প যা কিচু ছিল সব বেচে দিচি! কী হবে বলো, ওসব আদারে বাদারে জমি-জমা-ঘর রেখে, ওই টাকা দিয়াই তো একানে ঘর উঠালাম।’
উদ্বাস্তু কলোনির আধ-ফোটা কিশোরীর মতো চাঁদ ভেসে উঠছে পূর্ব দিগন্তে, ক্ষীণকায়া মূর্তি নদী এখন রৌপ্যবসনা অপরূপা, অস্পষ্ট কুয়াশার মতো নিথর অরণ্য থেকে সহসা ভেসে এল বৃংহণ, অচেনা বনকুসুমের শ্বাস বাতাসে মৃদুস্বরে সুদূর গান্ধর্বীদের আহ্বান জানিয়ে যেন বলছে, ‘এসো, এসো এসো!’
হাতির ডাক শুনে উঠে দাঁড়িয়ে ঘড়ি দেখল অবিনাশ, প্রায় সাতটা বাজতে চলল, জনের দিকে ফিরে বলল, ‘চল্, এবার আমি ফিরব। আবার পরের রবিবার!’
জন তখনও গেলাসে মগ্ন, ঈষৎ শিথিল কণ্ঠ, ‘আমি আগাই দিয়া আসি?’
–আরে না, তুই শেষ করে বাড়ি যা এবার। আমি ঠিক পৌঁছে যাব।
–সাঁঝ লাগচে, মহাকাল পতে আসতি পারে, দেকাশুনা যাও!
কথার উত্তর না দিয়ে মুচকি হেসে নিচে নেমে এল অবিনাশ, সাইকেলের তালা খুলতেই লামহা এসে সহাস্যে বলল, ‘হস গারা ডাকদার সাহাব!’
–হোসিয়ারা পানি দিদি!
সাইকেল নিয়ে হাসপাতাল পার হয়ে কোয়ার্টারের গেটের দিকে যাওয়ার সময় ফুটফুটে জ্যোৎস্নায় অবিনাশ দেখল তার বারান্দার সামনে শোভন বাবু দাঁড়িয়ে রয়েছেন। ভদ্রলোক হাসপাতালের উল্টো দিকে দত্তপাড়ার গলিতে ভাড়া থাকেন, পি-ডব্লু-ডির চাকরি সুত্রে বছর তিনেক হল এখানে বদলি হয়ে এসেছেন, অবিনাশের সঙ্গে পরিবারটির ভারি ভালো সম্পর্ক। দ্রুত সাইকেল নিয়ে বারান্দার সামনে এসে অবিনাশ জিজ্ঞাসা করল, ‘কী ব্যাপার শোভনদা? কারোর শরীর খারাপ নাকি?’
উৎকণ্ঠিত স্বরে শোভন চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘আর বলো না ভাই! নূপুরের সেই সন্ধে থেকে জ্বর এসেছে, খুব কাঁদছে, কী যে করি।’
দ্রুত হাতে সাইকেল স্ট্যান্ড করে নিজের ব্যাগটি হাতে নিয়ে অবিনাশ বলল, ‘সে কী! চলুন চলুন, দেখি কী হল।’
একবছরের মেয়েকে কোলে নিয়ে খাটে বসে রয়েছেন প্রতিমা, কাঁদতে কাঁদতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে মনে হয় শিশুটি-ক্ষীণকায় পাখির বাচ্চার মতো শব্দ মুখে, কাছে গিয়ে নাড়ি দেখল অবিনাশ, সামান্য দ্রুত, স্টেথো বুকে বসিয়ে প্রতিমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘জ্বরের ওষুধ দিয়েছেন বৌদি?’
–হ্যাঁ, ক্রোসিন ছিল তাই এক ঢাকনি দিয়েছি।
জামা তুলে অবিনাশ নূপুরের পেটে আলতো হাত দিতেই সজোরে কেঁদে উঠল, ভালো করে পেট পরীক্ষা করে শুধোল, ‘হিসি হচ্ছে তো?’
ব্যাকুল স্বরে প্রতিমা বললেন, ‘হিসি হচ্ছে কিন্তু আজ দুদিন পায়খানা করেনি!’
–হুঁ, উইন্ড আছে মনে হল। এক কাজ করুন, ডি-কোলিক আছে ঘরে?
পাশ থেকে শোভন বললেন, ‘ডি-কোলিক তো নেই তবে গ্রাইপ-ওয়াটার আছে।’
–না শোভনদা গ্রাইপ-ওয়াটারে হবে না, ও কোনও কাজের জিনিস নয়। আমি প্রেসক্রিপশন করে দিচ্ছি আপনি ডি-কোলিক নিয়ে আসুন।
মেয়েকে বুকে নিয়ে প্রতিমা আকুল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘চিন্তার কিছু নেই তো ভাই?’
অবিনাশ প্রেসক্রিপশন প্যাড বের করে মৃদু হেসে দৃঢ় স্বরে বলল, ‘কিচ্ছু হবে না বৌদি, চামচে করে বারবার জল খাওয়ান আর হিসি হচ্ছে কিনা খেয়াল রাখবেন।’
–রাতে যদি জ্বর আসে?
–তাহলে আবার দু এম.এল মাপ করে ক্রোসিন দেবেন। চিন্তার কিচ্ছু নেই, কাল সকাল হতেই দেখবেন খিলখিল করে হাসছে আর রাতে আমি তো রইলাম!
কলমের মুখ খুলে শিশুর নাম লিখতে গিয়ে মুহূর্তের জন্য থামল অবিনাশ, ‘বৌদি নূপুরের ভালো নামটি কী যেন! কিছুতেই মনে থাকে না!’
শিশুকে কাঁধের উপর রেখে পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে প্রতিমা বললেন, ‘ঐন্দ্রী, ঐন্দ্রী চট্টোপাধ্যায়!’
(ক্রমশ)