অসুখ, সমর ভট্টাচার্য
পা আর চলে না। দেহ আর বয় না।
তবু হাঁটে সদু বুড়ি।—
একবার যদি কোনোরকমে পৌঁছতে পারে তাহলে হয়তো সারলেও সারতে পারে। অতবড় নাম করা ডাক্তার। কত লোকে কঠিক ব্যামো থেকে আরোগ্যি করিয়েছে—সে সব লিখা আছে কাগজখানাতে। ছবি শুদ্ধ ছাপা হয়েছে। আহা! কী চেহারা দেখলে ভক্তিতে মাথা নুয়ে আসে আপনা থেকে। সদু বুড়ি পোস্টকার্ডের মতো কাগজখানা ময়লা আঁচলের গেরো খুলে বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে।
সদু বুড়ির যে কী অসুখ তা কেউ ধরতে পারেনি। গাঁয়ের জ্ঞানী গুণী কত জনকে দিয়ে দেখিয়েছে। শিকড় বাকড় জল পড়া খেয়েছে ঘটি ঘটি। ওঝা বদ্দি ঝাড় ফুঁক কত কি। কিন্তু কিসের কি? যে কে সেই। দিন কতক বেশ ভালো। সেটা হয়ত বিশ্বাসের গুণে। তারপর থেকে শুরু হয় আবার। এক নাগাড়ে যন্ত্রণা। উঃ! সে কি যন্ত্রণা, মনে হয় পরাণ বুঝি বেরিয়ে যাবে। তা যাবে তো যাক না। এত যন্ত্রণা কেনো রে বাপু। তোকে কি শিকল দড়া দিয়ে বেঁধে রেখেছি? বাঁচতে আর সাধ নেই। অনেক দ্যাখলাম জীবন-ভোর। এখন গেলেই বাঁচি।—সদু বুড়ি ঝুড়ি-নামা বট গাছের গোড়ায় বসে আক্ষেপ করতে থাকে।
সদু বুড়ির হিসাবে সদু অর্থাৎ সৌদামিনীর বয়স তিন কুড়ি দু’বছর। কুড়ি হিসেবে বয়স মাপে। মাথার চুল সাদা কালোয় জড়াজড়ি।
দাঁত বিহীন শিশুর হাসি হেসে বলে—‘কত দ্যাখলাম জীবন-ভোর। তুরা আর কী দেখছিস? যুদ্ধই যদি বলিস, কী যুদ্ধই না হয়েছিল সেবার। ঝাঁকে ঝাঁকে উড়োজাহাজ উড়ে যেত ঘরের মটকা ছুঁয়ে। খেলা করত উল্টিয়ে পাল্টিয়ে আকাশের বুকে। দেখে মনে হত শঙ্খ চিল। আর গোরা সোলজার গুলোন? অ্যাং-ব্যাং-চ্যাং করে কী যে মাথা-মুণ্ডু ছাই বলত তা তারাই জানে। তবে মনগুলোন ছিল খুব ভালো। একেবারে বেবাক খোলা। ছোট ছেলেদের বিস্কুট দিত টিন টিন। টাকা ছিটাত মূঠো মুঠো। জিনিষের দাম যদি এক টাকা হত দিত দশ টাকার নোট ফেলে। ফেরৎ দিতে গেলে, ওরে বাবা সেকি রাগ। ইনজিরিতে অকথা কুকথা বলত। মুখের ভাবখান দেখে তাই মনে হত। তবে দোষ যে ছিল না তা না। গাঁয়ে ঢুকে দু’চারটে সোমত্থ মেয়েকে অবিশ্যি ধরে নিয়ে যেত। তা আর দোষ বলি কি করে। তারাও তো সমত্থ জোয়ান। আটকা পরে থাকে মাটির তলায়। ঘর বউ সংসার কোন সুদূর মুল্লুকে। জীবন নিয়ে খেলা করে। সে সময় কি ধম্মাধম্ম জ্ঞান থাকে না ভালোমন্দ বিচার থাকে!’
সদু বুড়ির চওখের সামনে অনেক ছবি ভেসে ওঠে।–
যে বট গাছ তলায় এখন বসে আছে রোগজীর্ণ দেহ নিয়ে সেই দেহটাই দু-কুড়ি বছর আগে কত মুজবুত ছিল। এই মেঠো রাস্তা দিয়ে গরুর গাড়ি চড়ে এসেছিল মণ্ডল বাড়ির বউ হয়ে।
রাস্তায় গাড়ি চলে চলে চাকার দাগ দু’পাশে। মধ্যে ঢিবি। দু’ধারে ধূ ধূ মাঠ। ফসল নেই একরত্তি। বন্যায় ধুয়ে মুছে ফরসা। এবার চরম আকাল নামবে দ্যাশে। মড়ক লাগবে। মানুষ গরু ছাগল মরবে ঝাঁকে ঝাঁকে। গরু তো মরতে শুরু করেছে। সামনের মাঠ-খানা ভাগার। গরুর কঙ্কালে বোঝাই। হাওয়াতে চিমসে গন্ধ। এই কিছুক্ষন আগে ফেলে দিয়ে গেল একটা পাকরা বলদ। কার কে জানে! হালের বলদ মরা আর সমত্থ ছেলে মরা চাষার কাছে দি-ই সমান। ওদিকে তেনাদের আনন্দ আর ধরে না। ঝাঁকে ঝাঁকে নামতে শুরু করেছে ছোঁ দিতে। মুখে বিচিত্র শব্দ।–
সদু বুড়ি আপন মনে বকে-‘আর কত খাবি খা না শয়তানগুলোন। তোদের আর কি? যার কপাল ভাঙল সেই বুঝছে। তার এখন মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল। বন্যেতে গেল ফসল ধুয়ে। যেটুকু সম্বল ছিল তাও গেল। তোদের আর কি—খা! খেয়ে নে যত পারিস চেটেপুটে!’
শকুনগুলো এখন সদ্য ফেলে যাওয়া পাকরা বলদটাকে ঠুকরে ঠুকরে খাচ্ছে। বলদটার কঙ্কাল বেরিয়ে পড়েছে। এখন আর ওটাকে শনাক্ত করার কোন উপায় নেই। এতদিন যার হাল বয়েছিল তার পরিচয়ে ওর পরিচয় ছিল। মাঠে ফসল তছরুপ করার সময় ধরতে পারলে গুসের নামে বলদটা গালাগাল শুনত। আবার সুখ্যাতিও শুনত। এখন আর কোন পরিচয় নেই।
সদু বুড়ি বলদের কঙ্কালটার দিকে তাকিয়ে ডান হাতে নিজের হাড় জিরজিরে বুকে হাত বুলতে বুলতে ভাবছিল—এই যে আমি এখন বসে আছি, যদি টুক করে মরে যাই তাতে কার কী আসবে যাবে। আমিই শুধু চলে যাব। সবুজ মাঠ আর কোনোদিন দেখব না। কলাই উঠলে বড়ি দেবার জন্যে সাত সকালে উঠে ঝুড়ি শুকোতে যাব না। ছেলেটা মাঠ থেকে বাড়ি ফিরতে দেরি করলে পথের পানে চেয়ে হা-পিত্তিসে বসে থাকব না। অথচ কিছুদিন আগে পর্যন্ত কত ভাবনাই না ভেবেছি। না জানি কত ভালো দিনকাল আসবে। মানুষ পেট ভরে দুটো খেতে পাবে। জমিদাররা উচ্ছেদ হবে, চাষার হাতে জমি আসবে। আমার ছেলেকে আর পরের ভুঁইয়ে মুনিষ খাটতে হবে না। নিজের জমিতে লাঙল দেবে। ফসল উঠবে গোলায়। ছেলের বিয়ে দেব। বউ পৌষ লক্ষ্মীর এলুনি দেবে উঠোন ভরে। শাখ বাজবে সন্ধে বেলা। কানায় কানায় ভরে উঠবে আমার সংসার।
সদু বুড়ির সেই দিনগুলির কথা মনে হয়।
কালাচাঁদ হলের মিটিংয়ের ছবিটা আজও চোখে ভাসে। ভাতার মিনসে নিয়ে গিয়েছিল সাথে করে। বলেছিল-‘চল, বউ দেখবি সেই মানুষটাকে। যে মানুষটা দেশ ইংরেজ তাড়ানোর জন্য লড়াই করছে।‘
হ্যাঁ, দেখেছিল সদু বুড়ি। দেখে চোখের পাতা আর পড়েনি। কী চেহারা? যেন রাজপুত্তুর। বলেছিল- ‘স্বরাজ এনে যদি তোমরা আমাকে রক্ত দিতে পার।’
‘স্বরাজ’ মানে কী কে জানে! সৌদামিনীর বয়স তখন সবে বছর কুড়ি। মনটা সবুজ ফসলী মাঠের মত বিস্তৃত। স্বরাজের মানে না বুঝলেও মনে হয়েছিল সেটা নিশ্চই বড় সুন্দর কিছু একটা, হয়ত কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোতে জোচ্ছনা ধোয়া চাষি বাড়ির এলুনি দেয়া তকতকে উঠোনের মতো। কিংবা শরতের মেঠো রাস্তায় পড়ে থাকা শিউলি ফুলের মতো পবিত্র। যে শিউলি দুলে বাগদী ভদ্দর রোদ্দুর সকালে একসাথে কুড়িয়ে, বোঁটা শুকিয়ে বাসন্তী রংয়ে কাপড় ছুপিয়ে পরে যেমন আনন্দ পায়- এমন নিশ্চয় কিছু একটা হবে। তবে ভালো লেগেছিল সেই রাজপুত্তুরকে। মধুর মতো কানে লেগেছিল। মনে পড়েছিল ঠাকমার কাছে শোনা রাজপুত্তুর মন্ত্রীপুত্তুর আর সেই কোটালপুত্তুরের গল্প। রাজপুত্তুর অত লোকের মধ্যে ভিক্ষা করেছিল। সবাই খুলে দিয়েছিল গা থেকে গয়না। সদুর সামনে যখন এসেছিল তখন কুড়ি বছরের সৌদামিনীর চোখ দু’টো ভ’রে উঠেছিল জলে। মন হাহাকার করে উঠেছিল—না না, এ তুমার সাজে না গো—সাজে না। কিন্তু সদু গয়না কোথায় পাবে। কান্না ভিজে গলায় বলেছিল তাই কুড়ি বছরের সৌদামিনী—‘আমার তো সোনা নাই বাবা, এটা ছাড়া আর কিছু নাই’—বলে পাছা হারটা খুলে ফেলে দিয়েছিল রাজপুত্তুরের হাতে ধরা কাপড়ের ওপর।
রাজপুত্তুর একফালি জোচ্ছনার মতো হেসে বলেছিল—‘তুমি অনেক দিয়েছ মা। এতো শুধু হার নয়, এ তোমার সম্পূর্ণ হৃদয়।’
রাস্তায় আসতে আসতে সৌদামিনী জিজ্ঞেস করেছিল স্বামীকে—‘হ্যাঁ গো স্বরাজ কাকে বলে?’
ক্ষ্যাপাচাঁদের স্বরাজ সম্বন্ধে খুব একটা জানা না থাকলেও একটা ধারনা দেবার চেষ্টা করেছিল—‘স্বরাজ মানে হল গিয়ে স্বাধীন। এই ধর আমাদের উপর কেউ হুকুমদারি করতে পারবে না। আমরা বুক দিয়ে খাটব। পেট পুরে খাব। বুক ফুলিয়ে বেড়াব।’
সদু জিজ্ঞেস করেছিল—‘তুমার জমি হবে?’
গভীর আত্মপ্রত্যয়ে জবাব দিয়েছিল ক্ষ্যাপাচাঁদ—‘হবে না? নিচ্চয়ই হবে।’
আর কতদূর—’
সৌদামিনী ওঠে। বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে।
কতজনকে খোসামোদ করেছে একটিবার ডাক্তারবাবুর কাছে নিয়ে আসার জন্যে। কেউ আসেনি। তাই সদু নিজেই যাচ্ছে। কী যে অসুখ কে জানে। শুধু প্যাটের মধ্যে হু হু করে জ্বলে। মনে হয় পরাণ বুঝি এই বেরুই তো সেই বেরুই। –তা বেরুবিই যদি তো এত দ্গদানি কেনে রে বাপু!
সদু বুড়ি যখন ডাক্তারখানায় পৌছল তখন বেলা বেশ ওপরে উঠেছে। বারান্দা লোকে ভর্তি। দেখে মুখে বাক্যি সরে না। চক্ষু চড়কগাছ। বাবাঃ ! আজকাল এত মানুষের অসুখ করছে? আগে তো এত অসুখ ছিল না দ্যাশে। একমাত্তর কালাজ্বর, পালাজ্বর, ম্যালেরিয়া এই সব ছিল। ভেবে কূল-কিনারা পায় না সদুবুড়ি।
আস্তে আস্তে বারান্দার লোক কমে। অবশেষে সদুবুড়ির ডাক হয়। দেহটাকে কোনোরকমে টেনে-হিঁচড়ে ভেতরে ঢোকে। একবার মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে পোস্টকার্ডের মতো কাগজে ছাপা হওয়া ছবিটার সঙ্গে। ডাক্তারবাবুর পাশে বসে থাকা লোকটি জিজ্ঞেস করে–কী নাম?
–‘আজ্ঞে সৌদামিনী দাসী।’
–‘বয়স?’
–‘আজ্ঞে তিন কুড়ি দু’বছর।’
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করেন এবার—‘কী অসুখ?’
–‘তা তো জানিনে বাবা। তবে প্যাটের মধ্যি জ্বলে যায়। মনে হয় পরাণ বুঝি আর থাকে না।’
ডাক্তার সদুর হাত দ্যাখে। শুকনো গাল টেনে ফ্যাকাশে চোখে রক্তের সন্ধান করে। তারপর বলে—‘না, তোমার কোনো অসুখ বিসুখ করেনি। ভালো করে খাওয়া দাওয়া করো সব ঠিক হয়ে যাবে।’
আর কতদূর—
সৌদামিনী ফেরে।
দেহ আর বয় না।
পা আর চলে না।
–কতদিন ধরে কাজ কাম নাই ছোঁড়াটার। মাঠের ফসল ডুবে গিয়েছে বন্যের জলে। পাট গিয়েছে তলিয়ে। মুনিষ আর কারুর দরকার নেই। কতদিন ধরে খেতে পায়নি ছোঁড়াটা। পরের দুরে চেয়ে-চিন্তে চলছে। সে আর ক’দিন চলে। তার ওপর এই পোড়ার অসুখ।
এসব কিছু ভাবতে গিয়ে ডাক্তারের ওপর এখন রাগ হয় সদু বুড়ির। আপন মনে গজ গজ করতে করতে পথ হাটে—বলে কিনা ভাত খা! ভাত না ছাই খা! কেনে এত যে ওষুধের বড়াই করিস তুরা, ওষুধ খাইয়ে বাঁচাতে পারিস নে মানুষকে?
সদু বুড়ি হাঁটতে হাঁটতে ডান পাশের মাঠখানার দিকে তাকায়। পাকরা গরুটার শুধু কঙ্কাল পড়ে আছে এখন। তার ঠিক পাশটাতে পড়ে আছে একটা শকুন মুখ থুবড়ে মাটিতে। মরে গিয়েছে বেচারা। গায়ে বোধহয় বল ছিল না। তাই পারেনি খাবার জোগাড় করতে। ওর স্বজাতিরা ওকে ভাগ দেয়নি।
আর কতদূর—
সদু বুড়ির চোখে অনেকদিন পর জল ভরে ওঠে।
ফাঁকা মাঠের মধ্যে বসে পড়ে সদু বুড়ি।
কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর রাতে এলুনি দেওয়া চাষি বাড়ির তকতকে উঠোন, মেঠো রাস্তায় শিউলি কুড়োনো সকাল, কালাচাঁদ হলে দেখা রাজপুত্তুর, সব একাকার হয়ে আসে চোখের সামনে—‘রাজপুত্তুর গো, বলে ডুকরে কেঁদে ওঠে সদু অর্থাৎ সৌদামিনী, ক্ষ্যাপাচাঁদের বউ, ফকিরচাঁদের মা।