মেলার ভিড়ে না হারানো মেলা। “পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি”। পড়লেন সুপ্রিয় ঘোষ

গ্রন্থালোচনা। লিখছেন সুপ্রিয় ঘোষ।
পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি। সমরেন্দ্র মণ্ডল। সুপ্রকাশ। প্রচ্ছদঃ সৌজন্য চক্রবর্তী। মুদ্রিত মূল্য ১৫০ টাকা।
ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে অবিভক্ত নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরকে কেন্দ্র করে প্রোটেস্ট্যাণ্ট ও ক্যাথলিক খ্রিস্টান মিশনারিরা ধর্ম প্রচার শুরু করেন ।কৃষ্ণনগর, রানাঘাট, চাপড়া ও তৎসন্নিহিত ডোমপুকুরিয়া, আড়ংসরিষা, বেতবেড়িয়া, ভাতগাছি, মালিয়াপোতা, শলুয়া,রানাবন্দ এ ছাড়াও বর্তমান বাংলাদেশের ভবরপাড়া, মুন্সীপুর প্রভৃতি বিস্তৃত অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে খ্রিস্ট ধর্ম ।মূলত দরিদ্র ও চর্মকার সম্প্রদায়ের মতো নিম্ন বর্গীয় মানুষেরা এই ধর্ম গ্রহণ করেন ।
খ্রিস্ট ধর্ম প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম কেন্দ্রিক পালা-পার্বণে মত্ত হয়ে ওঠেন ধর্মান্তরিত মানুষেরা।বড়দিনের উৎসবকে কেন্দ্রকরে বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠে মেলা ।১৮৯৪ সালে চাপড়া প্রোটেস্ট্যাণ্ট গির্জা সংলগ্ন মাঠে প্রথম বসে বড়ো দিনের মেলা ।যা ‘নদীয়া মিশন মেলা ‘নামে পরিচিত হয়।এটিই অবিভক্ত নদীয়া জেলার প্রথম পরিকল্পিত মেলা ।
এরপর ক্রমশ বল্লভপুর, কৃষ্ণনগর, রানাঘাট প্রভৃতি স্থানে জমে ওঠে বড়দিনের মেলা। এই মেলাগুলি নিয়ে সম্প্রতি সুপ্রকাশ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে সমরেন্দ্র মণ্ডলের বই ‘পথ মিশে যায় মিশনবাড়ি’।তবে নিছক নদীয়ার খিস্টমেলার দর্পণ নয় এই গ্রন্থ। লেখক তাঁর কল্পিত চরিত্র পরাশরের মুখ দিয়ে গল্প কথার ছলে গ্রন্থ জুড়ে বলে চলেছেন মেলায় উৎসবে ইতিহাসে খ্রিস্ট-ধর্ম-সংস্কৃতি কীভাবে মিশে গেছে বাঙালির চিরায়ত কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে।
লেখক নদীয়ার সর্বপ্রাচীন চাপড়া খ্রিস্টিয় মেলার আলোচনা প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন খ্রিস্ট কীর্তনের কথা।বৈষ্ণব, বাউল, কর্তাভজা, সাহেবধনী, বলাহাড়ি সম্প্রদায়ের নদীয়ার ভাগীরথী-জলঙ্গীর ঢেউয়ে ভাসে সুপ্রাচীন কাল থেকে কীর্তনের সুর। চাপড়ার অদূরে দুর্গাপুর গ্রামের কর্তাভজা সম্প্রদায়ের মানুষ যখন খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ করেন তখন তারা সঙ্গে করে আনেন পূর্ব সংস্কার। সংস্কারের ফসল খ্রিস্ট কীর্তন। আমাদের সংস্কৃতির এ এক আবিষ্কার। সুপ্রকাশের অঞ্চল চর্চার এই তৃতীয় গ্রন্থটি সেই অর্থে বাঙালির এক মিশ্র সংস্কৃতির দলিল বটে।
সাধু চার্লটন চাপড়া মেলার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ছিলেন লোক শিল্প ও কৃষিজ পণ্যের প্রদর্শনী ও বিপণন। ধর্মের সাথে অর্থ লাভ। সব ধর্মের মানুষের কাছে এ মেলা হয়ে ওঠে আকর্ষণীয়। সর্বজনীন।
তাই ১৮৪৬সালে কৃষ্ণনগরে প্রতিষ্ঠিত কার্মেলের মাতা মারিয়ার মিশনবাড়ি, রানাঘাটের বেগোপাড়া কিংবা বল্লভপুরের মিশনবাড়ির পথ মিলে যায় সব পথের সঙ্গে।
এর আগে কিছু জায়গায় নদীয়ার খ্রিস্ট মেলা নিয়ে আলোচনা থাকলেও তা ছিল খণ্ডিত(যেমনঃ শতঞ্জীব রাহা সম্পাদিত আজকের প্রতিভাস পত্রিকার নদীয়ার মেলা সংখ্যা, শ্যামল মৈত্র সম্পাদিত নদিয়ার জেলার গ্রাম, শহর-এ পূজা-পার্বণ ও মেলা ইত্যাদি)। অন্যান্য স্থানেও এসম্পর্কিত লেখা পূর্বে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্তু নদীয়ার খ্রিস্ট মেলা নিয়ে এই গ্রন্থটি সম্পূর্ণতার দাবি রাখে।