আহাম্মকের খুদকুড়ো । পর্ব ২ । লিখছেন দুর্লভ সূত্রধর

পোড়ের ভাত আর রহস্যময় ঘি
সাত-আটদিন জ্বর। সকালে জ্বর কমে যায়, সকালের অরুচির জলখাবার খেয়ে জ্বরীর পিপাসায় আকন্ঠ জল খাওয়ার পর পরই আবার কম্প দিয়ে জ্বর। বাবা ডিস্পেন্সারি যাওয়ার আগে একবার দেখে মাকে বা দিদিদের কাউকে নির্দেশনা দিয়ে যান। সারাদিন লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে, ঘন্টায় ঘন্টায় থার্মোমিটার দিয়ে জ্বর মেপে মা লিখে রাখেন একটা কাগজে – বাবা ডিস্পেন্সারি থেকে বাড়িতে এসে দেখবেন। মাঝখানে একবার মাথা ধোওয়া, তীব্র আপত্তি ও কান্নাসহ সাবু-বার্লি গলাধঃকরণ। মাঝে মাঝে মা বা মেজদি ছোড়দির কেউ এসে ওষুধ বলতে শিশি-ঝাঁকানো জল, সাদা সাদা মিষ্টি বড়ি বা পুরিয়া-বন্দি সাদা পাউডার। বাবার দেওয়া সেই ওষুধেই জ্বর বাড়া-কমা, সাতদিন বা দশদিনের তীব্র জ্বরের পরও কোনোরকম দুর্বলতা বা শরীরী লক্ষণ না-রেখেই জ্বরের অবসান।
যেদিন বাবা স্নানের অনুমতি দিতেন সেদিন বুকের ভেতরে অন্তর্গত উৎসবের নৃত্য – আজ ভাত খাওয়ার দিন। সে ভাত তো যে-সে ভাত নয় জ্বরমুক্ত ভি আই পি-র জন্য প্রস্তুত ভাত।
পোড়ের ভাত।
জ্বর হওয়ার সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই ছিল। সাবু-বার্লির দুঃখ ছিল, সেই সঙ্গে ছিল সাংসারিক ব্যস্ততার মধ্যেও জ্বর বাড়লে মায়ের হাত বুলিয়ে দেওয়া, দিদিদের একটু মনোযোগ। সর্বোপরি জ্বর যেদিন ছাড়বে সেদিনকার পোড়ের ভাতের হাতছানি।
সকাল সকাল মা স্নান সেরে ফর্সা কাপড় পরে জ্বোরো রোগীর জন্য মাটির ছোটো হাঁড়িতে ভাত চাপিয়ে দিতেন। এমন একটা হাঁড়ি তখন অনেক সংসারেই থাকত।
কেননা জ্বর ছিল একটি লোকপ্রিয় ব্যাপার। পোড়ের ভাতের জন্য জ্বালানি দেওয়া হতো শুধুমাত্র ঘুঁটে দিয়ে। ফলে ঢিমে আঁচে অনেকক্ষণ ধরে ফুটতে থাকত সেই ভাত – গোবিন্দভোগ আতপ চালের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়ত চারদিকে। ভাতের মধ্যেই দিয়ে দেওয়া হতো কয়েকটি তরিতরকারি। পোড়ের ভাতে এক-চামচ ঘি দেওয়াটা ছিল আবশ্যিক।
ছোটোদের কাছে এই ঘি-এর ব্যাপারটা বরাবর ছিল রহস্যময়।
আমাদের শহরে তখন সত্যিকার ঘি পাওয়া যেতো একটা মাত্র দোকানে। সেটা ছিল শুধুমাত্র ঘি-এরই দোকান। সেই দোকান থেকে অনেক দূর পর্যন্ত বাতাস ঘি-এর গন্ধে সর্বদা আমোদিত থাকত। মাখন জ্বাল দিয়ে ঘি তৈরি হতো। দোকানটি বড়ো-রাস্তায়, কিন্তু অন্ধকার অন্ধকার, রহস্যময়। সারাদিন দোকানের ভেতরে জ্বলত একটামাত্র টিমটিমে বাতি। ভূতো-ভূতো অন্ধকার আরও বেড়ে যেতো। অতীব ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন দোকানের মালিক নাকি বন্ধুমহলে বলতেন—‘ওরে, বেশি পাওয়ারের আলো জ্বালিয়ে পয়সা খরচ করব কেন, যতই আলো জ্বালি আমার মতো অন্ধের তো একই অবস্থা থাকবে, ওই যে বলে না, ‘অন্ধের কীবা দিন কীবা রাত।’
একেই বলে নিজের মাপ-বুঝে চলা|
সারাদিন ঘি জ্বাল দেওয়ায় দোকানের সবই তেলতেলে, চকচকে – দাঁড়িপাল্লা থেকে বাটখাড়া, ‘করচা’ করার কুটুম-কাটুমগুলো থেকে দোকানের টেবিল-বেঞ্চি – মায় মালিকটি পর্যন্ত। তাঁর চোখে ছিল মোটা ফ্রেমের পুরু কাঁচওয়ালা চশমা। পরনে থাকত খাটো ধুতি আর ফতুয়া। সে-দুটির রঙ বোধহয় এককালে সাদাই ছিল, কিন্তু আমরা দেখতাম তার রঙ কালচে মেটে মেটে। সারা শরীর তাঁর ঘি-ময়। খরিদ্দারদের সঙ্গে তিনি কথা বলতেন ইঙ্গিতে। আঙুল দেখিয়ে ঘি-এর পরিমাণ বোঝাতে হতো তাঁকে। কেননা চোখের থেকেও তাঁর কানের অবস্থা ছিল শোচনীয়তর। সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার ছিল তাঁর ঘি ওজন করার কায়দা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তিনি খরিদ্দারের আনা শিশিটি নানা-মাপের লোহার টুকরো, ছোটো টিনের পাত, ছোটো-খাটো কালো পাথর দিয়ে ‘করচা’ করে নিতেন, তারপর শিশিতে যে-পরিমাণ ঘি ঢালতেন সেটা একবারে প্রার্থিত ওজেনর সঙ্গে মিলে যেত। আর মিল কি সোজা মিল – পুরোনো আমলের দাঁড়িতে একেবারে কাঁটায় কাঁটায় মিল। মায়ের ডিম ভাগ করার এমন নিখুঁত মাপের মতো।
আসলে তখন সকলের মধ্যেই একটা মাপবোধ ছিল, তাঁরা নিজেদের মাপও জানতেন, জানতেন অপরের ওজন বা জিনিসের মাপ। সকলকে অবলীলায় ‘তুমি’ বা ‘তুই’ বলার রাতি প্রায় ছিলই না তখন। সবকিছুকে ডিঙিয়ে, টপকে, অপরকে কুনুইয়ের গুঁতো মেরে গ্যালপ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা ছিল কম।
দোকানে খরিদ্দার না থাকলে দোকানের বেঞ্চিতে বসে একেবারে নাকের ডগায় ধরে তিনি পাঠ করতেন খবরের কাগজ। ইংরেজি কাগজ, স্টেটস্ম্যান – মাঝে মাঝে ছোটোমাপের ইংরেজ বই। পরে জেনেছি ঐ বইগুলোকেই বলে পেপারব্যাক সিরিজ। বড়োরা তাঁকে রীতিমতো সম্ভ্রম করতেন সবাই। শোনা যেত তিনি ছিলেন মেধাবী ছাত্র। কোনো এক রহস্যময় জ্বরে প্রথমে তাঁর শ্রবণেন্দ্রিয় নষ্ট হয়, পরে অতিরিক্ত পাঠ ও দারিদ্র্য তাঁর দৃষ্টি হরণ করে। লোকে বলে একটি ইন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হলে ক্ষতিপূরণস্বরূপ অন্য ইন্দ্রিয়গুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ফলে চোখ আর কান গিয়ে তাঁর ঘ্রণেন্দিয় প্রবল শক্তিশালী হয়ে ওঠে। নিজের মাপ-বুঝে ছাত্র-পড়ানো ছেড়ে তিনি এই ঘি-এর দোকান করেন।
ঘি-বস্তুটি নিয়ে প্রচুর নিরীক্ষার ফলস্বরূপ তাঁর তৈরি ঘি সমস্ত শহরের গর্ব হয়ে দাঁড়ায়। আজকের দিন হলে একটি লেবেল মেরেই তাঁর ঘি ব্র্যাণ্ড হয়ে দ্বিগুণ দামে কায়দা-বিপণিগুলোতে শোভা পেত। তারই নিদর্শনস্বরূপ এই অকৃতদার মানুষটি প্রয়াত হবার পর তার ভাইপোদের হাতে দোকানের হাল বদলায়। ঝাঁ-চকচকে শোকেসে বোতল ও শিশিভর্তি ঘি শোভা পেতে থাকে। সেই সঙ্গে উধাও হয় ঘি-এর দীর্ঘবৃত্তে ছড়িয়ে পড়া অসামান্য সুগন্ধ, সেই সুযোগে শহরে আরও ঘি-এর দোকান গজিয়ে ওঠে। বিলুপ্ত হয় শহরের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যের বনেদিয়ানার গল্প।
আমাদের মতো পরিবারগুলোতে এই দোকান এই দোকান থেকে ঘি আসত নিয়মিত, কিন্তু তা সাধারণভাবে ছোটোদের পাত পর্যন্ত পৌঁছাতো না। বাড়ির খাটিয়া কর্তারা পাতে খেতেন আর বিশেষ বিশেষ তরকারিতে সেই ঘি ব্যবহৃত হতো। আমাদের বাড়িতে বাবার পাতের দুপুরের আলুসেদ্ধ মাখা হতো ঘি দিয়ে। তিনি আমাদের জ্ঞানকালে পুরোপুরি নিরামিষাশি ছিলেন। সুতরাং আমরা ঘি-এর গন্ধ যতটা পেতাম পাতে ততটা পেতাম না।
তা এই ঘি-দেওয়া পোড়ের ভাতের গন্ধে দশদিনের ভাত-উপবাসী জ্বরের রোগীর জ্বর জ্বর-ভাব পালাত অনেক দূরে। আর পোড়ের ভাতের লোভে যাকে বলে ‘পরিমল লোভে অলি আসিয়া জুটিল’-র লাইভ ডেমন্স্ট্রেশন।
(ক্রমশ)
দুর্লভ সূত্রধর
লেখক ছদ্মনামের আড়ালেই থাকতে চান, তাই ছবি কিংবা পরিচিতি কিছুই দেওয়া গেল না।