বাংলা গণসংগীতের বিবর্তন নিয়ে একটি বই। পড়লেন সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়
গ্রন্থ আলোচনা। লিখছেন : সুজন বন্দ্যোপাধ্যায়।
বাংলা গণসংগীতের বিবর্তন। পার্থসারথি সরকার। বার্ণিক। মুদ্রিত মূল্য: ২০০ টাকা।
প্রকৃতির সঙ্গে লড়ে অস্তিত্ব রক্ষার জন্য ও জীবিকার জন্য শ্রম থেকেই উঠে আসা শ্রমসংগীত ও লোকসংগীতের । সেই লড়াই যখন এসে পরিণত হলো, মানুষের সাথে মানুষের লড়াইয়ে, তখন আমাদের যাপন থেকেই স্বতঃশ্চলভাবে এল গণসংগীত। তাই তার তাত্ত্বিক ভূমিটি ফরাসি বিপ্লব বা তার পরে রুশ বিপ্লবের সময় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগেই সারা পৃথিবী জুড়ে অজস্র জাতি-উপজাতির শ্লোগানে উঠে আসা সম্ভব– আমাদের দেশেও এর শুরু হতে পারে আজ থেকে বহু হাজার বছর পূর্বে, যখন এ দেশের আদি অধিবাসী অনার্যদের লড়তে হয়েছিল অধিকারের জন্য। তাই আমাদের দেশে বিভিন্ন উপজাতি-লোকথাতেও গণসংগীতের আদি-সূত্র থাকা খুবই সম্ভব।
সারা পৃথিবীতেই শিল্পবিপ্লবের পরবর্তী পর্যায়ে সমাজের গরিষ্ঠ সংখ্যক মানুষের শ্রমকে সস্তায় কিনতে চেয়েছে অঙ্গুলীগণ্য মানুষ– এ সময়েই ধীরে ধীরে গণসংগীতের আন্তর্জাতিক তাত্ত্বিক ভূমিটি প্রস্তুত হতে থাকে। তাই এই আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিত ও এ দেশে গণসংগীতের সঙ্গে তার যোগটুকুর প্রকৃত স্বরূপ উন্মোচনে এই বইয়ের কাছে প্রত্যাশা ছিল অত্যন্ত বেশি, বইয়ের নামই এই ধরণের প্রত্যাশার দিকে পাঠককে খুব সংগত কারণেই এগিয়ে দেয়। কিন্তু প্রথম অধ্যায়ে দায়সাড়া কিছু এলোমেলো কথা ছাড়া এক্ষেত্রে প্রাপ্তি শূন্য। তবে বাংলা গণসংগীতের ইতিহাসটি লেখক দ্বিতীয় অধ্যায়ে যথেষ্ট মুন্সীয়ানার সঙ্গে দেখিয়েছেন। লোকগান, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন–তারপর বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দােলন, এ দেশে কমিউনিস্ট পার্টির জন্ম, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিতে তৈরী হওয়া যুদ্ধবিরোধী গান—সবই উল্লেখ করেছেন ইতিহাসের পূর্বাপর অনুযায়ী। লেখকের আলোচনায় এসেছে কবিগানের প্রসঙ্গও। দ্বিতীয় ও তৃতীয়–দুই অধ্যায় জুড়েই অসংখ্য গণসংগীতের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি সেই সময়ের আয়তনটিকে ধরতে চেয়েছেন। সময়ের আয়তনটিকে ধরে রাখা শুধু নয়, মানুষের বেঁচে থাকার অভীপ্সাগুলিকে গানে চিহ্নিত করতে পারা যায় বলেই তো তা গণসংগীত। গণসংগীত তো চিরকালই যাপন থেকেই উঠে এসেছে, লড়তে লড়তে লেখা হয়েছে, সুর দেওয়া হয়েছে ও হয়তো গান তৈরীর এক-দু ঘন্টার মধ্যে গাওয়াও হয়েছে প্রচুর মানুষের সামনে অথবা মিছিলে। স্বল্প পরিসরে হলেও লেখক সেটি ধরতে চেয়েছেন ও পেরেছেন। পঞ্চম অধ্যায়ের গণসংগীত ও লোকসংগীতের তুলনামূলক আলোচনা অংশটি নিয়ে গণসংগীতকারদের আপত্তি থাকতেই পারে। তবু বিকল্প আলোচনার প্রেক্ষিতে এই অংশটির মূল্য রয়েছে।
সারা বইয়ে প্রায় কোথাও সূত্র-উল্লেখ নেই। বইয়ের একদম শেষে রয়েছে কিছু বইয়ের নাম। এ ধরণের ডকুমেন্টেড কাজের জন্য এ পদ্ধতি কতটা গ্রহণযোগ্য– তা নিয়ে সংশয় থেকে যায়। তাছাড়া বইয়ের শেষে কোনো শব্দ-নির্দেশ নেই– এ ধরণের বইয়ে নির্ঘন্টও প্রত্যাশা করেন পাঠক।